জামায়াতে ইসলামী একটি রাজনৈতিক দল, আবার একটি সামাজিক আন্দোলন। মানুষের মধ্যে প্রকৃত মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার জন্য বাস্তবমুখী প্রক্রিয়ায় এটি কাজ করে। দুনিয়ার সব আকর্ষণকে পরাজিত করে অনেকে ফিরে আসে এই সংগঠনের নৈতিকতার প্রাঙ্গণে। তাদের দৈনন্দিন কর্মপ্রণালী, ধর্মীয় অনুশীলন, নামাজ-হাদিস-কুরআনের সময় বেঁধে নিত্যদিনের চর্চা- এমন বাস্তবতা বহন করে। যার ফলে জামায়াত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করে নির্বাচনে জিতে দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামপন্থী দল বনে যায়।
এই শক্ত কাজটি একেবারে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে তৃণমূলের কর্মী পর্যন্ত চলে। তাদের সাংগঠনিক কাজ যখন মানুষের মাঝে দিনে দিনে স্পষ্ট হতে থাকে, তখন আদর্শবিরোধী শক্তিগুলো এই প্রক্রিয়া রুখে দিতে নানান কূটকৌশল তৈরি করা শুরু করে।
আরেকটু পেছনে যাওয়া যাক। এ দেশে পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের বে-ইনসাফি কর্মকাণ্ড, অর্থনৈতিক শোষণ, সামাজিক বৈষম্য দিনে দিনে যখন প্রকট হতে লাগল, তখন এ দেশের মানুষ বিক্ষুব্ধ প্রতিমূর্তি ধারণ করল। কিন্তু এ দেশের মানুষ যে, একটা অপশক্তি থেকে মুক্ত হতে আরেকটা অপশক্তির কবলে পড়ে যাবে, এটা জামায়াতে ইসলামীসহ আরো কয়েকটা দল অনুভব করছিল। তখন দরকার ছিল এক স্বৈরাচারদের বিরুদ্ধে লড়াই করা; কোনো দেশ বা জাতির বিরুদ্ধে নয়। কিন্তু শোষণ ও বৈষম্য থেকে মুক্তির জন্য পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পরিবর্তে কৌশলে পাকিস্তানি জাতির সঙ্গে লড়াইটা মুখোমুখি করা হয়েছিল। আরো পেছনে ফিরে যাই, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের সাথে হেরে যাওয়ার পর ভারতের আঁকা কূটকৌশল বাস্তবায়ন করার জন্য ভারত সরকার তখনকার শোষণবিরোধী যুদ্ধকে জাতিবিরোধী যুদ্ধ হিসেবে পরিচালিত করতে সফল হয়েছিল। এই বিরোধ বা যুদ্ধে জাতি পক্ষে-বিপক্ষে ভাগ হয়ে গেলে এই কূটকৌশলের উদ্দেশ্য ধরে ফেলতে পারায় জামায়াত নৈতিক কারণেই বিপক্ষে চলে যায়। জামায়াত নেতাদের অনুধাবনে তখনই ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু তাদের দৃষ্টিতে তখন থেকেই ইসলামপন্থী জামায়াত নামক সংগঠনটি হয়ে যায় স্বাধীনতাবিরোধী।
জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে মানুষ আজ মর্মে মর্মে অনুভব করছে, মতলববাজ ভারতের সেই অসৎ উদ্দেশ্যের কথা। কেন বাংলাদেশকে স্বাধীন হতে নিজস্ব সৈনিকদের প্রাণ দিয়ে সহযোগিতা করেছিল।
আজ তারা আমাদের স্বাধীনতার সহযোগীর রূপকে কাজে লাগিয়ে জাতির ভেতর তৈরি করেছে আরেক স্বেচ্ছাচারী গোষ্ঠী। তথাকথিত বন্ধু সেজে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিপক্ষ দেখিয়ে দেশের অভ্যন্তরে তৈরি করে স্বৈরাচার। স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির ধোয়া তুলে, সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি আদর্শিক সংগঠনকে তছনছ করার মধ্য দিয়ে, আমাদের জাতির আবেগের জায়গায়, লাখো দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধার শহীদি অনুভূতিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির অজুহাত তুলে সৃষ্টি করেছিল স্বৈরাচার। একটি পাকিস্তানি স্বৈরাচার থেকে মুক্তি পেতে স্বাধীন দেশে সময়ের ব্যবধানে তৈরি করা হলো নিজেদের আজ্ঞাবাহী আরেক স্বৈরাচার। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে প্রথম টার্গেট করা হয় জামায়াতকে।
গতিশীল জনসংগঠন জামায়াতের প্রথমে নিবন্ধন বাতিল করা হলো। গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক অধিকার হরণ করা হলো। কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক সব কার্যালয় বন্ধ করা হলো। তাদের কর্মী সমাবেশসহ যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হলো। গোপনে কোনো আলোচনা সভা করা হলেও ভারত নিয়ন্ত্রিত এ দেশের পুলিশ প্রশাসনকে নিকৃষ্টভাবে ব্যবহার করে নেতাকর্মীদের মামলা, রিমান্ড প্রভৃতি দিয়ে অমানুষিক কায়দায় অকথ্য নির্যাতন শুরু হয়ে গেল। সবচেয়ে লজ্জাকর ও হৃদয়বিদারক ঘটনা হলো মহিলা জামায়াতের নেতাকর্মী বা সমর্থক যা-ই বলা হোক না কেন কোনো আলোচনা সভায় মিলিত হলেই তৃণমূলের সৃষ্টি করা ‘র’-এর এজেন্টরা মুহূর্তে খবর পৌঁছে দিত। এরই ধারাবাহিকতায় অনেক বয়সী পর্দানশীল ও ধার্মিক নারীকে দলে দলে গ্রেফতার করে মামলা দিয়ে জেল খাটানো হতো, দমিয়ে দেয়ার জন্য। যেন নিজ সংগঠনের প্রতি তাদের মনোবল ভেঙে যায়।
জামায়াতকে প্রতিরোধ করতে দলের নেতাকর্মীদের ভারত ও আওয়ামী লীগের সম্মিলিত শক্তি নাশকতার অভিযোগ তুলে বিভিন্ন মামলায় হয়রানি করত। তারা পুলিশ, আইন-আদালতকে প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার শুরু করল। দিন যতই যেতে থাকে, ততই নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে নির্বাচনে বারবার নির্বাচিত হয়ে বিরোধীদের অত্যাচারে নিজেদের নিয়োজিত রাখল। তারই পরিকল্পিত অংশ হিসেবে সৃষ্টি করা হলো যুদ্ধ অপরাধ মামলা।
কোনো দেশে যুদ্ধ অপরাধ করে সাধারণত সামরিক অফিসাররা। এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে অপরাধী হিসেবে আটক ১৯৭ জন পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তা ও সৈনিকদের বন্দিমুক্তি বিনিময়ের শর্তে মুক্ত করা হয়েছিল। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিপক্ষের সবাইকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন।
দুর্বল হলেও গণতান্ত্রিক উপায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল দেশ। কিন্তু থেমে যায়নি ভারতীয় ষড়যন্ত্র। হাসিনাকে ক্ষমতায় আনার পর তারই অংশ হিসেবে যুদ্ধাপরাধে সংশ্লিষ্ট না হয়েও জামায়াত নেতাদের নামে অযৌক্তিকভাবে যুদ্ধাপরাধী মামলা করা হয়। এটা যখন আন্তর্জাতিক মানে যুতসই হচ্ছিল না, তখন এটাকে পরিবর্তন করে তৈরি করা হলো মানবতাবিরোধী অপরাধ। তাদের ছলনা বা কূটকৌশল আর শেষ হয় না।
হাসিনা ক্ষমতায় থেকে পুলিশ-আদালতকে ব্যবহার করে মামলার জাল বুনতে লাগল। নিজেদের লোকদের দিয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে, জামায়াতের নেতাদের গ্রেফতার করা হলো। ভারত তার এ দেশীয় চিহ্নিত দোসরদের দিয়ে গণ-আদালত গঠন করল। গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে শাহবাগ দখল করে ‘র’ সমর্থিত একদল মানুষের দ্বারা আন্দোলন তৈরি করানো হলো। এই খেলাটা যেন এমনই ছিল যে, এটা গণমানুষের দাবি। বিশ্ববাসীকে দেখানোর জন্য। ভারত ও তাদের এদেশীয় দোসররা ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে জামায়াত নেতাদের মামলাকে বেগবান করল। একপর্যায়ে যখন প্রশাসনের প্রত্যেকটি শাখা-উপশাখা শক্তভাবে আওয়ামী লীগ তথা ভারত মনোনীত ব্যক্তিদের হাতে, তখন সারা পৃথিবীর মানুষের মানবিক দাবিকে উপেক্ষা করে আন্তর্জাতিক আদালতের নামে জামায়াতের থিংকট্যাংক কেন্দ্রীয় শক্তি মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আব্দুল কাদের মোল্লা, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও মীর কাসেম আলীকে একে একে বিতর্কিত আদালতের রায়ের মাধ্যমে ফাঁসির রায় দেয়া হলো। আমেরিকা, তুরস্ক, জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুরোধ উপেক্ষা করে একের পর এক তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হলো।
দেশের মানুষের ভেতরে শোকের মাতম শুরু হলো। তাদের অবৈধ ক্ষমতার দৌরাত্ম্য এতটাই প্রবল ছিল যে, জুডিশিয়াল এই হত্যাকাণ্ডের শিকার এ জাতীয় ব্যক্তিত্বদের কবরস্থ করার জন্য মানুষকে একত্রিত হতে বাধা প্রদান করা হয়েছিল। পুলিশ বাহিনীর ভেতরে লুকিয়ে রাখা তাদের এজেন্টের সদা তৎপর রাখা হতো। বেদনাভরা মনে এই দলের নেতাকর্মীসহ এ দেশের মানুষের হৃদয়ের বাঁধভাঙা কান্না বলে দিয়েছিল লাখো জনতাকে- তারা কাকে হারাল। হায়রে বিষাদ! হায়রে কান্না!
ভারতীয় অপশক্তি ভেবেছিল এ দেশে তাদের আধিপত্য চিরদিন থাকবে। কারণ পুলিশ, সেনাবাহিনী, অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবাই তো তাদের লোক দিয়ে সাজানো। অতএব তাদের এই ক্ষমতা থেকে কে সরাবে? বিরোধী দল জামায়াত-বিএনপিকে অবৈধভাবে আইনি কায়দায় বিপর্যস্ত করে একেবারে দুর্বল করা হয়েছে। দেশে এমন কোনো শক্তি নেই যে, তারা এই শক্ত স্বৈরাচারকে অপসারণ করতে পারে। কিন্তু প্রধান নেতৃত্বকে হারিয়ে দমে যাননি জামায়াতের আদর্শিক কর্মীরা। লড়াকু সৈনিকদের নেতারা নির্যাতিত হয়েছেন। অনেকে আত্মগোপনে গেছেন বাধ্য হয়ে। সরকারের কৌশলী প্রক্রিয়াকে ব্যর্থ করে দিতে আরেক কৌশল হিসেবে ডা: শফিকুর রহমানের মতো নেতা কৌশল বদলালেও শত হুমকিতেও মাঠ ছেড়ে চলে যাননি। নাম না-জানা হাজার হাজার কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক নেতাকে সইতে হয়েছে স্বৈরাচারের সৃষ্টি করা সঙ্কটকালীন কষ্ট।
দেশের কল্যাণে অগ্রসরমান জামায়াতের লক্ষ্য কী? ঘুষ খাবে না, দুর্নীতি করবে না, খুন-হত্যা-অপহরণ করবে না; বরং সমাজ থেকে এসব উৎখাতে মানুষকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সঞ্চালন করবে দেশ বিনির্মাণের অভিপ্রায়ে। এটাই জামায়াতের অপরাধ! কেন তারা তাদের নেতৃত্বে আদর্শিক চিন্তায় পথ চলে রাজনৈতিক সাফল্যে ভাগ বসাবে? তারা দুর্নীতি করবে, স্বজনপ্রীতি করবে, রাষ্ট্রীয় পদগুলো দখল করে একাত্তরের চেতনার নামে স্বৈরতন্ত্র বাস্তবায়ন করবে। অর্থাৎ ভারত তার দুরভিসন্ধি অংশীদারি বাস্তবায়ন করবে। সবই করবে এ দেশের মানুষের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ত্যাগকে কৌশলে ব্যবহার করে। তাদের এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে কেউ, কোনো দল বাধা দিলেই হয়ে যায় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি রাজাকার। এভাবেই এই স্বাধীনতার চেতনাকে অপব্যবহার করে ১৬ বছরের স্বৈরশাসন চলছিল, যা ছাত্র-জনতার সম্মিলিত শক্তি ব্যর্থ করে দিলো। সব ষড়যন্ত্র ভেস্তে গেল, ছাত্র-জনতার রক্তে রঞ্জিত হলো নতুন বাংলাদেশ।
পৃথিবীর দেশে দেশে অনেক স্বৈরাচার এখনো বর্তমান। কম্বোডিয়ার হুনসেন, মিসরের সিসিসহ অনেক স্বৈরাচার যুগে যুগে টিকে আছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। হয়তো আল্লাহ দেশের মানুষের দোয়া কবুল করেছেন। উৎখাত করতে শক্তি দিয়েছেন নতুন বাংলাদেশের মানুষকে। এই অপশক্তিগুলো ক্ষমতা থেকে দূরীভূত হয়েছে কিন্তু একেবারে শেষ হয়নি। সদা সতর্ক চোখ রাখতে হবে ছাত্র-জনতাকে, যেকোনো সময় ওদের লুক্কায়িত বাহিনী বাংলার পথেঘাটে স্থাপনায় নাশকতা চালিয়ে বিব্রত করতে পারে জাতিকে। এ জন্য সদা সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে।
লেখক : সাংবাদিক