দুর্নীতি ও হয়রানির জন্যই যেন এই প্রতিষ্ঠান। প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি দেয়াই কাজ বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)’র। হাজার হাজার শূন্যপদ রেখেও পদায়ন না করা, ভুয়া সনদ, গণবিজ্ঞপ্তি জারিতে কালক্ষেপণ, বদলির ব্যবস্থা না রাখা এসবই করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। চাকরিপ্রত্যাশীদের দিনের পর দিন করে যেতে হচ্ছে দাবি আদায়ের আন্দোলন। আদালত পাড়াতেও গুনতে হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। আর প্রতিষ্ঠানটি আয় করছে কোটি কোটি টাকা। ঘুষ ছাড়া কোনো ফাইল নড়ে না প্রতিষ্ঠানটির।
চেয়ারম্যান আসে, চেয়ারম্যান যায়। কিন্তু বন্ধ হয় না হয়রানি। চাকরিপ্রত্যাশী বেকার কেউ নিবন্ধন পরীক্ষায় পাসের মধ্যদিয়েই যেন নাম লেখান ভোগান্তির খাতায়। শুরুতেই আন্দোলন করতে হয় গণবিজ্ঞপ্তির জন্য। বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগে জটিলতা ও দুর্নীতি নিরসনে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা চালু করা হয় দেড় দশক আগে। আর এসব শিক্ষক নিয়োগের জন্য সরকার ২০০৫ সালে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ এনটিআরসিএ প্রতিষ্ঠা করে। দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য আবেদন একবার করতে হলেও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম এনটিআরসিএ। তাদের নিয়ম জটিলতায় কয়েক ধাপে আবেদন করতে হয় প্রার্থীদের। ২০২২ সালে এনটিআরসিএ কর্তৃক বৈধ সনদ পান মো. আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রায় তিন বছর অপেক্ষা ও টেবিলে টেবিলে ঘুরতে হয়েছে। এমনকি করতে হয়েছে দলগত আন্দোলন। এরপর সনদ পাওয়ার পরও স্বস্তি মেলেনি আমাদের। শূন্যপদ থাকা সাপেক্ষে করতে হয়েছে আবেদন। এরপর আমাকে প্রায় ৪০০ পদের জন্য আবেদন করতে হয়েছে। তাতে আমার খরচ হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন- আমাকে কেন আলাদা আবেদন করতে হবে। আমি সনদ দেখিয়ে আবেদন করবো, পছন্দক্রম দেবো- এটা তো হওয়ার কথা।
আশরাফুলের মতো হাজারো প্রার্থীকে গুনতে হয়েছে হাজার হাজার টাকা। যাতে আকাশচুম্বী আয়ও হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে ৩৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগের আগে এসব আবেদনের প্রেক্ষিতে এনটিআরসিএ আয় করে প্রায় ২০৩ কোটি টাকা। এনটিআরসিএ’র নিয়মই যেন এক একটা ফাঁদ। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শূন্যপদের প্রেক্ষিতে নিয়োগের জন্য প্রিলিমিনারি, লিখিত, মৌখিক ও জাতীয় সম্মিলিত মেধা তালিকায় স্থান পেতে হয়। এরপর নিয়োগের জন্য গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্য প্রার্থীদের কাছে আবেদন নেয়া হয়। শেষ ধাপে মেধা তালিকার শীর্ষ সারি থেকে শূন্যপদে একজন শিক্ষককে সুপারিশ করা হয়। এসব ধাপে ভোগান্তি চরম মাত্রায় ঠেকেছে। এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি পর্যায়েই মামলার খড়গে আটকে গেছে প্রায় সকল সিদ্ধান্ত। বেকার চাকরিপ্রত্যাশীদের আশা দেখিয়ে নিয়মের মারপ্যাঁচে আটকে রাখা হয়। এনটিআরসিএ শিক্ষক হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ার জন্য প্রথম ধাপে পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। সেখানে স্কুল বা কলেজ ক্যাটাগরিতে প্রার্থীরা আবেদন করেন। একটি আবেদনের খরচ ৩৫০ টাকা। আবার শিক্ষক হিসেবে চূড়ান্ত উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য প্রতিটি শূন্যপদের বিপরীতে আবেদন ফি ১০০ টাকা।
আদালতের সিদ্ধান্তে ২০১৮ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে ৪০ হাজার শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয় এনটিআরসিএ। এরপর বিভিন্ন ব্যাচের চাকরিপ্রত্যাশীরা আদালতের দ্বারস্থ হন। এ নিয়ে তৎকালীন সময়ে রিট হয়েছিল ১৬৬টি। এমনকি এসব নিষ্পপ্তি হওয়ার পরও ১৩তম নিবন্ধনধারীদের নিয়ে দু’রকম আদেশ আসায় সেটি নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হয়। শুধু এটি নয়, জটিলতা ছিল ২০১৮ সালে নিয়োগ পাওয়া প্রার্থীরা ছিলেন ২০১৫ সালের সনদধারী। ফলে পিছিয়ে থাকায় দ্বিতীয় এবং তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে তারা শত শত বিদ্যালয়ের শূন্যপদে আবেদন করেও চাকরির সুপারিশ পাননি।
তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি প্রত্যাশীরা আরও কঠিন সময়ের মধ্যদিয়ে সময় পার করেন। তারা পরীক্ষার উত্তীর্ণ হওয়ার পর দেশে করোনার কারণে স্থবিরতা চলে আসে। এ সময়টায় তারা দীর্ঘ সময় আন্দোলন করেন। শুধু তাই নয়, এই নিয়োগ প্রক্রিয়া এতটাই জটিল ছিল যে, কোনো কোনো পক্ষকে আন্দোলনের মাঝেই থাকতে হয়। প্রায় ১০০ দিনের মতো অনশন করেছেন নিবন্ধনধারীরা। এমনকি ঈদের দিনও তারা সড়কে কাটিয়েছেন। তাদের দাবি প্যানেল ভিত্তিতে প্রথম নিবন্ধনধারীদের অগ্রাধিকার দিয়ে ক্রমান্বয়ে সকলকে নিয়োগ দেয়া। আবার এই ৩৪ হাজার শিক্ষকের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার ইনডেক্সধারী আবেদন করেন।
এখনো আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন হাজারো শিক্ষক। শূন্যপদের বিপরীতে দ্রুত বদলির প্রজ্ঞাপন জারি এবং বদলি চালু না হওয়া পর্যন্ত বিশেষ গণবিজ্ঞপ্তি না দেয়ার দাবি জানিয়েছেন ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের বদলি গণবিজ্ঞপ্তি প্রত্যাশী ঐক্যপরিষদ। তারা বলছেন, এনটিআরসিএ গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সুপারিশ করে আসছে। তাই ২য় ও ৩য় গণবিজ্ঞপ্তিতে অনেক নিবন্ধনধারী নিজ এলাকায় পোস্ট না থাকায় বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবার জন্য দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে আবেদন করে সুপারিশ পেয়েছেন। কিন্তু গত ২৭শে আগস্ট শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে বদলি প্রজ্ঞাপনের স্মারকলিপি প্রদান করলে শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি হিসেবে তিনি তা মেনে নেন এবং শূন্য পদের বিপরীতে বদলি চালুর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত শূন্যপদের বিপরীতে বদলির প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়ায় আমরা সব শিক্ষক অত্যন্ত উদ্বিগ্ন।
সংগঠনের সভাপতি প্রভাষক মো. সরোয়ার বলেন, শিক্ষা উপদেষ্টা আদেশ দেয়ার পরও কেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পরিপত্র জারির বিষয়ে গড়িমসি করছেন, বদলি প্রত্যাশী শিক্ষকরা তা স্পষ্ট জানার পাশাপাশি দ্রুত প্রজ্ঞাপন চায়। বদলি প্রত্যাশী শিক্ষকরা বলেন, শিক্ষকদের বদলি না থাকায় একজন শিক্ষককে তার পেশাগত জীবনে নানা প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে যেতে হয়। ১২ হাজার ৫০০ টাকা বেতন উত্তোলন করে বাসা ভাড়া এবং কোনো রকম খেয়ে না খেয়ে যেমন জীবন অতিবাহিত করতে হয়। পাশাপাশি স্থানীয় প্রধান শিক্ষক এবং স্থানীয় শিক্ষকদের রোষানলে পড়ে মানসিক কষ্ট নিয়ে চাকরি করতে হয়। এমনকি আমাদের অনেকে আছেন, স্বামী এবং স্ত্রী চাকরির সুবাদে দু’জন দু’প্রান্তে আছেন, কিন্তু শূন্যপদে বদলির ব্যবস্থা না থাকায় একে অপরের মাঝে মনোমালিন্য, পারিবারিক অশান্তি থেকে শেষে ডিভোর্স পর্যন্ত গড়াচ্ছে। যদি ৭ নং ধারা চালু থাকতো তাহলে গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের মাধ্যমে শিক্ষকরা তাদের নিজ এলাকায় যেতে পারতেন।
শুধু তাই নয়, পদায়নের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন ৯৪ জন সহকারী মৌলভি পদপ্রত্যাশী শিক্ষক। গণবিজ্ঞপ্তিতে চাহিদা প্রদানের পরও তারা চাকরিবঞ্চিত। মো. মাজেদ নামে এক চাকরিপ্রত্যাশী বলেন, আমরা কোনো কারণ ছাড়াই চাকরি থেকে বঞ্চিত। আমরা নিয়ম অনুযায়ী আবেদন করেছি। বিভিন্ন দরবারে দরবারে ঘুরেও কোনো সুরাহা হয়নি। আবার বিগত সরকারের আমলে আমাদের জামায়াত-শিবিরও আখ্যা দিয়ে চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তিনি দাবি জানিয়ে বলেন, আমরা যোগ্যতা বলেই এই জায়গায় এসেছি। আমরা চাকরি চাই।
আবার শুধুমাত্র একবার আবেদনের জন্য দীর্ঘদিন আন্দোলন করে আসছেন ১৭তম শিক্ষক নিবন্ধনে উত্তীর্ণ হয়েও আবেদনবঞ্চিত ৭৩৯ জন প্রার্থী। তাদের দাবি ৫ম গণবিজ্ঞপ্তিতে ১৭তম নিবন্ধনের ৭৩৯ জন প্রার্থীকে আবেদনবঞ্চিত করায় এবং দ্রুত বিশেষ গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে একটিবার আবেদনের সুযোগ চান তারা। চাকরিপ্রত্যাশী মো. ইমরান বলেন, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ১৭তম নিবন্ধনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। প্রিলি, রিটেন ও ভাইভার পর চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয় গত বছরের ডিসেম্বরে। ১ বছরের একটি নিবন্ধনের কার্যক্রম শেষ করতে প্রায় চার বছর লেগেছে। এতে আমাদের ৭৩৯ জনের বয়স পার হয়ে গেছে। অথচ সনদের মেয়াদ ৩ বছর থাকা সত্ত্বেও ১ বার আবেদনের সুযোগ দেয়া হলো না। কিন্তু বিগত গণবিজ্ঞপ্তিতে সবগুলোতেই ছাড় দেয়া হলেও ১৭তমদের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়া হয়নি। চাকরি হবে না তাহলে পাস কেন করানো হলো? সনদ-ই বা কেন দেয়া হলো?
নিয়মের মারপ্যাঁচের বাইরেও আছে প্রতিষ্ঠানটির দুর্নীতি। গেল বছর এনটিআরসিএ’র একজন গাড়িচালকের দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ হয়। তিনি তদবির ও জালিয়াতি করে আয় করেন কোটি কোটি টাকা। এরপর সনদ বাণিজ্য নিয়ে কথা বলেন একাধিক নিয়োগ পাওয়া ও নিয়োগ প্রত্যাশী শিক্ষক। মাগুরায় নিয়োগ পাওয়া এক শিক্ষক বলেন, সনদেই মূলত প্রধান বাণিজ্য হয়। ২০২০ সালে সনদের আবেদন রিজেক্ট হয় আমার। সনদ পাইয়ে দেয়ার জন্য কয়েক শ্রেণির দালাল থাকে। তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতো। তারা সর্বনিম্ন এক লাখ টাকা থেকে শুরু করে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত রাখতো।
এনটিআরসিএ’তে টাকা ঢাললেই মেলে স্বাক্ষর, বাড়িয়ে নেয়া যায় নম্বর। এতসব দুর্নীতির চিত্র গণমাধ্যমে প্রায়শই উঠে আসার পরও ব্যবস্থা নেইনি এনটিআরসিএ। এনটিআরসিএ পার হওয়ার পরও থেমে থাকে না হয়রানি। প্রতিষ্ঠানপ্রধান, ম্যানেজিং কমিটি, উপজেলা, জেলা ও আঞ্চলিক শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তারা এমপিও ফাইল নানাভাবে আটকিয়ে রাখছেন। ঘুষ না দিলে সেই ফাইল ছাড়ছেন না। এসব নানা কারণে ও নিয়োগপ্রাপ্তদের হয়রানি রোধে এনটিআরসিএ তুলে দিতে মত দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সিদ্ধান্ত মতে, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) আদলে বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়োগ দিতে নতুন কমিশন গঠন করা হবে। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি খসড়া আইন তৈরির নির্দেশ দেয়। এনটিআরসিএ বিলুপ্ত করে বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশন (এনটিএসসি) গড়ে তোলা হবে।
শুধু তাই নয় সারা দেশে ৬০ হাজার শিক্ষক জাল সনদে চাকরি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের চিহ্নিত করার পর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। এনটিআরসিএ নিবন্ধিত নিয়োগবঞ্চিত শিক্ষক ফোরাম এই অভিযোগ করার পরও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি এনটিআরসিএ। তারা দাবি করে আমাদের রোল, রেজিস্ট্রেশন নম্বর ব্যবহার করে এনটিআরসিএ ৬০ হাজার জাল সনদ দিয়েছে। তাদের আবার এমপিওভুক্ত করেছে। জাল সনদধারীরা বহাল তবিয়তেই স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শাখায় এখনো শিক্ষকতা করছেন। জাল সনদধারীদের চিহ্নিত করার পরও তাদের চাকরিচ্যুত করা হলো না কেন? আমাদের নিয়োগ এখনো দেয়া হয়নি কেন?
এদিকে এনটিআরসিএ’কে ঢেলে সাজাতে মোহাম্মাদ মফিজুর রহমানকে গত ৯ই সেপ্টেম্বর দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি সাবেক চেয়ারম্যান মো. সাইফুল্লাহিল আজমের স্থলাভিষিক্ত হন। তবে সবশেষ তথ্যানুযায়ী এখনো তিনি যোগদান করেননি।