ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পলাতক ছিলেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব রুহুল আমিন। গতকাল তার ফিরে আসাকে কেন্দ্র করে মুসল্লিদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে মসজিদটিতে। দু’পক্ষের সংঘর্ষে মসজিদের ভেতরে রণক্ষেত্র তৈরি হয়। এ সময় একে অপরের ওপর জুতা এবং জুতার বাক্স ছুড়ে মারেন তারা। করা হয় ভাঙচুর। এ ঘটনায় বেশ কয়েকজন মুসল্লি আহত হয়েছেন। তবে শেখ হাসিনা সরকার পতনের দেড় মাস অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত কেন নতুন খতিব নিয়োগ দেয়া হয়নি, এনিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন উঠেছে।
গতকাল সকাল ১১টার দিকেই আনাগোনা বাড়তে থাকে মসজিদ প্রাঙ্গণে। প্রায় দুই শতাধিক ‘মাদ্রাসা শিক্ষার্থী’ মসজিদের দুই গেটে অবস্থান নেন। মসজিদের একাধিক মুসল্লি জানতে চাইলে তারা বলেন, গোপালগঞ্জ থেকে এসেছেন। মুসল্লিরা জানান, এ সময় ১২টা ১৫ মিনিটের দিকে রুহুল আমিনকে মসজিদের উত্তর গেটে দেখা যায়। তিনি খতিবের পোশাক পরিহিত অবস্থায় ছিলেন। এরপর তাকে আর আর দেখা যায়নি। এরপর মসজিদের মেহরাবে বয়ান দিচ্ছিলেন নামাজের দায়িত্ব পাওয়া আবু ছালেহ পাটোয়ারী। বয়ান শুরু হওয়ার পর একদল অনুসারী নিয়ে প্রবেশ করেন খতিব রুহুল আমিন। বসেন সামনের কাতারে। কয়েক মিনিট বসার পর তার অনুসারী একজন বলেন, খতিব যখন এসেছেন তাহলে বয়ানের দায়িত্ব তাকেই দেয়া হোক। একই কথা বলেন আরও অনেকে। শুরু হয় বাকবিতণ্ডা। পূর্বে থেকে অবস্থান নেয়া মুসল্লিরা তাতে না করেন। এরই একপর্যায়ে তিনি মাইক্রোফোন হাতে নেন। বয়ানরত আবু ছালেহ পাটোয়ারীকে মিম্বর থেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে অপদস্ত করা হয়। পরে অন্য দল রুহুল আমিনের অনুসারীদের প্রতিরোধ করেন। তখন স্লোগান দেয়া শুরু হয় নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার। একপর্যায়ে দু’ভাগ হয়ে হাতাহাতি শুরু হয়। জুতা ও জুতা রাখার ট্রে নিয়ে একে অপরের দিকে নিক্ষেপ করতে থাকেন। প্রায় ২০ থেকে ২৫ মিনিট ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় রণক্ষেত্রে রূপ নেয়। এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর আশেপাশের এলাকা থেকে আসতে থাকেন নানা বয়সী মানুষ। লোকজন বৃদ্ধি পাওয়ায় কোণঠাসা হয়ে পড়েন রুহুল আমিনের অনুসারীরা। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মাঝে উত্তর গেট দিয়ে অনুসারীদের নিয়ে বেরিয়ে আসেন তিনি। এ সময় তাদের উদ্দেশ্য করে আওয়ামীবিরোধী নানা স্লোগান দেয়া হয়। এরইমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেন। মুসল্লিরা বলেন, রুহুল আমিনের সঙ্গে আসা একদল যুবক শুধুমাত্র ভাঙচুরে লিপ্ত ছিলেন। তারা কাঁচ, আসবাবপত্র এগুলো ভাঙচুর করেন।
পরিস্থিতি শান্ত হলে অধিকাংশ মুসল্লি নামাজ না পরে বেরিয়ে অন্যান্য মসজিদে যান। আর সেখানে থাকা মুসল্লিরা নামাজের স্থানটি পরিষ্কার করেন। সুন্নত নামাজের জন্য স্বল্প সময় দিয়ে ১টা ১০ মিনিটের দিকে আজান দেন। জানা যায় এই আজান সাধারণ ১টা ২০ মিনিটের দিকে হয়ে থাকে। এরপর নামাজ আদায় হয় এবং খুব পরিপাটিভাবেই মোনাজাত আদায় করেন। আসরের নামাজের সময় সেখানে দেখা যায় পরিবেশ শান্ত। চারিদিকে ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র।
রুহুল আমিনকে ২০২২ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার খতিব হিসেবে নিয়োগ দেয়। গোপালগঞ্জে বাড়ি হওয়ায় তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ রয়েছে। আসরের নামাজে আসা হেফাজতে ইসলামের কর্মী মো. আবু জাফর বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে এতটাই নিকৃষ্টভাবে পরিচালিত হয়েছে যে, খতিব পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতি করা লোককে দেয়া হয়েছে। আমাদের এই ১৫ বছরে অত্যাচার করা হয়েছে। এখনো আওয়ামী জাহিলিয়ার দোসররা ঘুরে বেরাচ্ছে ও চক্রান্ত করছে। জাতীয় মসজিদে এই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়ে তারা বিশ্বের কাছে নেগেটিভ মেসেজ দিতে চায়।
