কলেজে ছাত্রলীগ, এলাকায় যুবলীগের নির্যাতন সহ্য হতো না। একদিন ওরাই আমাদের শেষ করে দিতো, ক্লিবলিঙ্গের মতো বেঁচে থাকতে হতো। কিন্তু ক্লিবলিঙ্গের মতো বেঁচে থাকতে চাইনি। তাই এদের তাড়ানোর প্রথম সুযোগেই আন্দোলনে নেমে গিয়েছি। পুলিশের গুলির কথা ভাবিনি। কথাগুলো বলছিলেন ব্যবস্থাপনার (সম্মান) ছাত্র দীপু মিয়া। তার বাম পায়ে গুলি লেগেছে, ছিঁড়ে গেছে গোড়ালির ট্যান্ডন। ফলে হাঁটতে পারছেন না। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের (ঢামেক) পুরনো বার্ন ইউনিটের ৫০৩ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন। একটি অপারেশন হয়েছে, আরো একটি অপারেশন করতে হবে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তখন হয়তো বলা যাবে দীপু মিয়া আগের মতো স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারবে কি না।
কথা হচ্ছিল আন্দোলন, পায়ে গুলি খাওয়া নিয়ে। দীপু বলেন, আমরা বৈষম্যের শিকার আগে থেকেই। কলেজে ছাত্রলীগ, এলাকায় যুবলীগের দ্বারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছিলাম। আমার বাবা-চাচা এমনকি দাদাও আওয়ামী লীগ কর্তৃক নির্যাতিত হয়েছেন। দীপু মিয়া নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার শহীদ আসাদ সরকারি কলেজে পড়াশোনা করেন। জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকার বাড্ডায় বোনের বাসায় বেড়াতে আসেন দীপু। ওই এলাকার বেসরকারি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা প্রথমে কোটা সংস্কার, পরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু করলে ১৬ জুলাই তাদের সাথে দীপুও নেমে যান। ১৬ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত টানা বাড্ডা এলাকায় রাস্তায় বিক্ষোভ করেন। ১৮ ও ১৯ জুলাই তীব্র আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে সাথের আন্দোলনকারীদের রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছেন। বিক্ষোভ করার পাশাপাশি আহতদের রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে হাসপাতালে পেঁৗঁছে দেয়ার কাজও করেছেন। ৩ আগস্ট নরসিংদীর বাসায় গিয়ে সেখানেও আন্দোলনে যোগ দিতে রাস্তায় নামেন। সেদিন নরসিংদীতে পুলিশের গুলি লাগে পায়ে। এরপর কী হয়েছে তিনি বলতে পারবেন না।
এ প্রতিবেদককে দীপু জানান, চোখের সামনেই আমার মতো হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী রাস্তায় নেমেছিল। আমি এই আন্দোলন থেকে দূরে থাকতে চাইনি, মন থেকেই আন্দোলনে নেমেছিলাম। বাবা-চাচারা অত্যাচারিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের লোকদের দ্বারা। এদের অত্যাচারটা সহ্য করতে মন চাইতো না, বিদ্রোহ করতে মন চাইতো। কিন্তু বিদ্রোহ করার উপযুক্ত পরিবেশ পাইনি। জুলাই মাসে আন্দোলন তীব্র হলে আর অপেক্ষা করিনি। ঢাকায় পড়াশোনা না করা সত্ত্বেও ব্র্যাক ও ইউআইইউয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে আন্দোলন করেছি।
ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ এমন কী করেছে যে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে মন চাইতো- এই প্রশ্নে দীপু জানান, কুমিল্লার বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় তাদের দাদার বাড়ি। সাবেক মন্ত্রী ক্যাপ্টেন তাজের সহায়তায় বাঞ্ছারামপুর পাহাড়িয়াকান্দী ইউনিয়ন পরিষদের ভোটারবিহীন নির্বাচনের অবৈধ চেয়ারম্যান গাজীউর রহমান শেখ হাসিনা কলেজের নামে আমার বাবার জমি নিয়ে গেছে। ওই এলাকায় এক শতাংশ জমির দাম দিয়েছে মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকা, যেখানে জমির প্রকৃত দাম ৩৫ লাখ টাকা। শেখ হাসিনা কলেজের নামে জমি নিলেও জায়গা রেজিস্ট্রি করে দিতে হয়েছে গাজীউরের নামে। পানির দামে জোর করে জমিগুলো নিয়ে গেছে। কিন্তু এত সস্তা দরে জমি নিলেও টাকা দিয়েছে দুই বছর পর।
দীপুর বাবা ফারুক মিয়া জানান, আমি জমি দিতে চাইনি। কিন্তু গীজাউরের গুণ্ডারা রাস্তায় চারদিকে ঘেরাও করে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে দলিলে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। কিন্তু জমি নেয়ার দুই বছরও সেখানে কলেজের জন্য কোনো ভবন ওঠেনি। শুধু জমিটা দখলে রাখার জন্য একটি টিনশেড ভবন করে রাখে গুদামঘরের মতো। নরসিংদীতেও নিপীড়নের শিকার হয়েছি। সেখানে আমাদের কিছু জমি আছে। সেখানেও যুবলীগের হুমকিতে থাকতে হয়েছে সারাক্ষণ।
স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতন হয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার এলেও সাংবাদিককে তথ্য দিতে প্রথমে দীপু অথবা তার বাবা ফারুক মিয়া ইতস্তত করছিলেন। বলছিলেন, আমরা এমনিতেই নির্যাতিত, এরপর এরা সংগঠিত হয়ে আবার যদি অত্যাচার করে। ফারুক মিয়া বলছিলেন, সরকারের উচিত বিগত হাসিনা স্বৈরাচার সরকারের সব সহযোগীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হয় যেন, মানুষ নিরাপদে নির্ভয়ে জীবন-যাপন করতে পারে।