দেশজুড়ে তীব্র লোডশেডিংয়ের জন্য সামিট পাওয়ার ও ভারতের আদানি পাওয়ার, এস আলমের বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং পুকুরিয়া, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন হ্রাসকে দায়ী করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ড. ফাওজুল কবির খান যুগান্তরকে বলেছেন, লোডশেডিংয়ের কারণগুলো চিহ্নিত হয়েছে। সমস্যা সমাধানে দ্রুত কাজও শুরু করেছে সরকার। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কিছুটা বেড়েছে। গত ৩ দিন আগের যে অসহনীয় পরিস্থিতি ছিল সেটি এখন নেই। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হচ্ছে। পুরো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও ২-৩ সপ্তাহ লাগতে পারে বলেও তিনি জানান।
জ্বালানি বিভাগ জানিয়েছে, গত প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে সামিটের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনালটি বন্ধ। এতে প্রতিদিন গড়ে ১২০০ মেগাওয়াটের মতো কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। অন্যদিকে বকেয়ার কারণে ভারতের আদানি গ্রুপ প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়েছিল। এর সঙ্গে কারিগরি কারণে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ এবং মাতারবাড়ি ও এস আলমের বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কমে যাওয়ায় দেশে লোডশেডিং তীব্র আকার ধারণ করে। কক্সবাজারের মহেশখালীতে ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৮৫০ থেকে ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কমে গিয়েছিল।
ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে গড়ে প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করে বাংলাদেশ। কিন্তু বেশ কয়েক দিন ধরে তারা ১ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। এ প্রসঙ্গে আদানির বক্তব্য পিডিবির কাছে তাদের বকেয়া অনেক বেড়ে যাওয়ায় কয়লা কিনতে পারছে না। এ কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন কমানো হয়েছে। বকেয়া পরিশোধের বিষয়ে গত সপ্তাহে তারা বিদ্যুৎ উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও বিল দিতে বলা হচ্ছে। কিন্তু সোনালী ব্যাংক থেকে অর্থ ছাড় করছে না।
এসব প্রসঙ্গে জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, সামিটের এফএসআরইউটি ইতোমধ্যে ঠিক হয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে এলএনজি না থাকায় সেখানে প্রাকৃতিক গ্যাস তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। বুধবার এলএনজির জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহবান করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ২/৩ সপ্তাহের মধ্যে এলএনজি পৌঁছে গেলে সামিট প্রায় ৫০০ এমএমসিএফডি গ্যাস দিতে পারবে জাতীয় গ্রিডে। ভারতের আদানি পাওয়ারের সমস্যা সমাধানে আদানিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আদানি ইতোমধ্যে তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়িয়েছে। অপর দিকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সেটিও মেরামত করে উৎপাদনে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এছাড়া বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মেরামত কাজ শুরু হয়েছে। আগামী ১৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সেটি উৎপাদনে ফিরে আসবে। সবমিলিয়ে সাময়িক যে সংকট ছিল তা কেটে গেছে। আগামী ৩ সপ্তাহের মধ্যে পুরো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। জ্বালানি উপদেষ্টা আরও বলেন, জ্বালানি বিভাগকে চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে যদি কোনো কারণে বিদ্যুতের বড় ক্যাপাসিটি নষ্ট হয় তাহলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ বাড়িয়ে দিতে। কারণ দেশে গ্যাসভিত্তিক প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দিনে গড়ে সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ১৪ হাজার থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এতে প্রতিদিন লোডশেডিং হচ্ছে প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াটের বেশি।
এদিকে পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, লোডশেডিং সামাল দিতে গিয়ে পিক-আওয়ারে ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দৈনিক প্রায় ৪২০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে দেশীয় ও আমদানি মিলে গড়ে সরবরাহ ক্ষমতা প্রায় ৩১০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে কক্সবাজারের মহেশখালীতে মার্কিন প্রতিষ্ঠান এক্সিলারেট এনার্জি এবং বাংলাদেশের সামিটের দুটি ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে আমদানি করা এলএনজি থেকে ১১০ কোটি ঘনফুট পাওয়া যায়।
কারিগরি ত্রুটির কারণে সামিটের এলএনজি টার্মিনালটি গত ২৭ মে থেকে বন্ধ । বর্তমানে এক্সিলারেটের টার্মিনালের মাধ্যমে সরবরাহ করা হচ্ছে ৫৯ কোটি ঘনফুট গ্যাস। এর ফলে গ্যাস সরবরাহ নেমে এসেছে ২৬০ কোটি ঘনফুটে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতিদিন ২৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকলেও সরবরাহ হচ্ছে ৮৫ কোটি ঘনফুটের নিচে। সামিটের টার্মিনাল বন্ধের আগে ১২০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত সরবরাহ করা হয়েছিল।
গ্যাস সংকটের পাশাপাশি বিদ্যুতের লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় কলকারখানার উৎপাদনও চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য গত বুধবার সচিবালয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানের সঙ্গে দেখা করেন ব্যবসায়ীদের সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির একটি প্রতিনিধিদল। তারা উপদেষ্টাকে বলেন, কারখানায় নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ না পাওয়ায় তাদের কলকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তারা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের দাবি জানান। শুধু শিল্প কারখানা নয় গ্যাস সংকটে সার ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে সমস্যা তৈরি হয়েছে। রূপসায় ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি গ্যাসের জন্য চালু করা যাচ্ছে না।
হঠাৎ বিদ্যুৎ সংকট তৈরি হওয়ায় ঢাকার বাইরেও তীব্র লোডশেডিং হচ্ছে। কৃষিকাজে সেচ দেওয়া যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ না থাকায় গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক, রাইস মিলের শ্রমিকসহ বিভিন্ন খাতের ক্ষুদ্র আয়ের মানুষের আয় কমেছে। গবাদি পশুর খামারিরাও বড় ধরনের আর্থিক সংকটের আশঙ্কা করছেন বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে।
পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) সদস্য দেবাশীষ চক্রবর্তী (বিতরণ ও পরিচালন) জানান, চাহিদার তুলনায় প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ কম সরবরাহ পাওয়ায় তাদের বিতরণ এলাকায় লোডশেডিং বেড়েছে। বর্তমানে আরইবির প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ গ্রাহক রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিদিন বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় সাড়ে ১০ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু ৩ ভাগের একভাগও পাচ্ছে না তারা।
কারিগরি ত্রুটির কারণে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে বড়পুকুরিয়া ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার তৃতীয় ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ । এ ইউনিট থেকে দিনে ১৯০-২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, জ্বালানি নিশ্চিত না করেই একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। চাহিদাকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। ফলে প্রতিবছর অলস বসিয়ে রাখতে হচ্ছে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র। অথচ এজন্য দিতে হচ্ছে অলস কেন্দ্রের ভাড়া বা ক্যাপাসিটি চার্জ। এতে একদিকে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে অপর দিকে মানুষের ভোগান্তি ও সরকারের দায় বেড়ে চলছে।
পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) খন্দকার মোকাম্মেল হোসেন বলেন, গ্যাসের সরবরাহ কম, বকেয়া বিলের চাপ থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে। বকেয়া পরিশোধে ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মূলত বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। ৫ হাজার থেকে বেড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনসক্ষমতা হয়েছে প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াট, যা চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ। যদিও অর্ধেকের মতো সক্ষমতা অলস পড়ে থাকে। পরিশোধ করতে হচ্ছে সক্ষমতার ভাড়া, যা ক্যাপাসিটি চার্জ নামে পরিচিত।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সাবেক সদস্য (বিদ্যুৎ) মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ২০২১ সালে চাহিদা হওয়ার কথা ছিল ১৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। বাস্তবেও অনেকটা তাই হয়েছে। ২৫ শতাংশ বাড়তি ধরে উৎপাদনসক্ষমতা হওয়ার কথা ছিল ১৮ হাজার মেগাওয়াট। করা হয়েছে ২২ হাজার মেগাওয়াট। দরপত্র ছাড়া খেয়াল-খুশির চুক্তি করে অসাধু ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। দেশের অর্থনীতিকে বিপদে ফেলতে একটি সংঘবদ্ধ চক্র পরিকল্পিতভাবে এটি করেছে।