উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে কোনো প্রকল্পের চুক্তি করা হলে একদিকে যেমন ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হয়, অপরদিকে লুটপাটের সুযোগ কম থাকে। বরং থাকে দায়বদ্ধতা। কিন্তু শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোনো ন্যায্যতা ছিল না। উপরন্তু সরকার সমর্থিত কিছু ব্যবসায়ী ও ব্যক্তিকে এ খাত থেকে লুটপাটের সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল। আর এ সব দুর্নীতি আড়াল করতে করা হয় দায়মুক্তি আইন। এ আইনের আওতায় বিনা টেন্ডারে শতাধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের লাইসেন্স পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খুব ঘনিষ্ঠ লোকদের দেয়া হয়। উচ্চ মূল্যের এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর অর্ধেকই কোনো কাজে না আসলেও দেশ ও জনগণের ঘাড়ে চাপানো হয়েছে ঋণের বোঝা। জনগণের পকেট থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা বের করে নেয়া হয়েছে বিদ্যুতের বাড়তি মূল্য পরিশোধের জন্য। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দেশ বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে। এসব ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা না থাকায় নতুন করে ঋণ নিয়ে পুরনো ঋণ পরিশোধ করা হচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) গবেষণা পরিচালন খন্দকার গোলাম মেয়াজ্জেম এ বিষয়ে গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বিনা টেন্ডারে শতাধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের লাইসন্সে দেয়া হয়েছিল দায়মুক্তি আইনের মাধ্যমে। এ আইন করা হয়েছিল, বিদ্যুৎ খাতে বিনা টেন্ডারে যেসব কেন্দ্রের অনুমতি দেয়া হবে সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। এতে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার সমর্থিত কিছু মানুষ বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন। এ আইনের আওতায় সরকার ও দেশের জনগণের বিপুল ক্ষতিসাধন হয়েছে। দেশ তথা জনগণের ঘাড়ে বাড়তি দেনা চেপেছে। নতুন ঋণ নিয়ে পুরনো ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। ঋণের দুষ্ট চক্রে আটকে গেছে সরকার। তিনি মনে করেন, বিদ্যুৎ খাতের লুটপাট বন্ধে দায়মুক্তি আইন বাতিল করতে হবে। এ আইনের আওতায় যতগুলো চুক্তি হয়েছে তা পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। যেসব ধারা দেশ ও জনগণের বিপেক্ষ রয়েছে সেগুলো বাতিল করতে হবে। আর এ আইনের আওতায় যেসব প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে সেগুলো আর নবায়ন করা যাবে না। তিনি বলেন, সামনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত নিয়ে যতগুলো চুক্তি হবে তা উম্মুক্ত প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে করতে হবে, যাতে কেউ কোনো প্রশ্ন করতে না পারে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শেখ হাসিনা সরকারের টানা তিন মেয়াদে ৮২টি আইপিপি (ইনডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) এবং ৩২টি কুউক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেয়া হয় বিনা টেন্ডারের মাধ্যমে। অর্থাৎ সরকার সমর্থক ব্যবসায়ী ও ব্যক্তিদের ডেকে ডেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয়। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো স্থাপনের প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে কয়েকগুণ ব্যয় বাড়িয়ে দেখানো হয়। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এ অর্থ আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তি থেকে মন্ত্রী, আমলার পকেটে গেছে। এ খাতের ব্যয় তোলার জন্য দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। বাড়তি মূল্য পরিশোধে সাধারণের নাভিশ্বাস উঠে যায়। শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। এতে বেড়ে যায় মূল্য স্ফীতি। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র এমনভাবে সাজানো হয়, যাতে কেউ মুখ খুলতে না পারে। মুখ খুললেই খুন, গুমের শিকার হতে হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এ খাত সংশ্লিষ্ট দুই মেধাবী সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের বিচার আজও হয়নি। এদিকে, দেশের যে পরিমাণ বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে তার চেয়ে দ্বিগুন উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। দেশে গড়ে ১২ হাজার থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়।
কিন্তু উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে ২৭ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত। বাড়তি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে কোনো বিদ্যুৎ নেয়া হচ্ছে না। অথচ চুক্তি অনুযায়ী বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়। অপরদিকে বিদ্যুৎ ক্ষমতা দ্বিগুন করা হলেও লোডশেডিং থেকে মুক্তি মেলেনি দেশবাসীর। অথচ সবার জন্য সরবরাহ নিশ্চিত না করে শতভাগ বিদ্যুতায়নের কৃতিত্ব জাহির করা হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা নিজেই বিদ্যুৎ মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। লুটপাটের সহযোগিতা করেছেন তারই প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, যিনি আগে ভ’মি দস্যু ছিলেন। গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর তার সাথে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও লুটপাটের সহযোগীরা পালাতক রয়েছেন। অনেকেই আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে বিদ্যুৎ খাতে মোট ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৮৩০ কোটি ডলার। বর্তমান বিনিময় হার বিবেচনায় (১ ডলার সমান ১১৮ টাকা) বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে আন্তবর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান মন্ত্রণালয়ের প্রথম কার্যদিবসেই বলেন, বর্তমান সরকার একটি দৃঢ় ম্যান্ডেট নিয়ে এসেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) ২০১০ (সংশোধিত ২০২১) আইন বাতিল করা হবে। এ আইনের আওতায় নতুন করে আর কোনো চুক্তি করা হবে না। অপরদিকে এ আইনের আওতায় যেসব চুক্তি করা হয়েছে তা পূনর্মূল্যায়ন করা হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধিত) আইন, ২০২৩-এর ধারা সরকার কর্তৃক বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা স্থগিত করা হবে। ইতোমধ্যে যা স্থগিত করা হয়েছে।