দুই সপ্তাহ ধরে চলা তৈরি পোশাক শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অস্থিরতার পর শ্রমিকরা বৃষ্টি উপেক্ষা করে কাজে যোগ দিয়েছেন। গতকাল এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন তৈরি পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএ এবং শিল্প পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
শিল্প পুলিশ জানায়, গতকাল সকালে নির্ধারিত সময়ে কাজে যোগ দিয়েছেন বিভিন্ন শিল্প-কারখানার শ্রমিকরা।
তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করছেন। তবে আজও শ্রম আইন অনুযায়ী ১৮টি কারখানা বন্ধ আছে এবং সাধারণ ছুটি আছে দুটি কারখানায়। এর মধ্যে ওষুধ ও চামড়াজাত পণ্য প্রস্তুতসহ বিভিন্ন ধরনের কারখানা আছে। তবে বেশির ভাগই তৈরি পোশাক কারখানা।
বিজিএমইএ পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল কালের কণ্ঠকে বলেন, আশুলিয়ায় ছয়টি কারখানা ১৩/১ (কাজ নেই, মজুরি নেই) ধারায় বন্ধ ছিল। সাধারণ ছুটি ছিল চারটিতে এবং ছয়টি আগে থেকেই বন্ধ ছিল। তবে তিন-চারটি কারখানায় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে পরে কাজ যোগ দেন শ্রমিকরা। সার্বিকভাবে পোশাক শিল্পাঞ্চলের পরিবেশ গতকাল ছিল স্বাভাবিক।
এদিকে চলমান শ্রম অসন্তোষ কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয় বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান অনন্ত গার্মেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইনামুল হক খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এমন অভিনব আন্দোলন গত ৩৩ বছরেও দেখিনি। কারখানায় এসে হাজিরা দিয়ে কাজ না করে বসে থাকে। আবার হাজিরা দিয়ে বাইরে চলে যায়। দাবি মানলে নতুন নতুন দাবি নিয়ে হাজির হয়।
’
এশিয়ান গ্রুপের পরিচালক বেলায়েত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য যাঁরা বেকায়দায় পড়েছেন, তাঁরাই এই আন্দোলনের হোতা। তাঁরা অনেকটা নিজের ঘরে নিজে আগুন লাগিয়ে অসন্তোষ তৈরি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চেয়েছেন।’
অন্যদিকে শ্রমিক নেতারা বলেন, স্বাধীনভাবে কথা বলতে না পারা, কারখানা মালিক ও মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের অশালীন ব্যবহারে শ্রমিকরা এত দিন ছিলেন ক্ষুব্ধ। এর ফলে সরকারের পালাবদল আর ৫ আগস্টের চেতনা বদলে দিয়েছে শ্রমিকদের। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য যাঁরা বেকায়দায় পড়েছেন, তাঁরা এই ঘটনার আড়ালে ছিলেন।
সরেজমিন জানা যায়, এবারের আন্দোলনে শ্রমিকরা হাজিরা বোনাস এবং টিফিন বিল নিয়ে আন্দোলন করলেও প্রধান দাবি ছিল কারখানার মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের অপসারণ। প্রথমদিকে মালিকরা এসব দাবিকে আমলে না নিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং চাকরিচ্যুত করার হুমকি দেন। ফলে শ্রমিকরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দাবি আদায়ে আন্দোলন করতে থাকেন।
শ্রমিক নেতা বাবুল আখতার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মধ্যম সারির কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন শ্রমিকদের ওপর একটি গ্যাংয়ের মতো আচরণ করেছেন। ফলে তাঁদের অপসারণের দাবি ওঠে। এ ছাড়া প্রথম দিকে শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে মালিকদের গাফিলতি ছিল। তাঁরা আলোচনা না করে ভয়ভীতি দেখিয়ে শ্রমিকদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। এর ফলে আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়া হয়েছিল।’
গাজীপুরে ৯৫ শতাংশ পোশাক কারখানা চলছে
কালের কণ্ঠ’র আঞ্চলিক প্রতিনিধি, গাজীপুর জানান, টঙ্গী বিসিকসহ শিল্পাঞ্চলের ৯৫ শতাংশ কারখানায় কাজ চলেছে। কোথাও আন্দোলনের খবর পাওয়া যায়নি। গতকাল বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোঁজ নিয়ে এই তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশন, গাজীপুর মহানগর কমিটির সভাপতি শফিউল আলম বলেন, ‘এখন শিল্পাঞ্চলে স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে।’
জেনফার বাংলাদেশ লিমিটেড ওষুধ কারখানার চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান বলেন, ‘কারখানা চালু রয়েছে। কোনো সমস্যা নেই।’
গাজীপুর শিল্প পুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘৯৫ শতাংশ কারখানায় কাজ চলছে। কোথাও শ্রমিক আন্দোলন নেই।’
শ্রম পর্যবেক্ষণ কমিটি আশুলিয়ায়
শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি কারখানা পরিদর্শন করেছেন শ্রমসংক্রান্ত অভিযোগ পর্যবেক্ষণ কমিটি। এ সময় কমিটির সদস্যরা কারখানার মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রাথমিক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
পর্যবেক্ষণ কমিটির নেতৃত্বে থাকা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সবুর হোসেন বলেন, ‘আশা করছি পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কোনো দাবিতে সড়ক ও কাজ বন্ধ করার কোনো প্রয়োজন নেই। শ্রমসংক্রান্ত অভিযোগ পর্যবেক্ষণ কমিটির সদস্যরা মালিক-শ্রমিক উভয় পক্ষেরই অভিযোগ শুনে সরকারকে অবহিত করবেন। যেসব দাবি পূরণ করা যায়, তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে।’
https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2024/09/16/1425894