বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কোন বিবেচনায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে আলোচনা করেন? বাংলাদেশ কি তার অর্থাৎ ভারতের আশ্রিত রাজ্য? বাংলাদেশ কি ভারতের করদ রাজ্য? বেগম খালেদা জিয়া যখন ১৯৯১-৯৬ মেয়াদে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন বিএনপি একটি শ্লোগান দিত, “সিকিম নয় ভুটান নয়/এদেশ আমার বাংলাদেশ”। ৯৬ এর নির্বাচনে বেগম জিয়া ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই শ্লোগান আর শোনা যায়নি। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত ঐ ধরনের কোনো শ্লোগান আর শোনা যায়নি। বরং বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের কাব্য শুনতে শুনতে অতীতের ভারতের প্রভুসুলভ আচরণ আমরা বাংলাদেশীরা এক রকম ভুলেই গিয়েছিলাম। চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি ‘আমি আর ডামির’ নির্বাচনের পর বিএনপির মুখে আবার ভারত বিরোধিতার কথা শোনা গেল। কারণ সম্ভবত এই যে সারা দেশের মানুষ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গেলেও ভারত শেখ হাসিনাকে অন্ধ সমর্থন দিয়ে তাকে ক্ষমতায় রেখে দেয়। ফলে ভারত বাংলাদেশের ১৭ কোটি জনগণের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেয়। শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনের নামে ভারতের গোলামী করার কারণে ভারতের সাহস বেড়ে গেছে। তাই তারা আমাদেরকে অর্থাৎ বাংলাদেশকে তাদের নাচের পুতুল মনে করে আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলে।
আমেরিকা ২০২১ সাল থেকেই গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসন নিয়ে যেসব কথা বলে সেগুলি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গিয়েছিল। এগুলোরই এক পর্যায়ে আমেরিকা বাংলাদেশে র্যাবের ৭ জন শীর্ষ কর্মকর্তাসহ বাহিনী হিসেবে র্যাবের ওপর স্যাংশন আরোপ করে। এটি ছিল একটি কঠোর পদক্ষেপ। হাসিনা সরকার সম্পর্কে জো বাইডেনের সরকারের নেতিবাচক মনোভাব গত বছরের অক্টোবরের ২৭ তারিখ পর্যন্ত ছিল। কিন্তু তারপর আমেরিকার সুর অকস্মাৎ নরম হয়ে যায়। কেন নরম হয়ে যায় সে সম্পর্কে শেখ হাসিনার সাবেক বেসরকারি বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ফাঁস করে দিয়েছেন। শেখ হাসিনার সাথে মিলে অনেক অপশাসন ও অনেক অপকর্মের সাক্ষী গোপাল সালমান এফ রহমান এখন হাজত বাস করছেন। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেওয়া এবং সারা জীবন বিত্ত-বৈভবের পাহাড়ের মধ্য দিয়ে জীবন চালানো সালমান এফ রহমান এখনও ডিবির প্রকোষ্ঠে তার আরেক দোসর সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সাথে দিন গুজরান করছেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের রিমান্ডে আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে সালমান এফ রহমান বলেন, আমাকে আটকে রাখলে, আমার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ৮০ হাজার লোক বেতন পাবে না। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে যে ঋণ নেওয়া হয়েছে সেই ঋণের কিস্তি দিতে পারব না। এতে দেশেরই ক্ষতি হবে। তাই আমাকে ছেড়ে দিন। আমি দেশ ঠিক করে দেব।
এ সময় ডিবি কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনি ঠিক করলে এখানেই করুন। কোর্টে গিয়ে কথা বলুন। কিন্তু আপনাকে ছাড়া হবে না। একের পর এক মামলায় কমপক্ষে এক বছর আপনাকে রিমান্ডে থাকতে হবে।’ সালমান এফ রহমানের কাছে ডিবির জিজ্ঞাসা- ‘গত নির্বাচনের আগেই তো আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার কথা ছিল। তখন হয়নি কেন?’ উত্তরে সালমান বলেন, আমরা ভারতের মাধ্যমে আমেরিকাকে ঝুঝাতে পেরেছিলাম যে, আমরা আমেরিকার পক্ষেই আছি। বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। তখন আমাদের এবং ভারতের কথায় আমেরিকা কনভিন্সড হয়েছিল। না হলে তখনই আমাদের পতন হয়ে যেত।’
সালমান এফ রহমানকে ডিবি কর্মকর্তারা বলেন, ‘মামলা তো মাত্র শুরু। কতগুলো মামলা হবে তা আমরাও জানি না। আপনাকে শুধু আদালতে যেতে হবে আর ডিবিতে আসতে হবে। এ সময় সালমান এফ রহমান বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের সময় ২ বছর জেল খেটেছি। সুতরাং সমস্যা হবে না। তিনি আরও বলেন, আমাকে জেলে রাখলে দেশের ক্ষতি হবে। কারণ আমার নানা প্রতিষ্ঠানে অনেক কর্মী আছে। তারা বেতন পাবে না। ব্যাংক থেকে যেসব টাকা ঋণ নিয়েছি সেগুলো পরিশোধ হবে না।
॥ দুই ॥
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে আমেরিকার সাথে কথা বলে আমেরিকাকে কনভিন্স করে ভারত শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। কিন্তু এখন গনেশ উল্টে গেছে। গত ৫ আগস্ট শুধু শেখ হাসিনাই যে দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে গেছেন তাই নয়, এ পর্যন্ত কয়েক হাজার আওয়ামী নেতা ও কর্মী হয় পালিয়ে ভারত ও অন্যান্য দেশে গেছেন, অথবা দেশের মধ্যেই আন্ডারগ্রাউন্ডে আছেন। বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ যে আওয়ামী লীগের আন্ডা বাচ্চাকে পাতি পাতি করে খুঁজছেন সেটার খবর সম্ভবত মোদি সাহেব রাখেন না। তাই এবারও তিনি বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে কথা বলেছেন।
ভারত বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা ঠিকই জানে। কারণ তারা বাংলাদেশের সাড়ে ১৫ বছরের একচ্ছত্র স¤্রাজ্ঞী শেখ হাসিনাকে কঠোর গোপনীয়তায় নিরাপদ স্থানে রেখেছে। খবরে প্রকাশ, কোনো এক জায়গায় তাকে এক নাগাড়ে বেশি দিন রাখা হয় না। কেন রাখা হয় না সেটি ভারত সরকার জানে। কিন্তু ভারতীয় পত্র পত্রিকার রিপোর্ট মোতাবেক তার নাকি নিরাপত্তা ঝুঁকি আছে। ভারতের মাটিতে আবার শেখ হাসিনার কিসের নিরাপত্তা ঝুঁকি? সেটি আমাদের বোধগম্য নয়। তবে ভারতীয় মিডিয়ার খবর মোতাবেক ৩/৪ দিন পরপরই নাকি শেখ হাসিনার শেল্টার বদল করা হয়।
আমেরিকা বাংলাদেশের সমগ্র দৃশ্যপটের ৩৬০ ডিগ্রি উল্টে যাওয়ার খবর পুরাটাই জানে। মোদি বাইডেনের সাথে কি কথা বলেছেন সেটি তিনি নিজেই টুইট করে (সাবেক টুইটার বর্তমানে এক্স) জানিয়েছেন। তার এক্স হ্যান্ডেলে তিনি বলেছেন, In his recent tweet, Indian Prime Minister Narendra Modi stated that while talking to US President Joe Biden, they spoke about Ukraine, and “also discussed the situation in Bangladesh and stressed the need for early restoration of normalcy, and ensuring the safety and security of minorities, especially the Hindus, in Bangladesh”.
Not just Prime Minister Modi, the Indian foreign ministry’s brief states that the two leaders “expressed their shared concern” about the situation in Bangladesh. The two leaders hoped that “safety and security of the minorities, particularly Hindus, in Bangladesh” would be ensured.
অনুবাদ: বাইডেনের সাথে আলাপকালে তারা ইউক্রেন সম্পর্কে আলোচনা করেন। একই সাথে তারা বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা করেন। তারা বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের বিশেষকরে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করেন। মোদির এই টুইট ছাড়াও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বলেন যে দুই নেতা বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে তাদের অভিন্ন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। দুই নেতা আশা প্রকাশ করেন যে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের বিশেষ করে হিন্দুদের নিরাপত্তা বাংলাদেশ নিশ্চিত করবে।
॥ তিন ॥
এই ছিল মোদি ও বাইডেনের ফোন আলাপ নিয়ে ভারতীয় বয়ান। কিন্তু সবচেয়ে তাজ্জবের ব্যাপার হলো এই যে মার্কিন প্রেসিডেন্টের অফিস কাম রেসিডেন্স হোয়াইট হাউজ থেকে যে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে সেখানে বাংলাদেশের কোনো কথা নাই। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষকরা বলেন যে বাংলাদেশ পরিস্থিতি, বিশেষ করে বাংলাদেশের হিন্দুদের সম্পর্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং পরিবর্তিত বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে ভারত যে অবস্থান গ্রহণ করেছে তার সাথে মার্কিন সরকার একমত নয়।
আমেরিকার বিখ্যাত থিংক ট্যাংক উলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন যে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পোল্যান্ড ও ইউক্রেন সফর করেছেন। কয়েক দশকের মধ্যে কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এটিই প্রথম ঐসব দেশ সফর। এই সফরে ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কে মোদি যা বলেছেন বাইডেন সেটির প্রসংশা করেছেন। কূটনীতির নিয়ম কানুন বিশেষ করে মার্কিনী কূটনীতির নিয়ম কানুন এই যে যখন দ্বিপাক্ষিকভাবে তারা তৃতীয় কোনো দেশ নিয়ে আলাপ আলোচনা করে তখন যে সব বিষয়ে তারা তাদের কাউন্টার পার্টের সাথে একমত হয় না সেই সব বিষয় মার্কিনী প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয় না। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত (ডিশটিংগুইশড) প্রফেসর আলী রিয়াজ মনে করেন যে মোদি হয়তো বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু বাইডেন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তার সাথে একমত হননি। তাই মার্কিন প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ স্থান পায়নি।
॥ চার ॥
আমরা এ ব্যাপারে একটি কঠোর শব্দ ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছি। সেটি হলো, মোদি বাইডেন আলোচনায় মোদির উদ্বেগ বাইডেন শেয়ার করেছেন বলে মোদি তার এক্স হ্যান্ডেলে যা বলেছেন সেটি একটি ডাঁহা মিথ্যাচার। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার তখতে তাউস উল্টে গেছে। এটি স্বাভাবিকভাবে উল্টে যায়নি। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নয়, কোটি মানুষ রাস্তায় নেমে গণভবন থেকে শেখ হাসিনাকে বহিষ্কারের জন্য ছুটে আসছিলেন। তার জীবন বাঁচানোর জন্য জেনারেল ওয়াকারুজ্জামান সামরিক হেলিকপ্টারযোগে হাসিনাকে ভারত পাঠিয়ে দেন। এভাবে তিনি হাসিনার জীবন রক্ষা করেন।
এবার বাংলাদেশে যেটি ঘটলো সেটি একটি গণবিপ্লব। অনেকেই এটিকে গণঅভ্যুত্থান বলছেন। কিন্তু আমি এবং অনেকেই এটিকে বাংলাদেশের সর্বশ্রেণীর মানুষের, অর্থাৎ আবালবৃদ্ধবনিতার বিপ্লব বলে মনে করি। শুধুমাত্র শেখ হাসিনার যারা উচ্ছিষ্ট ভোগ করেছেন তারা ছাড়া আর সমস্ত মানুষ এই বিপ্লবে শামিল হয়েছিলেন। শুক্রবার ৩০ আগস্টে সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেছেন যে ছাত্র জনতার এই বিপ্লবে ১ হাজারেরও বেশি মানুষ শহীদ হয়েছেন। এ পর্যন্ত যে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে সেই তথ্য মোতাবেক অন্তত ১০ হাজার ছাত্র জনতা আহত হয়েছেন। গণবিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানে এত বিপুল সংখ্যক মানুষের শাহাদত বরণ করা ও আহত হওয়ার ইতিহাস এই উপমহাদেশে বিগত ৪০০ বছরেও খুঁজে পাওয়া যায় না। মোদি জেনেও না জানার ভান করলে কি হবে, আমেরিকা এসব তথ্য বিলক্ষণ জানে। গত নির্বাচনের আগে যেসব জাল জালিয়াতির তথ্য দিয়ে নরেন্দ্র মোদি মার্কিন প্রশাসনকে উল্টাপাল্টা বোঝাতে পেরেছিলেন এবার আর সেটি সম্ভব হয়নি। ভবিষ্যতেও আর সেটি সম্ভব হবে না।
মনে রাখতে হবে, ১৯৭১ সালের পর এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা। এবার অর্থাৎ ২০২৪ সালে বাংলাদেশ তার দ্বিতীয় স্বাধীনতায় ভারতের গোলামীর জিঞ্জির ছিন্ন করেছে। ঐ শিকল আর বাংলাদেশীদের পায়ে পরানো সম্ভব হবে না। কারণ বাংলাদেশে আর কোনো ভারতীয় গোলাম পয়দা করতে দেবেন না এদেশের ১৭ কোটি ২০ লক্ষ জাগ্রত জনতা। আমেরিকা বা অন্য কোথাও ধরনা দিয়ে নরেন্দ্র মোদির আর কোনো লাভ হবে না।
Email: asifarsalan15@gmail.com