শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে উদ্যোক্তাদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ এবং পরিচালকের ব্যক্তিগতভাবে ২ শতাংশ শেয়ার থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু এই নিয়মের তোয়াক্কা করেনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন আইএফআইসি ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটিতে উদ্যোক্তাদের শেয়ার মাত্র ৬ দশমিক ০৪ শতাংশ। অর্থাৎ নির্ধারিত শেয়ার ছাড়াই ব্যাংকটির পর্ষদে সালমানের আধিপত্য চলছে। কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকায় তার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, উলটো তাকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগকে উদ্যোক্তা শেয়ার হিসাবে দেখিয়েছেন তিনি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আইন লংঘন করলে ওই সব কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। না হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন যুগান্তরকে বলেন, নিয়ম অনুসারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে উদ্যোক্তাদের ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকা বাধ্যতামূলক। এটি সব কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু আইএফআইসি ব্যাংক সরকারি শেয়ারকে উদ্যোক্তা শেয়ার হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করছে। এটি যৌক্তিক নয়। কারণ সরকার এই ব্যাংকটির শেয়ার বাজার থেকে কিনেছে। এরপর পর্ষদে তাদের একজন প্রতিনিধি দিয়েছে। কিন্ত সরকার শুরু থেকে বিনিয়োগ না করলে, বাজার থেকে কেনা শেয়ারকে উদ্যোক্তা শেয়ার হিসাবে দেখানোর সুযোগ নেই। তিনি বলেন, এই কোম্পানির মালিক সালমান এফ রহমান প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত উপদেষ্টা ছিলেন। সে কারণে বিএসইসি কোম্পানিটিকে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। অন্য কোম্পানি হলে এই সুবিধা তারা দিত না। সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন আরও বলেন, এই সুবিধা ছাড়াও ক্ষমতার কারণে সালমান এফ রহমান সুকুক বন্ডসহ শেয়ারবাজার থেকে আরও সুবিধা পেয়েছেন। ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রেও পেয়েছেন অতিরিক্ত সুবিধা। ফলে সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, ক্ষমতায় থাকার কারণেই তাকে এসব সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। তার মতে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে আইন সবার জন্য সমান হওয়া জরুরি।
জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম শনিবার যুগান্তরকে বলেন, তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তাদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ এবং পরিচালকদের ব্যক্তিগতভাবে ২ শতাংশ থাকা বাধ্যতামূলক। কোনো কোম্পানির এর চেয়ে কম থাকলে বিষয়টি পর্যালোচনা করে বিধি অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে বিদেশে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর দেশেই পালিয়ে ছিলেন তার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। গত মঙ্গলবার তিনি সদরঘাট থেকে কোস্ট গার্ডের হাতে গ্রেফতার হন। নিউমার্কেট থানায় পুলিশের করা মামলায় বুধবার তাকে ১০ দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। এর পরই তার নামটি সামনে আসে। এখনো তিনি রিমান্ডে আছেন।
জানা গেছে, সিকিউরিটিজ আইন অনুসারে প্রত্যেক কোম্পানিতে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ন্যূনতম ৩০ শতাংশ এবং পরিচালকদের ব্যক্তিগতভাবে ২ শতাংশ শেয়ার থাকা বাধ্যতামূলক। এক্ষেত্রে কোনো কোম্পানি এই শর্ত পূরণ না করা পর্যন্ত রাইট এবং বোনাস শেয়ার ইস্যুসহ বাজার থেকে নতুন করে মূলধন সংগ্রহ করতে পারবে না। কোনো পরিচালক এই শর্ত পূরণ করতে না পারলে তার পদ হারাতে হবে। কিন্তু আইএফআইসি ব্যাংকের ১৯২২ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের মধ্যে উদ্যোক্তাদের ৬ দশমিক ০৪ শতাংশ, সরকারের ৩২ দশমিক ৭৫ শতাংশ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ২১ দশমিক ১১ শতাংশ, বিদেশিদের দশমিক ৬৪ শতাংশ এবং ৩৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ। আবার উদ্যোক্তাদের শেয়ারের মধ্যে সালমান এফ রহমানের ২ শতাংশ, তার ছেলে শায়ান এফ রহমানের ২ দশমিক ১১ এবং ট্রেড নেক্সট ইন্টারন্যাশনালের পক্ষে এআরএম নাজমুস সাকিবের ২ দশমিক ০৩ শতাংশ। অথচ এই স্বল্প পরিমাণ শেয়ার দিয়ে উদ্যোক্তারা পুরো কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করছেন। অর্থাৎ তারাই এই কোম্পানির মালিক। ফলে এসব কোম্পানি দেউলিয়া হলেও উদ্যোক্তারা খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। এ কারণে ওই কোম্পানির প্রতি মালিকপক্ষের দায়বদ্ধতা কম। এদিকে উদ্যোক্তাদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার না থাকলে বোনাস বা রাইট শেয়ার ঘোষণা করার কথা নয়। কিন্তু আইন লংঘন করে ২০২৩ সালে ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার ঘোষণা করে আইএফআইসি ব্যাংক। এ ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি বিএসইসি। তবে এক্ষেত্রে সরকারি ৩২ দশমিক ৭৫ শতাংশ শেয়ারকে উদ্যোক্তা শেয়ার দেখিয়েছে ব্যাংকটি।
জানতে চাইলে আইএফআইসি ব্যাংকের কোম্পানি সেক্রেটারি মোকাম্মেল হক শনিবার যুগান্তরকে বলেন, শুরুতেই আমাদের ব্যাংকের মালিকানায় সরকার রয়েছে। ফলে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে আমাদের কোম্পানি। ফলে সরকারেরও উদ্যোক্তা শেয়ার হিসাবে গণ্য হবে।
জানা গেছে, শেয়ারবাজারে বড় বিপর্যয়ের পর ২০১১ সালের ২২ নভেম্বর তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালকদের এককভাবে ২ শতাংশ উদ্যোক্তাদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে বিএসইসি নির্দেশনা জারি করে। পরবর্তী ৬ মাস অর্থাৎ ২০১৩ সালের ২১ মের মধ্যে নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। এই নির্দেশনা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরই ৪ কোম্পানির ১৪ জন পরিচালক আদালতে রিট করেন। আর শেষ পর্যন্ত পরিচালকদের রিট খারিজ করে বিএসইসির সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন আদালত। পরবর্তীতে এটি কোম্পানি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু যারা এই আইন মানছেন না তাদের বিরুদ্ধে এতদিন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এদিকে ক্ষমতার দাপটে শেয়ারবাজার থেকে শর্তহীন সুবিধা পেয়ে আসছেন সালমান এফ রহমান। গত তিন বছরে শেয়ারবাজার থেকে দৃশ্যমান ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা নিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে বেক্সিমকো সুকুক বন্ড ৩ হাজার কোটি, আইএফআইসি আমার বন্ড ১ হাজার কোটি এবং বেক্সিমকো জিরো কুপন বন্ড ছেড়ে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা নিয়েছেন।
তবে অদৃশ্য ও বেনামি মিলিয়ে ৩ বছরেই ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এদিকে সুকুক বন্ড কেনার জন্য বিভিন্ন ব্যাংককে বাধ্য করা হয়। অন্যদিকে পতন ঠেকাতে সালমানের কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেডকে এখনো ফ্লোর প্রাইস (নিুসীমা) দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে।