আদতে কিছুই করছে না পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। একের পর এক নিয়োগ পরীক্ষা পিছিয়েই যাচ্ছে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানে। ফলে দেখা দিচ্ছে জটের। নিয়োগের অপেক্ষায় থাকা প্রার্থীরা হতাশার মধ্যদিয়ে দিন পার করছেন। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রায় সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তন এসেছে। পিএসসি বহাল থাকলেও প্রতিষ্ঠানের কোনো কাজ হচ্ছে না।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মো. সোহরাব হোসাইন বর্তমানে পিএসসি’র চেয়ারম্যান। সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এস. এম. গোলাম ফারুক, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহম্মদ। অন্য সদস্যরা হলেন, নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) জাহিদুর রশিদ, ঢাবির আওয়ামী লীগপন্থি শিক্ষক অধ্যাপক ড. মুবিনা খোন্দকার, কে এম আলী আজম ছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, মো. খলিলুর রহমান ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সাবেক সচিব, মো. মাকছুদুর রহমান পাটওয়ারী সাবেক ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সাবেক সচিব হেলালুদ্দিন আহমদ, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করা ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম, আরেক সদস্য অধ্যাপক ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
সরকার পতনের পর থেকে এই কমিশন কোনো কাজই করছে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও একের পর এক নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করা হচ্ছে। আগে শুরু হওয়া পরীক্ষাও আর চালু করা হচ্ছে না। এমনকি বিসিএস’র ভাইভা পরীক্ষার তারিখও দেয়া হচ্ছে না। সর্বশেষ গতকালও দুটি পরীক্ষা স্থগিত করে পিএসসি। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস ক্যাডারভুক্ত ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের ১ম অর্ধবার্ষিকী বিভাগীয় পরীক্ষা, জুন-২০২৪ এবং জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পদের ব্যবহারিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। অনিবার্য কারণ দেখিয়ে এই পরীক্ষা স্থগিত করা হয় বলে জানায় পিএসসি। পিএসসি’র দিকে তাকিয়ে থাকে দেশের লাখো তরুণ। এখনো ঝুলে আছে কয়েকটি বিসিএস’র নিয়োগ কার্যক্রম।
গত ২৮শে আগস্ট থেকে ৪৬তম বিসিএস’র লিখিত পরীক্ষা শুরু হবার কথা ছিল। দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় স্থগিত করা হয় এই পরীক্ষা।প্রিলিমিনিয়ারিতে পাস করা প্রার্থীরা অপেক্ষায় দিননিপাত করছেন। এ বিসিএস’এ নেয়া হবে ৩ হাজার ১৪০ জনকে। এরমধ্যে সহকারী সার্জন ১ হাজার ৬৮২ জন ও সহকারী ডেন্টাল সার্জনের ১৬টি পদ রয়েছে। আর ৫২০ জনকে নেয়া হবে শিক্ষা ক্যাডারে।
৪৫তম বিসিএস’র লিখিত পরীক্ষার খাতা দেখার কাজ শেষ হয়নি। ৪৪তম বিসিএস’র মৌখিক পরীক্ষা শুরু হলেও পরিস্থিতির কারণে মাঝে স্থগিত করা হয়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও এখনো পরীক্ষা নেয়ার তারিখ ঘোষণা করা হয়নি। এই বিসিএস-এ ১ হাজার ৭১০ জন কর্মকর্তা চাকরির সুযোগ পাবেন। এসব পরীক্ষার জটের কারণে ৪৭তম বিসিএস’র সার্কুলার কবে হবে এ নিয়ে কোনো আলোচনাই নেই পিএসসিতে।
চাকরিপ্রত্যাশী আবিদ হোসেন বলেন, ৩২ মাস হলো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বসে আছি। পরীক্ষার একটা চাপতো মাথায় থাকেই। এখন একটা চাকরি করছি। না ঠিকভাবে চাকরি করতে পারছি, না ঠিকমতো জীবনযাপন করতে পারছি। চাকরিপ্রত্যাশী স্বর্ণা দাস বলেন, সামাজিকভাবে একটা হেয়প্রতিপন্ন হতে হচ্ছে। অনেকেই তো ভেবেই নিয়েছে বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে মিথ্যা কথা বলেছি। ভাইবা না হওয়ায় একটা চাপ সবসময় থেকেই যাচ্ছে। আর কতোদিন বইখাতা নিয়ে ব্যস্ত থাকা যায়। তিনি অতিদ্রুত ভাইভা শেষ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এরপর তো আবার পুলিশ ভেরিফিকেশন আছে। পদায়ন হতে আরও এক থেকে দুই বছর। তারা দু’জনই ৪৪তম বিসিএস পরীক্ষার আবেদনকারী। এর আবেদন প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০২২ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে। সে বছরের ২৭শে মে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়।
৪৫ ও ৪৬তম বিসিএস চাকরিপ্রত্যাশী আশিকুর রহমান বলেন, আমি কী করবো কোথায় যাবো। দুটো পরীক্ষার একটার তো ফল দেবে। এখন তো পরিস্থিতি স্বাভাবিক এখন কেন কালক্ষেপণ করা হচ্ছে? তিনি বলেন, এখন আমি একটি বেসরকারি মেডিসিন কোম্পানিতে চাকরি করছি। না আমি আমার ক্যারিয়ার গোল সেট করতে পারছি, না আমি বিসিএস নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারছি।
পিএসসি’তে এখন পর্যন্ত আটকে আছে অন্তত ২১টি নিয়োগ পরীক্ষা। শুধু তাই নয় ৪১ থেকে ৪৩ বিসিএস’র নন-ক্যাডারপ্রার্থীরা দীর্ঘদিন ধরেই পদায়নের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছেন। পিএসসি’র অধীনে অনুষ্ঠিত বিসিএস প্রিলিমিনারি, লিখিতসহ গত ১২ বছরে গুরুত্বপূর্ণ ৩০টি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করেছে কয়েকটি চক্র বলে সংবাদ প্রচারিত হয়। একই সময়ে অনুষ্ঠিত পরীক্ষাগুলো বাতিলের দাবি তুলে আন্দোলনও করেন তারা।
কেন এই ধীরগতি? জানতে চাইলে পিএসসি’র একজন সদস্য বলেন, ব্যাপক পরিবর্তনের মুখে আমরা প্রায় সকলেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু কোনো সংকেত না মেলায় চুপ হয়ে আছি। আমরা কী ভবিষ্যতে দায়িত্বে থাকবো নাকি আমাদের সরিয়ে দেয়া হবে সেই তথ্যটাও আমাদের কাছে নেই। তিনি আরও বলেন, আমাদের এই মুহূর্তে বিভিন্ন কারণে পরীক্ষাগ্রহণের মতো লজিস্টিক সার্পোট অনেক ক্ষেত্রে ইচ্ছাটাও নাই। আমরা চাই গ্রিনসিগন্যাল।
অন্য আরেক সদস্য বলেন, আমরা পদত্যাগপত্র স্বাক্ষর করে রেখেছি। সিদ্ধান্ত যদি আসে সরে যাবো। আর যদি কাজ করতে বলা হয় নতুন করে নতুন পরিস্থিতিতে শুরু করবো।
জানা যায়, সরকার পতনের পর চেয়ারম্যান ও চার থেকে পাঁচজন সদস্য অফিস করছেন তাও অনিয়মিত। বাকিরা একেবারেই অনুপস্থিত। চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেনের দায়িত্বভার নেবার চার বছর পূর্ণ হবে আগামী ২১শে সেপ্টেম্বর। এজন্য তিনি সংক্ষিপ্ত সময়ে নতুন করে কোনো দায়িত্ব নিতে চাইছেন না। চেয়ারম্যানের অপসারণ ও পিএসসি পুনর্গঠনের দাবিতে মানববন্ধনও করেছেন শিক্ষার্থীরা। গত ১২ই সেপ্টেম্বর রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে তারা মানববন্ধন করেন। তখন তারা ‘দফা এক দাবি এক, সোহরাবের পদত্যাগ’সহ নানা স্ল্লোগান দেন। এ সময় জাতীয় নাগরিক ঐক্য কমিটির সদস্য সচিব আকতার হোসেনসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ক উপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী বলেন, এটা তো দুর্নীতির কারখানা। প্রত্যেকটা পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। পিএসসি বিলুপ্ত করে নতুন করে গঠন করা উচিত।