২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই ব্যাংক ও আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকপক্ষ এবং ঊর্র্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জোগসাজশ এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরোক্ষ সহযোগিতার ফলে ব্যাংকগুলোর অনিয়ম, জালিয়াতি ও লুণ্ঠনের প্রকৃত আর্থিক চিত্র দেশের জনগণ জানতে পারেনি, যা বর্তমানে সবার সামনে উন্মোচিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, ২০০৮ থেকে ২০২৩- এই ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ছোট-বড় ২৪টি অনিয়মের মাধ্যমে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। ব্যাংক খাত থেকে অনিয়মের মাধ্যমে বের করে নেয়া এ অর্থ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের ১২ শতাংশের বেশি। অথচ এ অর্থে অনায়াসে বাজেট ঘাটতি মেটানো সম্ভব হতো। তবে এ তথ্য আংশিক, প্রকৃত লোপাটের পরিমাণ অনেক বেশি।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের পর শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি। ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। তারপর থেকে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বাড়তে শুরু করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের ৩১ মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে দুই লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১২.৫৬ শতাংশ। এর সাথে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে এক ভয়ঙ্কর কৌশল যার নাম ঋণ অবলোপন (রাইট অফ)। মন্দমানের খেলাপি ঋণ দীর্ঘদিন আদায় না হলে তা ব্যাংকের মূল ব্যালান্সশিট থেকে আলাদা করে অন্য একটি লেজারে সংরক্ষণ করা হয়, ব্যাংকিং পরিভাষায় যা ঋণ অবলোপন নামে পরিচিত। গত কয়েক বছরে খেলাপি ঋণ অবলোপন বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক ব্যাংক। সব মিলিয়ে খেলাপি ও মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ চার লাখ ৩৯ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। উল্লেখ্য, নতুন বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ও ধরা হয়েছে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে খেলাপি ও মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ এক লাখ ৩৭ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা বা প্রায় ৪৬ শতাংশ বেড়েছে। ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালানোর সময় দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অন্তত দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পরপরই দেশের ব্যাংক খাতে নতুন উদ্যমে লুণ্ঠন শুরু হয়। ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এক কলঙ্কময় অধ্যায় রচিত হয়। এদিন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা ডাকাতির মাধ্যমে ছিনতাই করে নেয় চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ। ইসলামী ব্যাংকের এমডি, চেয়ারম্যানসহ সব পরিচালককে জোর করে বের করে দেয়, এমনকি অনেককে দেশছাড়া করা হয়। পরবর্তীতে আরো ছয়টি ইসলামী ধারার ব্যাংকও দখল করে নেয়। ইতঃপূর্বে ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এস আলম গ্রুপের মালিকানায় ছিল। এভাবেই দেশের মোট সাতটি ইসলামী ব্যাংকে শুরু হয় নানামুখী লুটপাটের মহোৎসব।
১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে ব্যাংকটির ৭০ শতাংশ পুঁজি জোগান দিয়েছিলেন বিদেশীরা। সৃষ্টিলগ্ন থেকেই ঐতিহ্যগতভাবে ব্যাংকটির সব জনশক্তির সততা, জবাবদিহি, শৃঙ্খলা সর্বমহলে প্রশংসিত ছিল। কিন্তু মালিকানা পরিবর্তনের পর থেকেই ব্যাংকটির কিছু কর্মকর্তা যাদেরকে সৎ ও দায়িত্বশীল মনে করা হতো তারা হঠাৎ লাঠিয়াল বনে গেলেন এবং সবার চোখের সামনেই লুটপাটের উৎসবে মেতে উঠলেন। নামে-বেনামে কো¤পানি খুলে বিভিন্ন বিনিয়োগের আওতায় অর্থ সরাতে শুরু করলেন। শুধু বিনিয়োগ নয়, আরো বহুমাত্রিক উপায়ে ব্যাংক থেকে অর্থ বের করে নিতে থাকেন। কোনোরকম নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, বাছবিচার ও ন্যূনতম যোগ্যতা ছাড়াই চট্টগ্রামের মাত্র কয়েকটি থানা থেকে ব্যাংকটিতে হাজার হাজার কর্মী নিয়োগ করা হয়। বলতে গেলে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে সাধারণ ব্যাংকিং শিষ্টাচার মানা হয়নি। এসব নিয়োগে শত শত কোটি টাকার অবৈধ লেনদেনের অভিযোগও পাওয়া যায়। শুধু তাই অন্যান্য ব্যাংকের দুর্নীতির দায়ে চাকরিচ্যুত অথবা অবসরপ্রাপ্ত নির্বাহীদেরকে এ ব্যাংকের উঁচু পদে বসাতে থাকে। আবার ব্যাংকের অনেক ভালো কর্মীদেরও লোপাট কার্যক্রমে সহযোগিতা করতে বাধ্য করা হতো। দুর্নীতিবাজদের দাম্ভিকতা ও হুঙ্কারে সাধারণ ব্যাংকাররা তটস্থ থাকতেন। ইতোমধ্যে বহু সৎ, নিষ্ঠাবান ও প্রতিভাবান কর্মকর্তা ব্যাংক ছেড়ে চলে গেছেন এবং অনেককে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। সব ধরনের নিয়মনীতি ও আইন-কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা প্রতি বছর এমনকি বছরে একাধিক সময়ে পদোন্নতি পেতে শুরু করলেন। ফলে অল্প সময়ের মধ্যে তারা বনে গেলেন বড় কর্মকর্তা ও ব্যাংকের নীতিনির্ধারক। ২৪ নভেম্বর ২০২২ ইসলামী ব্যাংকের ভয়াবহ চিত্র প্রথমবারের মতো জানা যায় পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভয়ঙ্কর নভেম্বর’ শিরোনামে সংবাদের মাধ্যমে। খবরে বলা হয়, ব্যাংকটির বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে নানা প্রতিষ্ঠানের নামে-বেনামে এমনকি কোনো প্রকার কাগজপত্র ছাড়াই হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে যায়। আমরা আশা করি, অত্যন্ত দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী তদন্তের মাধ্যমেই লোপাটের প্রকৃত অর্থের পরিমাণ নির্ণয় এবং দায়ীদেরকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।
সিপিডির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালের পর ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বড় ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটে বেসিক ব্যাংকে। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নানা অনিয়মের মাধ্যমে এ ব্যাংকটিতে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার লুটপাটের ঘটনা ঘটে। বেসিক ব্যাংকের আলোচিত ঋণ কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত ছিলেন ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু। তার বিরুদ্ধে দুদকের পক্ষ থেকে ৫০টির বেশি মামলা করা হলেও বাচ্চুকে এখনো গ্রেফতার করা হয়নি। বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির পাশাপাশি প্রায় একই সময়ে ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে আলোচিত আরেক ঘটনা ছিল রাষ্ট্র মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি। এতে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার অনিয়ম হয়। এ ছাড়া ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কয়েক ধাপে জনতা ব্যাংকে ঘটে ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা। ২০২১ সালে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক) ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকা অবস্থায় প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের আর্থিক খাতে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের ঘটনা সামনে আসে। এ ছাড়া পদ্মা ব্যাংকের কাছে এখন গ্রাহকদের আমানত রয়েছে ছয় হাজার ১০০ কোটি টাকা। এ আমানত থেকে পাঁচ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকটি। তবে বিতরণকৃত ঋণের অর্ধেকের বেশি এখন খেলাপি। পদ্মা ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল দ্য ফারমার্স ব্যাংক নামে। চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক হিসেবে ২০১৩ সালে কার্যক্রম শুরু করেছিল ব্যাংকটি। কিন্তু নজিরবিহীন ঋণ জালিয়াতি ও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে কার্যক্রম শুরুর তিন বছরের মধ্যে ব্যাংকটি মুখ থুবড়ে পড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ছিল ৬৫ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালের মার্চে বেড়ে হয়েছে ৮৪ হাজার ২২১ কোটি টাকা। পদ্মা ব্যাংক পিএলসির জন্ম ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির নানা অনিয়মকে পেছন থেকে সায় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক খাতের অনিয়ম সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করতে না পারে সে জন্য চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
ইসলামী ব্যাংকসহ ব্যাংকিং সেক্টরের প্রকৃত লুটপাটের চিত্র আশা করি শিগগিরই জানা যাবে। বিগত সময়ে ব্যাংকিং সেক্টরের দুর্নীতি সম্পর্কে অবহিত থাকলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমগুলো প্রকাশ করার সাহস পায়নি।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের কাছে প্রত্যাশা করছি, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের প্রকৃত জালজালিয়াতির তথ্য জাতির সামনে প্রকাশ করা হবে। ব্যাংক খাত আমূল সংস্কারের আওতায় আনতে হবে। যেনতেনভাবে অর্থ লোপাটের ফাঁকফোকর বন্ধ করতে হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে লোপাটকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যাংকে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রয়োজনে ব্যাংকার্স রিক্রুটমেন্ট কমিটির আদলে সব বেসরকারি ব্যাংকের নিয়োগ কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় কিনা ভাবা যেতে পারে, যাতে মেধাবীরা এ খাতে নেতৃত্ব দিতে পারে। ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করে জনগণের আমানত সুদৃঢ় এবং দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে হবে। মোট কথা, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে টেকসই শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শহীদের আত্মত্যাগ ও লাখ তরুণ-তরুণীর আকাক্সক্ষা সার্থক করতে হবে।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক