একদফা দাবি বাস্তবায়নে দেশ জুড়ে চলা অসহযোগ আন্দোলনের দুই দিনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে চলা সংঘর্ষে আহত হয়ে শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই চিকিৎসা নিয়েছেন ১৭শ’ জন। বেশির ভাগই ছিলেন গুলিবিদ্ধ। কারোর পেটে, কারোর পিঠে, কারোর আবার গুলি কোমর ফুটো হয়ে বের হয়ে গেছে পেট দিয়ে। যাদের অনেকে অসহনীয় কষ্ট নিয়ে এখনো হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছেন। ওয়ার্ডের বেডে স্থান না পেয়ে অনেকেরই ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালের মেঝেতে।
গতকাল সরজমিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ছাত্রদের দু’দিনের অসহযোগ আন্দোলনকে ঘিরে গুলিবিদ্ধসহ আহতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষকে ভর্তি করে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে হাসপাতালটির ১০১, ১০২ ও ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডে। এ ছাড়া ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি সার্ভিস ও আইসিইউতেও রোগী রয়েছে। সার্জারি বিভাগে জায়গা না হওয়ায় অনেক রোগীকে আবার পাঠানো হয়েছে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, ২৫ জন রোগীর ধারণক্ষমতার বেডে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৫৭ জন। তাদের মধ্যে ৫০ জনের বেশিই গুলিবিদ্ধ। একটি বেডে একজন রোগী থাকার কথা থাকলেও সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন একাধিক জন।
ওয়ার্ডটির মেঝেতেও চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকে। ওয়ার্ডটিতে চিকিৎসা নেয়া পুরান ঢাকার আগামসি লেনের শাহাদাত হোসেন বলেন, আমি বায়তুল মোকাররম এলাকায় ফুটপাথের একটা দোকানে কাজ করি। সোমবার সকালের দিকে আমি ও আমার বন্ধু আরিফ কাজে যাচ্ছিলাম। ওই সময় চানখাঁরপুল এলাকায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ চলছিল। হঠাৎ পুলিশ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। সেই গুলি এসে আমার পেটে লাগে। তখন আমার বন্ধুসহ আশপাশের লোক আমাকে এখানে নিয়ে আসে। ওয়ার্ডটির মেঝেতে শুয়ে কাতরাচ্ছিলেন গোপালগঞ্জের হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের মদনপুর এলাকায় আমি রিকশা চালাই। সোমবার শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে শুনে মদনপুর থেকে যাত্রাবাড়ী হয়ে গোপালগঞ্জ যাচ্ছিলাম। ওই সময় যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ চলছিল। বিকাল ৫টার দিকে আমি ওই এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় আমার পেটের একপাশ দিয়ে গুলি ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। তখন আমাকে ধরে কিছু লোকজন হাসপাতালে নিয়ে আসে। একই দিনে যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢামেকে ভর্তি হন আবুল বাশার নামে আরও একজন। তিনি বলেন, আমাদের বাসা যাত্রাবাড়ীতেই। শেখ হাসিনার পদত্যাগ করার খবর পেয়ে রাস্তায় নেমেছিলাম। সেখানে পুলিশ গুলি শুরু করলে আমারও পেটে গুলি লাগে। এদিকে ১০২ নম্বর ওয়ার্ডেও ৫৮ জন রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন সাফায়েত ইসলাম নামে এক কিশোর। সাফায়েতের মা সুমনা বলেন, আমার ছেলের পেটে গুলি লাগছে, বুকের হাড় ভেঙে গেছে। এখনো গুলি বের করতে পারেনি। আমার পোলার ভবিষ্যৎ কী জানি না। অপরদিকে নুরুল ইসলাম নামে এক রিকশাচালক বলেন, যাত্রাবাড়ী এলাকায় একটা দোকানে বসে আমরা কয়েকজন চা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমাদের কাছে একটা বোমা বিস্ফোরিত হয়। তাতে আমি ও আমিনুল নামে আমার এক বন্ধু আহত হয়েছি। বোমার আঘাতে আমার বাম হাতের আঙ্গুল উড়ে গেছে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত হয়ে গেছে।
ওয়ার্ডটিতে দায়িত্বরত এক চিকিৎসক বলেন, আন্দোলনের দুই দিনে কতো লোক এসেছেন, সেই সংখ্যা সঠিক বলতে পারবো না। তবে যারা আসছেন তাদের প্রায় নব্বই শতাংশ গুলিতে আহত। এবিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আহতদের মধ্যে বেশির ভাগই গুলিবিদ্ধ। কিছু রোগী এসেছে নাক, কান, গলা ও চোখের ইনজুরি নিয়ে। মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ১৭০০ জনের বেশি রোগী চিকিৎসা নিয়েছে হাসপাতালে। তিন শতাধিক মানুষ এখনো হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।