ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে পাশ্ববর্তী দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করার ঘোষণা দেয়। বিশেষ করে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে দায়িত্ব পালন করা দুই দেশের বাহিনীকে আরও সংযত আচরণ করতে বলা হয়। এরপরও থেমে নেই বিএসএফ। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাংলাদেশী এক স্কুলছাত্রী এবং এক কিশোরকে গুলী করে হত্যা করেছে বিএসএফ। বিএসএফ এর হাতে আহত হয়েছেন আরও দুই বাংলাদেশী নাগরিক। এরআগে বহুবার সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিলেও কথা রাখেনি ভারত। শুধু পতাকা বৈঠকেই সীমাবদ্ধ সমাধানের পথ। পৃথিবীর কোনো দেশের সীমান্তে এত হত্যাকান্ড হয়েছে এমন নজির নেই বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। প্রায় প্রতিমাসেই বিএসএফের হাতে প্রাণ হারাচ্ছেন বাংলাদেশীরা। পাশাপাশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে অহরহ।
অন্তর্বর্তী সরকারে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) সীমান্তে পিঠ না দেখাতে বলেছেন। গতকাল মঙ্গলবারও তিনি বলেছেন, সীমান্ত হত্যা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সীমান্ত হত্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে, সেই ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আশা করব, ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা ঘটবে না। এর আগে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলীতে বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যার ঘটনাকে ‘নিষ্ঠুরতা’ বলে উল্লেখ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ ইউনূস। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন সময়ের আহ্বানের পরও বিএসএফ সংযত আচরণ তো করেইনি উল্টো বাংলাদেশীদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে মৌমাছি মোতায়েন করেছে বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ায় বাংলাদেশ সীমান্তে মৌমাছির কৃত্রিম চাক স্থাপন করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। সোমবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নিউজ-১৮ এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রকাশিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, চলতি বছরের (২০২৪) জুন মাস পর্যন্ত ৬ মাসে সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফের গুলীতে নিহত হয়েছেন ১৩ বাংলাদেশী নাগরিক। এ ছাড়া আহত হয়েছেন ১১ জন। অন্যদিকে মিয়ানমার সীমান্তে মর্টার শেলের আঘাতে ১ জন বাংলাদেশী এবং বাংলাদেশে আশ্রিত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ১ জন নিহত হন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি-জুন মেয়াদে সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফের গুলীতে নিহত হয়েছিলেন ১০ জন, আহত ১৪ জন। সরকারের হিসাবে বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ৯ বছরে বিএসএফের হাতে ২৯১ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। এই ৯ বছরের মধ্যে সবচে বেশি প্রাণ হারিয়েছেন ২০০৯ সালে। আর সবচে কম ১৭ জন হত্যার শিকার হয়েছেন ২০১৭ সালে। আর বেসরকারি আরেকটি হিসেবে তথ্য পাওয়া গেছে, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৮ বছরে বিএসএফ এর গুলীতে ১ হাজার ৪১৩ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছে।
জানা গেছে, চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার পিলখানায় ‘বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫৪তম সীমান্ত সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। আর ৯ মার্চ সকালে যৌথ আলোচনার পর দলিল স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে সীমান্ত সম্মেলন শেষ হয়। মূলত ঢাকায় সীমান্ত সম্মেলনে অংশ নেয়া শেষে বিএসএফ প্রধানের ফিরে যাওয়ার পর তাদের মারমুখী অবস্থান বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। সীমান্তে বছরের পর বছর ধরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলী ও নির্যাতনে প্রাণ হারাচ্ছেন নিরীহ বাংলাদেশীরা। বিগত ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারিতে বিএসএফের গুলীতে নির্মম হত্যার শিকার হয় কিশোরী ফেলানী খাতুন। তার লাশ সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। ওই সময় কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে থাকা কুড়িগ্রামের কিশোরী ফেলানীর মরদেহের ছবি আলোড়ন তুলেছিল দেশে-বিদেশে।
ওই ঘটনার পর দফায় দফায় আলোচনায় সীমান্তে হত্যা বন্ধে প্রতিশ্রুতি দেয় বিএসএফ। তবে গত ১২ বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় একেবারেই উল্টোচিত্র। জানুয়ারি থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত হত্যার শিকার হয়েছেন ১৫ জনের বেশি। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএসএফের হাতে মারা গেছেন ২০০ এর বেশি বাংলাদেশী। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন শতাধিক মানুষ। যার মধ্যে গতবছর ২৮ জনের প্রাণহানি ও ৩১ জন মারাত্মক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। আসকের তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশীকে হত্যা করে বিএসএফ। ওই বছর ৪৮ জন বাংলাদেশী প্রাণ হারান, যার মধ্যে ৪২ জন বিএসএফের গুলীতে ও ছয়জন শারীরিক নির্যাতনে মারা যান। এর আগের বছর যে ৪৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন তাদের মধ্যে ৩৭ জন বিএসএফের গুলীতে এবং ছয় জনের মৃত্যু হয়েছে নির্যাতনে। গত সাত বছরের মধ্যে বিএসএফের গুলীতে সবচে কম বাংলাদেশীর মৃত্যু হয় ২০১৮ সালে ১৪ জনের। সরকারি হিসাব অনুসারে ২০০৯ সালে ৬৬ জন, ২০১০ সালে ৫৫, ২০১১ সালে ২৪, ২০১২ সালে ২৪, ২০১৩ সালে ১৮, ২০১৪ সালে ২৪, ২০১৫ সালে ৩৮, ২০১৬ সালে ২৫, ২০১৭ সালে ১৭ জন। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ-ভারতের বিভিন্ন পর্যায়ের বৈঠকে সীমান্তে হত্যাকা- নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারতীয় পক্ষ বার বার সীমান্ত হত্যা বন্ধের আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
গুলীতে স্কুলছাত্রী নিহত : ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলীতে মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার ১৩ বছর বয়সী বাংলাদেশী কিশোরী স্বর্ণা দাস নিহতের ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা। ৫ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। পররাষ্ট্র দপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সীমান্ত হত্যার এ ধরনের ঘটনা অনভিপ্রেত ও অনাকাক্সিক্ষত। এ ধরনের কর্মকা- সীমান্ত কর্তৃপক্ষের জন্য যৌথ ভারত-বাংলাদেশ নির্দেশিকা-১৯৭৫ এর বিধানের লঙ্ঘন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এ ধরনের জঘন্য ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করে সীমান্ত হত্যাকা-ের তদন্ত করা, দায়ীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার জন্য ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। গত ১ সেপ্টেম্বর রাতে কুলাউড়া উপজেলার শরীফপুর ইউনিয়নের লালারচক সীমান্ত এলাকায় স্বর্ণা দাস ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলীতে প্রাণ হারায়। সে পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নের কালনীগড় গ্রামের বাসিন্দা পরেন্দ্র দাসের মেয়ে। স্বর্ণা একই উপজেলার নিরোদ বিহারী উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। স্বর্ণার মৃত্যুর খবরে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। এ ঘটনার পর রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) গভীর রাতে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলীতে জয়ন্ত কুমার সিংহ (১৫) নামে বাংলাদেশী এক কিশোর নিহত হয়। উপজেলার ধনতলা সীমান্ত এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত জয়ন্ত বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ফকিরভিটা বেলপুকুর গ্রামের বাসিন্দা মহাদেব কুমার সিংহের ছেলে। এ ঘটনায় মহাদেব কুমার সিংহ ও নিটালডোবা গ্রামের দরবার আলী নামের আরেক ব্যক্তি গুলীবিদ্ধ হয়েছেন।
ফেলানীর মতো হত্যাকা- দেখতে চাই না : বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) প্রতি নির্দেশনা দিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘আমরা সীমান্তে ফেলানীর মতো কোনো হত্যাকা- দেখতে চাই না। সীমান্তে আর পিঠ প্রদর্শন করবেন না। সীমান্ত সুরক্ষা ও চোরাচালান প্রতিরোধ বিজিবির মূল দায়িত্ব।’ ৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পিলখানায় বিজিবি সদর দপ্তরের সীমান্ত সম্মেলন কেন্দ্রে বাহিনীটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বক্তৃতাকালে এ নির্দেশনা প্রদান করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বিজিবিকে আইন অনুযায়ী কাজ করতে হবে। তিনি এ সময় বিজিবিকে পেশাদারিত্বের সঙ্গে নিজেদের দায়িত্ব পালন করার আহ্বান জানান। ফেলানীর মতো হত্যাকা- আর দেখতে চাই না’ উল্লেখ করে উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘সীমান্তে পিঠ প্রদর্শন করবেন না। নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করুন। একই দিন বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলীতে বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যার ঘটনাকে ‘নিষ্ঠুরতা’ বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ ইউনূস। ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়াকে (পিটিআই) সম্প্রতি দেওয়া এক সাক্ষাক্ষাৎকারে এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সীমান্তে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা বা পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সেটির সমাধানের জন্য আইনগত পথ-পদ্ধতি রয়েছে। কাউকে হত্যা করা কখনও কোনো সমাধান নয়। সীমান্তে হত্যার যে ব্যাপারটি নিয়ে গত বেশ কয়েক বছর ধরে আলোচনা চলছে…এসব হত্যাকা- কিন্তু একতরফা। যারা সীমান্ত অতিক্রম করে, তারা নিতান্তই সাধারণ লোকজন। আপনাদের রাষ্ট্র দখল করার কোনো ইচ্ছে, পরিকল্পনা বা ক্ষমতা তাদের নেই।