বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় রাজধানীর বেশির ভাগ থানাসহ দেশের শত শত থানায় ব্যাপক ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। এরই মধ্যে ৫ জুলাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর নিজেদের জীবন রক্ষায় আত্মগোপনে চলে গেছেন পুলিশের বেশির ভাগ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
অধস্তনরাও গা-ঢাকা দেন। এমন অবস্থায় পুলিশ প্রধান (আইজিপি), ডিএমপি প্রধান ও র্যাবের প্রধানসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি পদে নতুন মুখ আনা হয়। দায়িত্ব নেওয়ার পর আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম বাহিনীর সবাইকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিজ নিজ কর্মস্থলে ফেরার নির্দেশনা দেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় সেই ২৪ ঘণ্টা পার হলেও বেশির ভাগ কর্মকর্তা ও অধস্তনরা কর্মস্থলে ফেরেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কর্মস্থলে ফেরেননি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপির) বেশির ভাগ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। ফেরেননি অধস্তনরাও। তবে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপকমিশনার (ডিসি) থেকে সহকারী কমিশনার (এএসপি) পদমর্যাদার কেউ কেউ কাজে যোগ দিয়েছেন। অধস্তনরা বলছেন, নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টি হলেই কাজে ফিরবেন তারা। তবে কাজে ফেরার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টির একটি অভিযোগকে গুজব বলছে পুলিশ সদর দপ্তর। বর্তমান গুমোট পরিবেশে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যরা নতুন আইজিপির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছেন। তার আলোকে একটি কমিটি করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেনাবাহিনীর সহায়তায় দেশের সব থানার কার্যক্রম শুরু করার বিষয়ে বৃহস্পতিবার তিন বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।
পরিদর্শক থেকে মাঠ পর্যায়ের সদস্যদের অনেকের সঙ্গে বৃহস্পতিবার কথা হয় যুগান্তরের। অধস্তন কর্মকর্তারা বলছেন, বহু পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। রাজধানীর ৫-৭টি থানা ছাড়া বেশির ভাগ থানা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এমন অবস্থায় কর্মস্থলে ফেরার কোনো পরিবেশ নেই। অন্যদিকে পুলিশ বাহিনীতে সংস্কারে ১১ দফা দাবি বাস্তবায়নে কর্মবিরতিতে আছেন অধস্তন কর্মকর্তাসহ মাঠপর্যায়ের সদস্যরা। তাদের দাবি বাস্তবায়নে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ শুরু এবং স্বাভাবিক কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করা ছাড়া কেউ কাজে ফিরবেন না বলে সিদ্ধান্তে অনড় আছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, কাজে ফেরার ক্ষেত্রে পুলিশ পরিচয় জানতে পেরে বাধা দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। তবে এমন অভিযোগকে গুজব দাবি করে উলটো জনতা সহযোগিতা করছে বলে উল্লেখ করেছে পুলিশ সদর দপ্তর।
কর্মবিরতি ঘোষণার পর গত কয়েকদিন পুলিশ সদর দপ্তর, ডিএমপি ও ডিবি কার্যালয়ে দু-চারজন ছাড়া কোনো পুলিশ সদস্যই ছিলেন না। বিমানবন্দরসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতেও চোখে পড়েনি পুলিশের কার্যক্রম। ফলে বুধবার নবনিযুক্ত আইজিপি দায়িত্ব গ্রহণ করার পরই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্ব স্ব ইউনিটে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেন। পুলিশের কী পরিমাণ সদস্য কাজে ফিরেছেন তার হিসাবও পাওয়া যায়নি পুলিশ সদর দপ্তর ও ডিএমপির মিডিয়া সংশ্লিষ্টদের কাছে। দুপুর ২টা পর্যন্ত ডিবিতে ১২২ জন প্রবেশের তথ্য রেজিস্টারে পাওয়া যায়।
পুলিশ সদর দপ্তর বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, পুলিশ সদস্যরা তাদের কর্মস্থলে ফিরতে নানা বাধার মুখে পড়ছেন বলে যে তথ্য ছড়িয়েছে, তা সত্য নয়। এ ধরনের গুজবে বিভ্রান্ত না হতে সবাইকে অনুরোধ করা হয়। কর্মস্থলের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়া পুলিশ সদস্যদের রাজনীতিক, শিক্ষার্থীসহ সব শ্রেণির মানুষ সহযোগিতা করছেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটা থেকে ডিএমপির ক্রাইম জোন ও ডিবির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কেউ কেউ কাজে ফিরেছেন বলে জানান। আবার অনেকে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ডিবির লালবাগ বিভাগের উপকমিশনারের (ডিসি) সরকারি মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও বন্ধ পাওয়া যায়।
ডিবির মিরপুর বিভাগের ডিসি ফোন রিসিভ করলেও কোনো উত্তর না দিয়ে লাইন কেটে দেন। ডিবির রমনা বিভাগের ডিসি কোনো মন্তব্য না করে ডিসি মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলেন। ডিবির উত্তরা বিভাগের ডিসি কথা বলেন এবং কর্মকর্তারা ধীরে ধীরে কাজে ফিরছেন বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া মিডিয়ার ডিসি ও এডিসিকে ফোন করা হলেও কেউ রিসিভ করেননি। তবে এসি মিডিয়া কথা বলেন। পাশাপাশি পুলিশ সদর দপ্তর, সিআইডি ও পিবিআইর মিডিয়া সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে কল করা হলেও রিসিভ করেননি।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য কর্মকর্তা কামরুল আহসান বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, কর্মক্ষেত্রে যোগ দেওয়াদের তালিকা এখনো হাতে আসেনি। পেলে জানানো হবে। ডিএমপির এসি (মিডিয়া) জাহাঙ্গীর যুগান্তরকে বলেন, বেশির ভাগ থানা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ায় সেখানে কাজের অবস্থা না থাকায় কেউ না ফেরারই কথা। তবে অনেকে ফিরতে শুরু করেছেন। বৃহস্পতিবার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনেকে ফিরেছেন।
এদিকে বৃহস্পতিবার ডিবিতে গিয়ে দেখা যায় গেটে সেনাবাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। কিছু সময় ডিবির মূল গেটের বাইরে অবস্থান করে মতিঝিল ও রমনা বিভাগের ডিসি এবং রমনার এডিসিকে প্রবেশ করতে দেখা যায়। গেটে থাকা রেজিস্টারে নাম তালিকাভুক্ত করে সবাইকে প্রবেশ করতে হচ্ছে। সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত রেজিস্টারে ডিবি ও সিটিটিসির অফিসার থেকে মাঠ পর্যায়ের মোট ১২২ জনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। রেজিস্টার দেখতে গেলে সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিষেধ করেন।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) বৃহস্পতিবার সেনাসদরে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানের উপস্থিতিতে নবনিযুক্ত পুলিশের আইজিপি, র?্যাবের মহাপরিচালক এবং ডিএমপি কমিশনার সাক্ষাৎ করেন। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেনাবাহিনীর সহায়তায় দেশের সব থানার কার্যক্রম শুরু করার বিষয়ে আলোচনা হয়।
বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যরা বৃহস্পতিবার বিকালে আইজিপির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিভিন্ন প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। আইজিপি ধৈর্য ধরে প্রস্তাব বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দেন।
এছাড়া বিষয়টি বাস্তবায়নে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা হলেন-পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (হেলথ, ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড পেনশন) মো. নাজমুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম সানতু, নৌ-পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জুয়েল রানা, ডিএমপির এসি (ফোর্স) সৌম্য শেখর পাল, সিআইডির ইন্সপেক্টর মো. জাহিদুল ইসলাম, ডিএমপির সার্জেন্ট মো. আসাদুজ্জামান জুয়েল, সিআইডির এসআই মো. জহিরুল হক ও ডিএমপির কনস্টেবল মো. বরকত উল্লাহ।
কমিটিকে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারদের ক্ষতিপূরণ প্রদান, আহত পুলিশ সদস্যদের সুচিকিৎসা এবং তাদের প্রস্তাবসমূহ স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নের সুপারিশ প্রদান করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যেসব পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারকে পুলিশের পক্ষ থেকে ১০ লাখ করে টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন আইজিপি।
পুলিশের নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, পুলিশকে নিয়মিত করার চেষ্টা করছি। বর্তমানে থানাগুলোতে আনসার সদস্যরা কাজ করছেন। এছাড়া র্যাবও কাজ করবে।