সামরিক ও বেসামরিক সার্ভিস থেকে অনেক শীর্ষ পর্যায়ের ও মধ্যম পর্যায়ের অফিসারদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কাউকে বরখাস্ত করা, কাউকে কাউকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান এবং কাউকে কাউকে বরখাস্ত করে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও ড. ইউনূসের বিপ্লবী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবিপ্লবের ষড়যন্ত্র থামেনি। যখনই যেখানে কোনো দাবি উঠছে সাথে সাথেই সরকার সেই দাবি কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেনে নিয়েছেন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু তারপরেও দেখা যাচ্ছে শিল্পাঞ্চলে ষড়যন্ত্র থেমে নেই। ১৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবারের একশ্রেণীর গণমাধ্যমের রিপোর্ট মোতাবেক আশুলিয়ায় ২১৯ টি শিল্প কারখানা বন্ধ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট অফিসারদের মতে এসবের পেছনে রয়েছে গভীর ষড়যন্ত্র। বিগ বস নামক গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির গুদামে যে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে তার পেছনে রয়েছে বহিরাগত দুষ্কৃতিকারী, ঐ কারখানার শ্রমিকরা নয়। এখন এটি ওপেন সিক্রেট যে, শেখ হাসিনার পতিত স্বৈরাচারের দোসররা ছদ্মবেশে অথবা শ্রমিকদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে দেশে প্রথমে প্রচন্ড অস্থিরতা এবং তারপর সরকারের পতন ঘটাতে চাইছে।
ঐদিকে ভারতের রাজধানী দিল্লীর অনতিদূরে বর্তমানে বসবাসকারী বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী পলাতক শেখ হাসিনা সেখান থেকে বাংলাদেশে অরাজকতা সৃষ্টির জন্য উস্কানি দিচ্ছেন। এমন দুইটি কল রেকর্ডিং দৈনিক কালবেলার ইউটিউব চ্যানেলে সম্প্রচার করা হয়েছে।
১৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার মধ্যাহ্নে সম্প্রচারিত কালবেলার ঐ ইউটিউব ভিডিওতে দেখা যায় যে, শেখ হাসিনা একজন প্রবাসী বাংলাদেশীর সাথে টেলিফোনে কথা বলছেন। তিনি বলছেন, বাংলাদেশের সংবিধানে প্রধান উপদেষ্টার কোনো পদ নাই। সে (ড. ইউনূস) এ পদটি যবর দখল করেছে। তার ক্ষমতা দখলে কোনো লিগ্যালিটি নাই। কারণ উপদেষ্টা বলে কোনো পদ নাই। মানুষ খুন করে একটা সিচ্যুয়েশন তৈরী করে তারা ক্ষমতায় গেল। উদ্দেশ্য ছিল আমাকে মেরে ফেলা। উত্তরে ফোনের অপর প্রান্তে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশী বলেন যে, জি আপা, আমরা এসব বিষয় ইউরোপীয় ইউনিয়নকে জানাবো। শেখ হাসিনা বলেন, আমি তো পদত্যাগ করি নাই। তিনি আরো বলেন, আমাদের কনস্টিটিউশনের আর্টিকেল ৫৭ অনুযায়ী যেভাবে পদত্যাগ করতে হয় আমার কিন্তু সেভাবে পদত্যাগ করা হয়নি। তারপর সে কিন্তু ৬ তারিখের জায়গায় ৫ তারিখে নিয়ে আসলো। আর ৫ তারিখে আনার ফলে চারিদিকে লোক। এমন অবস্থায় সিকিউরিটির লোক যদি ফায়ার ওপেন করে তাহলে শত শত লোকের লাশ পড়বে। এত লাশ ফেলে আমি ক্ষমতায় থাকতে চাই না। কিন্তু তখন একটা সিচ্যুয়েশন হয়ে গেল যে, বাধ্য হয়ে আমাকে সরে যেত হলো গণভবন থেকে। যার ফলে বঙ্গভবনে যেয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে আমি পদত্যাগপত্র জমা দেইনি। কাজেই আমার কিন্তু পদত্যাগ হয়নি। আমি এখনো বাংলাদেশের কনস্টিটিউশনালি ইলেকটেড প্রাইম মিনিস্টার। তিনি বলেন, বেলজিয়ামে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী আছে। তাদের সাথে যোগাযোগ করলে ওরাই তো অনেক তথ্য দিতে পারবে।
