গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ব্যাংকিং খাতে এক শ্রেণীর অলিগার্কের সৃষ্টি হয়েছিল। জনগণের আমানতের অর্থ বেশির ভাগই নিজেরাই নামে-বেনামে ভাগবাটোয়ারা করে নিতেন। চট্টগ্রামের বিতর্কিত ব্যবসায়ী এক এস আলমকেই রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ৮টি ব্যাংকের মালিক বনে যান আওয়ামী লীগ। তারা একাই ব্যাংকিং খাত থেকে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। ঋণের নামে বের করে নেয়া এসব অর্থের বিপরীতে তেমন কোনো জামানত নেই। এক্সিম ব্যাংকের নজরুল ইসলাম মজুমদার দীর্ঘ দেড় যুগ নানা কৌশলে চেয়ারম্যানের পদ দখল করে ব্যাংকটি থেকে নামে-বেনামে বড় অঙ্কের টাকা বের করে নিয়েছেন। আর এটা সম্ভব হয়েছে ব্যাংকিং খাত পরিবারতন্ত্রের কাছে জিম্মি থাকার কারণে। সময়ে সময়ে ব্যাংক কোম্পানি আইন শিথিল করে একই পরিবারের দুইজন পরিচালকের পরিবর্তে চারজন পরিচালক করা, তিন বছর করে পরপর তিন মেয়াদে ৯ বছর পরিচালক থাকাসহ বিভিন্ন সুবিধা বাগিয়ে নেয়া। এ সুবিধা পেতে সময়ে সময়ে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হাতে বিভিন্ন অনুদানের চেক প্রদানের শোডাউন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, ব্যাংকে অলিগার্ক সৃষ্টির পেছনে যতগুলো কারণ আছে তা পর্যায়ক্রমে ভেঙে দেয়া হবে। এ জন্য চলমান সংস্কার কার্যক্রম শেষে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হবে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, সময়ে সময়ে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের মাধ্যমে ব্যাংকের পরিচালকরা নানা ধরনের সুবিধা নিয়েছেন। আগে ব্যাংকের পরিচালক হতে শেয়ার ধারণের কোনো সীমা ছিল না। যারা ব্যাংক পরিচালনায় দক্ষ ছিলেন ও জনগণের আমানত যাদের কাছে নিরাপদ মনে করা হতো তাদেরকে ব্যাংকের পরিচালক পদে বসানো হতো। যেহেতু ওইসময় পরিচালদের কাছে তেমন কোনো শেয়ার থাকত না। তাই বছর শেষে তাদের লভ্যাংশ পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। আর এ কারণে ব্যাংকারদের মুনাফা বৃদ্ধিতে চাপ দেয়া হতো না। জনগণ ও দেশের অর্থনীতির কল্যাণে তারা ব্যাংক পরিচালনা করতেন। এ কারণে ব্যাংকের পরিচালকদের দ্বারা তেমন কোনো অনিয়ম হতো না।
কিন্তু এক শ্রেণীর পুঁজিবাদী তাদের পুঁজিকে স্ফীত করতে ব্যাংকে পরিচালক হতে উৎসাহীত করে। আর এ জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করার জন্য নানা কৌশলে রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভবে চাপ সৃষ্টি করে। আর পুঁজিবাদীদের চাপেই প্রথমে ব্যাংক পরিচালক থেকে কমপক্ষে দুই শতাংশ শেয়ার ধারণের বিধান সংযুক্ত করা হয় ব্যাংক কোম্পানি আইনে। আর এভাবে সমাজের একশ্রেণীর নিষ্ঠাবান ও নির্লোভ পরিচালকরা ব্যাংক পরিচালনা থেকে ছিটকে পড়েন। বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়ে ২ শতাংশ শেয়ারের মালিক হয়ে ব্যাংকের পরিচালক হয়ে যান পুঁজিবাদীরা। একই পরিবার থেকে দুইজন পরিচালক হওয়ার বিধান চালু করা হয়। তাদের পুঁজি স্ফীত করতে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণ নিতে থাকে। পরিচালকরা একে অন্যের ব্যাংক থেকে ঋণ ভাগ করে নিতে থাকে। ২০১২ সালের পর থেকে ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র জোরদার করতে ব্যাংক কোম্পানি আইন আরো শিথিল করা হয়। যেখানে আগে একই পরিবার থেকে দুইজনের বেশি পরিচালক হওয়া যেত না, তাই পরিবারতন্ত্রকে আরো বেশি শক্তিশালী করতে দুইজনের পরিবর্তে চারজন পরিচালকের বিধান চালু করা হয়। দীর্ঘ দিন ব্যাংক থেকে জনগণের অর্থ লুটপাট করতে তিন বছরের পরিবর্তে পরিচালকের মেয়াদ তিন মেয়াদে ৯ বছর করা হয়। আর এভাবেই ব্যাংকে অলিগার্ক শ্রেণী সৃষ্টি হয়।
এভাবে গত ১৫ বছরে ব্যাংকিং খাতে এস আলম গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপসহ শত শত গ্রুপ হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক বের করে নিতে সক্ষম হয়েছে। আবার এসব অর্থ যাতে ফেরত দিতে না হয় সে জন্য কখনো ঋণ পুনর্গঠনের নামে হাজার হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ কোনোমাত্র ডাউন পেমেন্ট দিয়ে নবায়ন করা হয়। কখনো ডাউন পেমেন্ট না দিয়েই নবায়ন করা হয়। আবার নানা ফাঁকফোকর দিয়ে ঋণ পরিশোধ না করে বছরের পর বছর পার পেয়ে যাচ্ছেন। আর এ কারণে প্রায় এক ডজন ব্যাংক রুগ্ণ হয়ে পড়েছে। যাদের বেশির ভাগই গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। ঝুঁকির মুখে পড়েছে সাধারণ গ্রাহকের আমানত।
এ দিকে গত দেড় দশকে ব্যাংকিং খাতে সৃষ্ট অলিগার্ক শ্রেণীকে ভেঙে দিতে শুরু করে করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তারা গত এক মাসে ডজন খানেক ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে। নতুন পর্ষদ গঠন করেছে। এ বিষয়ে রোববার বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকিং খাতে সৃষ্ট সব ধরনের অলিগার্ককে ভেঙে দেয়া হবে। ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করা হবে। অলিগার্ক সৃষ্টি হতে কারণ এমন ব্যাংক কোম্পানি আইনের ধারাগুলো বাতিল করা হবে। তিনি জানান, ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে যা যা প্রয়োজন তাই করা হবে। এ জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হবে।