এ প্রসঙ্গে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বলছে, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব একটা সম্মানিত পদ। এই পদটাকে কেউ অসম্মানিত করতে চায়নি। এজন্য সবাই চাচ্ছিলেন যে, রুহুল আমিন নিজেই পদত্যাগ করুন। কিন্তু তিনি পদত্যাগ না করে শুক্রবার তার অনুসারীদের নিয়ে মসজিদে এসে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দিলেন। সূত্রটি জানায়, দুই জুমার নামাজ অনুপস্থিত থাকায় রুহুল আমিনকে লিখিতভাবে শোকজ করা হয়েছিল। শোকজের জবাবও দিয়েছিলেন তিনি। সেখানে রুহুল আমিন অসুস্থতার কারণ দেখিয়েছেন। আর খতিবের অনুপস্থিতিতে ইমাম এবং ফাউন্ডেশনের মুহাদ্দিস পদে থাকা দু’জন কর্মকর্তাসহ মোট চারজনকে বাই রোটেশন জুমার নামাজ পড়ানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। গতকাল যিনি জুমা পড়িয়েছেন তিনি ফাউন্ডেশনের অন্যতম মুহাদ্দিস আবু ছালেহ পাটোয়ারী।
একজন মুসল্লি বলেন, সাবেক খতিব অন্যায়ভাবে শেখ হাসিনাকে সাপোর্ট করে এসেছিলেন। যখন হাসিনার পতন হয়, তখন তিনি পালিয়ে যান। কিন্তু হঠাৎ কোন সাহসে বা কী কারণে তিনি এখানে এসেছেন তা খতিয়ে দেখতে হবে। আমার ধারণা তিনি পরিবেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য এখানে এসেছেন। এই সংঘর্ষে অনেক লোক আহত হয়েছেন। রক্তাক্ত হয়েছেন। পরে রুহুল আমিন আর নামাজ পড়াতে পারেননি। আর এখান থেকে যেহেতু রুহুল আমিন পালিয়ে গেছেন, তাহলে তিনি কেন এলেন? শেখ হাসিনার দোসররা সব সেক্টর থেকে পালিয়ে গেছে। কিন্তু তারা পাল্টা বিপ্লব করার চেষ্টা করছেন। এটাও তেমন। তারা এখানে আরেকটি বিপ্লব করার জন্য এসেছেন। তারা আগেভাগে একটা সেটআপ করে রেখেছেন, আজকে একটা বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে। আর সাধারণ মানুষ তাদের আবার বিতাড়িত করে দিয়েছেন।
এসব ঘটনার সময়কার কিছু ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেখানে দেখা যায়, যখন মসজিদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, তখন মাইকে ঘোষণা দিয়ে সবাইকে বসতে বলা হয়। মসজিদের আদব রক্ষা করতে বলা হয়। কিন্তু উত্তেজিত মুসল্লিদের বসানো যাচ্ছিল না। মাইকে বলা হয়, সবাই বসুন। দরুদ শরীফ পড়ুন। আল্লাহর ঘর মসজিদ। আমরা সবাই শান্তি-শৃঙ্খলার সঙ্গে বসে যাই। মসজিদের সম্মান রক্ষা করি। মাইকে যখন এসব কথা বলা হচ্ছিল, তখন ভাঙচুরের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। এরপরও মাইকে সবাইকে অনবরত শান্ত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু কাউকে বসানো যাচ্ছিল না। পরে পরিবেশ কিছুটা ঠাণ্ডা হলে সাধারণ মুসল্লিরা মসজিদে প্রবেশ করেন। পরে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। নামাজ পড়ান আবু ছালেহ পাটোয়ারী। নামাজ শেষে সাধারণ মুসল্লিরা বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। এর কিছু পরেই মসজিদ থেকে স্লোগান দিতে দিতে একদল মুসল্লি বের হন।
ওদিকে ঘটনার পর সেখানে পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়। খবর পেয়ে মসজিদে যান সেনাবাহিনীর সদস্যরাও। এরপর পরিবেশ কিছুটা শান্ত হয়। তখন জুমার নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। নামাজের পর সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে মুসল্লিদের দ্রুত মসজিদ থেকে বের হয়ে যেতে বলা হয়।
ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মু. আ. হামিদ জমাদ্দার মানবজমিনকে বলেন, খতিব ছুটিতে ছিলেন। আজকের (শুক্রবার) ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত। এ বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিবো।