রাজনীতি কি কোনো রঙ্গমঞ্চের বিষয়, নাকি সঙ্গত সমাজ গঠনের সাধনা? অধিকার সচেতন মানুষতো মানবিক জীবনযাপনের লক্ষ্যেই সমাজবদ্ধ হয়েছিল। মানবিক হতে হলো তো ন্যায়কে মানতে হয়, অপরকে জানতে হয় এবং সংযত ও সহিষ্ণুতার সৌন্দর্যে মন্ডিত হতে হয়। এ বিষয়গুলো শুধু জনগণের জন্য নয়, শাসকদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, শাসকদের তথা বড়দের উদাহরণ থেকেই তো মানুষ শিখবে। আমাদের নেতারা, শাসকরা যে ন্যায়ের কথা, ত্যাগের কথা, সহিষ্ণুতার কথা বলেন না, তা কিন্তু নয়। তাঁরা বলেন এবং একটু বেশিই বলেন। তবে দুঃখের বিষয় জাগে, নেতারা কি জনগণের সামনে অভিনয় করে যাচ্ছেন? রাজনীতির মঞ্চ কি তাহলে রঙ্গমঞ্চ? এমন প্রশ্ন শুধু আমাদের দেশে নয়, উন্নত দেশগুলোতেও উত্থিত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ একটি নতুন নির্বাচনের অপেক্ষায় আছে। তাঁরা এখন ঝলমলে রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের দর্শক। বিষয়টি তাঁরা হয়তো উপভোগও করছেন। তবে উপভোগ এক কথা, আর কথামালার বিপরীতে কাক্সিক্ষত ফল লাভ ভিন্ন কথা। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী রঙ্গমঞ্চে এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং কমলা হ্যারিস। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দেখছেন এবং বিশ্লেষণও করছেন। এইতো সেদিন শিকাগোতে ডেমোক্রেটিক পার্টির জমকালো এক কনভেনশন তথা প্রদর্শনী হয়ে গেল। এই শোতে মনমাতানো গানবাজনা ছিল, আবেগঘন বক্তৃতা ছিল। ভক্তিময় ধর্মীয় আচার ছিল। অশ্রুর বর্ষণ ছিল। অনেক প্রতিশ্রুতি ছিল। রঙবেরঙের বেলুনের বাতাবরণে আনন্দঘন নানা বিষয়ও ছিল। এমন এক পরিবেশে কমলা হ্যারিস নিজেকে উপস্থাপন করলেন। টেলিভিশন ভাষ্যকাররা তার প্রাণবন্ত বর্ণনা দিতে গিয়ে কমলার হাসি, তাঁর শারীরিক ভাষা, কণ্ঠমাধুর্য এবং আকর্ষণীয় পোশাকের বিষয়টিও তুলে ধরেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এই প্রদর্শন-প্রবণতা সব সময়ই লক্ষ্য করা গেছে। তবে শুধু প্রদর্শন নয়, বিনোদনের একটি আয়োজনও সেখানে থাকে। এসবই ভোটারদের মনোরঞ্জনের জন্য। তবে এসব পছন্দ করতেন না যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সাংবাদিক এইচ এল মেনকেন। তিনি রাজনীতিবিদদের ঘৃণা করতেন এবং বলতেন, বেশির ভাগ মার্কিন রাজনীতিকের রাজনীতির জ্ঞানই নেই। মেনকেন ১৯২৭ সালে লিখেছিলেন, ‘আমার চোখে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও অতুলনীয় প্রদর্শনী মঞ্চ হলো যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন।’ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একটি প্রশ্ন হলো, নির্বাচনে দাঁড়াতে হলে কি প্রার্থীদের তাঁদের পরিবারের প্রতি ভালোবাসার বিষয়টিও মঞ্চে গিয়ে দেখাতে হবে? মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বামী-স্ত্রী কিংবা স্বজনদের আলিঙ্গন করা ও চুমু খাওয়ার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্কটা কী? ভোটারদের মন জয় করার জন্য আন্তরিকতা বা ভালোবাসার বাজারি প্রদর্শন কি আসলেই জরুরি? এমন বাক্যবানের মধ্যেই আমেরিকার রাজনীতিতে চলছে ভালোবাসার প্রদর্শন, কখনো বা অশ্রুর। মার্কিন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, হলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মতো রাজনীতিও আসলে একটি নির্মম প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসা, যেখানে ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলো বিক্রি করা হয়। উচ্চাকাঙ্খা পূরণের জন্য হলিউডে এবং দলীয় কনভেনশনের রঙ্গমঞ্চে স্বামী-স্ত্রী এবং সন্তানদের প্রতি প্রকাশ্যে প্রেম ও ভালোবাস প্রকাশ করতে হয়। মার্কিন রাজনীতিতে নেতা-নেত্রীদের এখন নিজের সেল-ভ্যালু বা ‘বিক্রয় মূল্য’ বাড়াতে হয়। ফলে রাজনীতিকেরা সেখানে একজন ‘পারফরমার’ বা অভিনেতা হিসেবেও আবির্ভূত হচ্ছেন।
লেখার শুরুতে আমরা প্রশ্ন রেখেছিলাম, রাজনীতি কি কোনো রঙ্গমঞ্চের বিষয়, নাকি সঙ্গত সমাজ গঠনের সাধনা? মার্কিন রাজনীতি, বিশেষ করে নির্বাচনী রাজনীতি অনেকটাই রঙ্গমঞ্চের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এমন রাজনীতি কোনো দেশে সঙ্গত সমাজ গঠনে সমর্থ হবে কেমন করে? কাক্সিক্ষত সমাজ গঠনে তো সাধনা প্রয়োজন। সেখানে তো প্রদর্শন-প্রবণতা তথা অভিনয়ের কোনো জায়গা নেই। বর্তমান সভ্যতায় বড় বড় দেশের বড় বড় নেতারাই শুধু অভিনয় করছেন না; ছোটো ছোটো দেশের, পাশের দেশের নেতাদেরও তারা পাশর্^চরিত্রে অভিনয় করার আহ্বান জানাচ্ছেন। ভূরাজনীতির নামে পান্ডুলিপি তৈরি করে অভিনয়ের নির্দিষ্ট চরিত্রও ঠিক করে দিচ্ছেন। ফলে এখন পৃথিবীর বহু দেশেরই স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অটুট নেই। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ধরে পান্ডুলিপির বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করে গেছেন। বাংলাদেশের মহিমান্বিত স্বাধীনতা সংগ্রাম, ৭ই মার্চের ভাষণ, ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকান্ডকে আমরা বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে থাকি। কিন্তু এই বিষয়গুলোকে কেউ যদি বারবার ক্ষমতায় থাকার জন্য ব্যবহার করেন, গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলোকে স্থূলভাবে বিক্রি করে নিজেকে মহীয়ান করে তুলতে চান এবং তা করতে গিয়ে অশ্রুসজল হয়ে অভিনয় করেনÑতবে তার পরিণতি কি কখনো ভালো হতে পারে? ভালো যে হয় না, তার প্রমাণ ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান। গণঅভ্যুত্থানে দীর্ঘদিনের স্বৈরাশাসক শেখ হাসিনাকে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়েছে।
শেখ হাসিনাকে স্বৈরশাসক ও রাজনৈতিক রঙ্গমঙ্গের অভিনেত্রী হিসেবে আখ্যায়িত করার মধ্যে আমরা কোনো সুখ অনুভব করি না। বরং এতে আমরা আহত হই, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের আত্মসম্মান ক্ষত-বিক্ষত হয়। কারণ, তিনি আমাদের প্রিয় স্বদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিশে^ পরিচিত ছিলেন। একজন প্রধানমন্ত্রী কী করে এমন হন? স্বাধীনতার স্থপতির কন্যা কী করে দেশের স্বাধীনতাকে এভাবে বিকিয়ে দেন? দেশের আদালত, প্রশাসন, সংসদ-সংবিধান, আইন-শৃংখলা বাহিনী, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। স্বৈরশাসনকে অব্যাহত রাখতে গিয়ে দলীয় নেতা-নেত্রী এবং মন্ত্রী-এমপিদের লুন্ঠন, দুর্নীতি, জুলুম-নির্যাতনের নিষ্ঠুর কর্মে সহযোগিতা করে গেছেন তিনি। দেশবিরোধী এমন স্বৈরশাসককে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতা মেনে নিতে পারেনি। তাদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ যৌক্তিক পরিণতি লাভ করেছে জুলাই মাসের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। জাতির আশংকা পূরণে এখন প্রয়োজন বহুবিদ সংস্কার। আইন-আদালত, প্রশাসন, বাহিনী, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, নির্বাচন ব্যবস্থা, আসলে সবকিছুরই এখন সংস্কার প্রয়োজন। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতটা করতে পারবেন? তাদের সময়ের সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সংস্কারের শুরুর কাজগুলো করার মত যৌক্তিক সময় দেবেন তো? পরীক্ষা শুধু ইউনূস সরকারের জন্য নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও বটে। আশাকরি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বার্তা কেউ ভুলে যাবেন না।