অন্তর্বর্তী সরকারকে অচল করার সর্বশেষ ট্রাম্প কার্ড গার্মেন্টস শিল্প। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক। শ্রমিকদের মাধ্যমে দেশকে অচল করার পাঁয়তারা করছে দিল্লিতে পলাতক শেখ হাসিনা ও পোশাক শিল্পের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারত। বাংলাদেশে শ্রমিক অসন্তোষে পোশাক শিল্পের সমস্যা হলে এটি ভারতে চলে যাবে। পাশাপাশি হাসিনার স্বার্থ রক্ষার্থে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপাকে ফেলে দেশের মধ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করা। গতকাল সবেতনে বন্ধ ছিল ৪২ টি পোশাক কারখানা। কাজ না করে বের হয়ে গেছে ১১ টি কারখানার শ্রমিক। কাজ বন্ধ করে শ্রমিকরা বিশৃংখলা করেছে ২১ টি কারখানায় এবং যাদেরকে পরে ছুটি ঘোষণা করা হয়। গতকাল মঙ্গলবারে মোট বন্ধ কারখানা ছিল ৭৪ টি। এছাড়া কিছু শ্রমিক কারখানায় এলেও বিভিন্ন দাবিতে কাজ বন্ধ করে দিয়ে বসে আছেন বলে জানা গেছে। এসব কারখানার মালিকপক্ষ শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন। এর আগে জুডিশিয়্যাল ক্যু, সংখ্যালঘু নির্যাতনের মিথ্যা প্রচারণা, ১৫ ও ২১ আগস্টে ঢাকায় ১০ লাখ লোকের সমাগম করে সরকারকে ফেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র, সরকারি কর্মচারীদের দাবি দাওয়ার আন্দোলনে রাস্তায় নামিয়ে বিশৃংখলা সৃষ্টি ও আনসার বাহিনী দিয়ে সচিবালয় ঘেরাও ষড়যন্ত্রে সফল হতে না পেরে এখন সর্বশেষ শ্রমিকদের দিয়ে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে সরকার অচল করে দেয়ার অপচেষ্টায় নেমেছে স্বৈরাচার হাসিনা এবং ভারতের গোয়েন্দা বাহিনী ‘র’। তাদের নীল নকশা বাস্তবায়নে তৎপর তৃতীয় শক্তি। আর যে কারণে দাবি-দাওয়া মেনে নেয়া হলেও গত ১১ দিনেও নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না পোশাক শিল্পের অস্থিরতা। এদিকে গত সোমবার দিনভর বিজিএমইএ নেতৃবৃন্দ, পোশাক শ্রমিক নেতৃবৃন্দ ও আশুলিয়া অঞ্চলের কারখানা মালিকরা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী একাধিক বাহিনীর বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও। এ সময় সিদ্ধান্ত হয়, আশুলিয়া অঞ্চলের পোশাক শ্রমিকেরা হাজিরা বোনাস হিসেবে মাসে অতিরিক্ত ২২৫ টাকা পাবেন। এছাড়া টিফিন বিল বাবদ অতিরিক্ত ১০ টাকা করে দেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সোমবার রাতে দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টার বৈঠকে এমন সিদ্ধান্তে আসেন বিজিএমই। বিজিএমই’র পরিচালক আশিকুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বিভিন্ন কারখানা নিজেদের সক্ষমতা অনুযায়ী শ্রমিকদের হাজিরা বোনাস দেয়। আশুলিয়া অঞ্চলের শ্রমিকেরা আগে থেকে যে শ্রমিক যত টাকাই হাজিরা বোনাস পান না কেন, এখন থেকে তারা অতিরিক্ত ২২৫ টাকা পাবেন। হাজিরা বোনাস মূলত শ্রমিকদের নিয়মিত কর্মস্থলে উপস্থিত হওয়ার জন্য প্রণোদনা হিসেবে দেওয়া হয়। বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, গার্মেন্টসকে অস্থিতিশীল করতে এখনো সক্রিয় একটি পক্ষ। তবে কোন ষড়যন্ত্রই সফল হবে না। পরিস্থিতি দ্রুতই নিয়ন্ত্রণে আসবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বিজিএমইএ শ্রমিকদের সঙ্গে সভা করেছে। তাদের দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। বর্তমান অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ, এলাকাবাসী, বাড়িওয়ালা থেকে সবাই একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করছি।
অন্তর্বর্তী সরকারকে বিব্রত করার পাশাপাশি বাংলাদেশের পোশাকশিল্পকে অন্য দেশের হাতে তুলে দিতেই পরিকল্পিতভাবে অস্থিতিশীল করা হচ্ছে দেশের প্রধান এ রফতানি খাতকে। এমনটাই দাবি নিট শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ)। এ অবস্থায় নিজেদের স্বার্থে ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিতে নাশকতা থেকে সরে এসে শ্রমিকদের কাজে মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে যখন দেশের অর্থনীতি সংস্কারে ব্যস্ত, তখন হঠাৎ করেই গত মাসের দিকে এসে অস্থির হয়ে ওঠে সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের তৈরি পোশাক শিল্প এলাকা।
শ্রমিকদের দাবি মানতে তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা, আর শিল্পমালিকদের দফায় দফায় বৈঠকেও মিলছে না সুরাহা। রাতে কারখানায় কাজ করার প্রতিশ্রুতি মিললেও দিনের শুরুতেই নানা শঙ্কায় উৎপাদন বন্ধ রাখতে বাধ্য হন অনেক উদ্যোক্তা।
নিট পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিকেএমইএ বলছে, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে ধ্বংস করতেই তৈরি করা হচ্ছে এমন অস্থিরতা। সংগঠনটির সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, সরকার দায়িত্ব নিয়েছে মাত্র এক মাস হয়েছে; তাদের সময় দিতে হবে। রাজপথ নয়, আলোচনার টেবিলেই শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস মোহাম্মদ হাতেমের। তিনি বলেন, শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি বিকেএমইএ সব সময় পাশে আছে। সব সমস্যার সমাধান করা হবে। মোহাম্মদ হাতেম বলেন, নারায়ণগঞ্জের পোশাক কারখানায় গতকাল মঙ্গলবার কোন সমস্যা হয়নি। গাজীপুরেও সমস্যা নেই। অশুলিয়ায় কিছুটা সমস্যা আছে। সব পক্ষের সঙ্গে কথা চলছে দ্রুতই সমাধান হয়ে যাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। একই সঙ্গে আগে শ্রমিকদের আন্দোলন দ্রুত শেষ হয়ে যেত এ বিষয়ে তিনি বলেন, ষড়যন্ত্রকারী পরিবর্তন হয়েছে। আগে শুধু শ্রমিকরা দাবি-দাওয়া করতো। এখন তৃতীয় শক্তি ঢুকেছে। শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া মানলেও আন্দোলন থামছে না। অবশ্য তিনি জানান, ইতোমধ্যে শ্রমিকদের মধ্যে উস্কে দেওয়া ছাত্রলীগ নেতা ইশতিয়াক আহমেদ হৃদয় গ্রেফতার হয়েছে। অন্যান্যদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন হলে বিপাকে পড়বেন শ্রমিকরাই। তাই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে তাদেরই। অর্থনীতিবিদ মাহফুজ কবির বলেন, শ্রমিকরা যদি নিজেদের শিল্পের কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সচেতন না হয়, তাহলে ঝুঁকির মুখে পড়বে এ খাত। তাই কারও উস্কানিতে পা না দিয়ে নিজেদের সচেতন হতে হবে।
বিজিএমইএ সূত্র বলছে, তাদের কাছে মোট ৪২টি কারখানা গতকাল সবেতনে (লিভ উইথ পে) বন্ধ থাকার তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে ৪১টি কারখানা সাভার-আশুলিয়া, জিরানী এলাকায় অবস্থিত। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, মাসকট, লুসাকা, জেনারেশন নেক্সট, রেডিয়েন্স নিটওয়্যার, টেক্স টাউন, ইউফোরিয়াসহ বিভিন্ন কারখানা। এছাড়া ১১টি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা গতকাল কারখানা খোলা থাকলেও কাজ না করে কারখানা থেকে বেরিয়ে গেছে। অন্যদিকে শারমীন গ্রুপ, মন্ডল নিটওয়্যার, ক্রসওয়্যার লিমিটেড, ইয়াগি, গার্মেন্টস এক্সপোর্ট ভিলেজ, প্রিন্স জ্যাকার্ড লিমিটেড, এআর জিন্স প্রডিউসার লিমিটেডসহ অন্তত ২১টি কারখানার শ্রমিকরা কারখানার ভিতরে অবস্থান করে বিভিন্ন দাবিতে বিশৃঙ্খলা করছে বলে জানা গেছে। এর আগে গতকাল কারখানা মালিক, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে গতকাল এক বৈঠকের পর বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে মঙ্গলবার সকাল থেকে সব পোশাক কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই সঙ্গে ছয় ঘণ্টারও বেশি আলোচনার পর উভয় পক্ষই সম্মত হয়েছিল যে নারী-পুরুষ পরিচয়ের ভিত্তিতে এবং নতুন নিয়োগ হবে যোগ্যতা ও কারখানার প্রয়োজনের ভিত্তিতে।
শারমীন গ্রুপের এক নারী শ্রমিক বলেন, সকাল থেকে শ্রমিকরা কারখানায় এলেও বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে বসেছিল। তবে কারখানায় শ্রমিকরা কাজ বন্ধ রাখলেও কোন ঝামেলা করেনি বলেও জানান তিনি।
শিল্প পুলিশ-১’র পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলম বলেন, পরিস্থিতি আগের তুলনায় অনেকটাই স্বাভাবিক। অধিকাংশ কারখানা সকাল থেকে খুলে দেওয়া হয়েছে। কিছু কারখানা গতকাল থেকেই বন্ধ ছিল, আর কারখানার অভ্যন্তরে শ্রমিকদের সাথে মালিকপক্ষের আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ায় ২১টির মত কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এর বাইরে কোথাও কোন সমস্যা হয়নি, সড়ক ও কারখানার বাইরের পরিবেশ স্বাভাবিক রয়েছে। তিনি জানান, শিল্পাঞ্চলের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারি, টহল ও অবস্থান অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে ইন্ডাস্ট্রি সূত্র জানায়, সকাল থেকে বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কের উভয় পাশে অবস্থিত কারখানাগুলোর পরিবেশ ভালো থাকলেও অবনতি হয়েছে কাঠগড়া অঞ্চলে অবস্থিত কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ। গত কয়েকদিন আশুলিয়ার বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কের বাইপাইল থেকে জিরাবো এলাকা পর্যন্ত অঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ থাকলেও অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল কাঠগড়া এলাকায় অবস্থিত কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ। বিচ্ছিন্ন দু’একটি ঘটনা ব্যতীত এই অঞ্চলে বড় কোন শ্রমিক অসন্তোষের সংবাদ পাওয়া যায়নি।