তিনি আরো বলেন, যখন মানুষ মারা গেল তখন আমি একটা জুডিশিয়াল কমিশন করলাম এনকুয়ারি করার জন্য। তারপর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি থাকবো না, আমি ছেড়ে দেবো। ৫ তারিখে নেশনকে এ্যাড্রেস করে আমি যাবো রাষ্ট্রপতির কাছে, তার কাছে সাবমিশন করবো। পার্লামেন্টারি সিস্টেমের নিয়ম হচ্ছে যে, আমি যদি রেজিগনেশন সাবমিটও করি, তাহলে মেম্বার অব পার্লামেন্টে অন্য কেউ যদি মেজরিটি পায় তাহলে সে হবে প্রাইম মিনিস্টার। আর সে যদি না পারে তখন প্রেসিডেন্টকে প্রাইম মিনিস্টারের রিকোয়েস্ট করতে হবে যে, পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেন। তাছাড়া পার্লামেন্ট ভাঙতে পারে না। তাই পার্লামেন্ট ভাঙ্গাও কনস্টিটিউশনালি হয়নি। যে কয়জন মার্ডার হয়েছে, তারা পুলিশের গুলীতে কিন্তু হয়নি। ওদের মুভমেন্টের ভেতরেই কিলিং এজেন্ট ছিল।
তিনি আরো বলেন যে, আন্দোলনকারীদের মধ্যে কিছু পুরুষ মানুষ বোরখা পরেছিল। বোরখা পরে নারী সেজে তারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আগুন দিয়েছে।
শেখ হাসিনা এই টেলিফোন সংলাপে বলেন, ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত তো আর্মির লোক। তিনি বলেছেন, যে বুলেট দিয়ে লোক মারা হয়েছে সেগুলো তো পুলিশ ব্যবহার করে না। শেখ হাসিনা অভিযোগ করেন যে, গ্রামীণ ব্যাংকের ২৬ হাজার কোটি টাকা মানি লন্ডারিং করে ইউনূস সাহেব বিদেশে পাঠিয়েছেন। তিনি পুনর্বার জোর দিয়ে বলেন যে, আমি কিন্তু রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র দেইনি। উনি কিন্তু দেখাচ্ছে আমি সই করছি। সেটা কিন্তু ভিজিটং বুকের সই। ছবিটা ভাল করে দেখলে বোঝা যাবে ওটা একটা মোটা বই। ঐরকম মোটা বইয়ে সই করে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে না। ওরা আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা করছে।
॥ দুই ॥
দৈনিক কালবেলার ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত অপর একটি ভিডিওতে তিনি একজন প্রবাসী বাংলাদেশীর সাথে কথা বলছিলেন। ঐ প্রবাসীর নাম তানভীর কায়সার। ২০১৯ সালে তানভির কায়সার আমেরিকার লসএ্যানজেলেসে গমন করেন। ২০২০ সালে তার ওপর আওয়ামী লীগ সরকার নিপীড়ন করেছে, এই অভিযোগ তুলে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। ২০২১ সালের ২৪ জানুয়ারি তার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়। ঐ প্রবাসী বলেন যে, আসন্ন মার্কিন নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টি থেকে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে আওয়ামী লীগের জন্য ভাল হয়। উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, ওখানে যারা প্রার্থী আছেন, ভোটে যারা জিতবেন তাদের সাথে যোগাযোগ রাখেন, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। ওখানে (আমেরিকায়) যারা ভোটার আছেন, বিশেষ করে যারা বাংলাদেশী ভোটার আছেন, তারা তো ভোট দিতে যায়। তাদের সাথে যোগাযোগ করুন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি কিন্তু দেশের খুব কাছাকাছি আছি। আমি চট করে ঢুকে পড়তে পারি। আমার বিরুদ্ধে ১১৩ টি মামলা। এই সব ডকুমেন্ট নিয়ে জাতিসংঘ থেকে শুরু করে সবার কাছে দাখিল করো। আমার পরিবারের কেউ বাকি নাই যার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয় নাই। তিনি অভিযোগ করেন যে, ড. ইউনূস এ পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ২৬ হাজার কোটি টাকা মানি লন্ডারিং করে বিদেশে পাচার করেছে।
॥ তিন ॥
আমরা সম্মানিত পাঠকদের তথা দেশবাসীর সদয় অবগতির জন্য এই দুটি অডিও ক্লিপের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশবিশেষ হুবহু তুলে দিলাম। ড. ইউনূস বলেছেন যে, ভারতে শেখ হাসিনাকে চুপ থাকতে হবে। আর তা না করে তিনি যদি বাংলাদেশ সরকার বিরোধী কথাবার্তা বলতে থাকেন তাহলে সেটি ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে, ড. ইউনূসের এই সতর্কবাণী লঙ্ঘন করে ভারতে বসে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সরকার বিরোধী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং সেই সব প্রচারণা ভাইরালও হচ্ছে।
একথা ঠিক যে, ইউনূস সরকার বিগত ১ মাস ৭ দিনে অনেক কাজ করেছেন। এই সময়ের মধ্যে তার সরকারকে উৎখাত করার অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছিল। কিন্তু ১৭ কোটি জনগণের সমর্থন এবং সামরিক বাহিনীর তিন শাখার অকুণ্ঠ সমর্থনের কারণে কুচক্রীরা তাদের ষড়যন্ত্রে সফল হতে পারেনি। ইতোমধ্যেই তিনি সেনাবাহিনী থেকে অন্তত ৬ জন জেনারেলকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছেন, কাউকে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়েছেন এবং অন্তত ১ জনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছেন। এরা হলেন লে. জে. মুজিবর রহমান (বরখাস্ত), লে. জে. আহমেদ তাবরেজ (বাধ্যতামূলক অবসর), লে. জে. সাইফুল আলম (বাধ্যতামূলক অবসর) এবং মেজর জেনারেল হামিদুল হককে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়েছেন। মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে প্রথমে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয় এবং পরে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়।
তবে সেনাবাহিনীতে বিগত ১৫ বছর যত অনিয়ম এবং অবিচার হয়েছে সবগুলোর নাটের গুরু ছিলেন মেজর জেনারেল (অব) তারিক আহমেদ সিদ্দিকি। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি শেখ রেহানার আপন দেবর। শেখ হাসিনা এই তারিক সিদ্দিকির মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে ইচ্ছা মতো নিয়ন্ত্রণ করতেন। শেখ হাসিনার পতনের পর তারিক সিদ্দিকির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়নি। তিনি দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন কিনা তাও জানা যায়নি।
একটু আগেই বলেছি যে, এই সরকার অনেক কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু এখনও শেখ হাসিনার ডান হাত বাম হাত বলে পরিচিত অন্তত ১৫ জন পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কিনা তা জানা যায়নি। এরা হলেন ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রধান মনিরুল ইসলাম, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপি যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুন অর রশিদ, সাবেক সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান, সাবেক সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া, পুলিশ হেডকোয়ার্টারের অতিরিক্ত আইজি খন্দকার লুৎফুল কবির, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক এম খুরশিদ, ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার, ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ড. খ. মহিদ উদ্দিন, অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়াদ্দার, যুগ্ম পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান, ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মারুফ হোসেন সরদারসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা। এদের অনেকের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের গ্রেফতারের খবর পাওয়া যায়নি।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করার দাবি রাখে। আইএসপিআরের তথ্য মোতাবেক সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে ছিলেন ৬২৬ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা ২৪ জন, বিচারক ৫ জন, পুলিশ কর্মকর্তা ২৮ জন, বেসামরিক কর্মকর্তা ১৯ জন, পুলিশ সদস্য ৪৮৭ জন এবং অন্যান্য পেশার ১২ জন। এই ৬২৬ ব্যক্তি এখন কোথায় আছেন? সেনা আশ্রয় থেকে কয়জন বেরিয়ে এসেছেন? বেরিয়ে এসে কোথায় গেছেন? পুলিশের কাছে কি এই ৬২৬ জনের কাউকে হস্তান্তর করা হয়েছে? এসব বিষয় নিয়ে বাইরে প্রবল গুঞ্জন চলছে। প্রকৃত তথ্য পরিবেশন করে এসব গুঞ্জনের অবসান করা দরকার।
Email: asifarsalan15@gmail.com https://dailysangram.com/post/566743