ঘটনাটি বেদনাদায়ক। গভীর রাতে কলেজছাত্র পুত্রকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশ বাড়িতে অভিযান চালায়। মা-বাবার সামনে ঘুমন্ত পুত্র সাইফ মোহাম্মদ আলীকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। চোখের সামনে এ দৃশ্য সইতে পারেননি সাইফের বাবা সামছুল আলম মামুন। গ্রেপ্তারে বাধা দেন। পুলিশের কাছে জানতে চান কোনো মামলা বা ওয়ারেন্ট আছে কিনা? তার ছেলে কোনো আন্দোলনে যায়নি এ কথাও জানান পুলিশকে। কিন্তু পুলিশ সাইফকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। এ সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন সামছুল আলম। ওদিকে পুত্রকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ তা দেখে সাইফের মা তাহমিনা আক্তার ছেলের পেছনে পেছনে যায়। দশ থেকে পনের মিনিট পর তাহমিনা ফিরে এসে দেখেন সাইফের বাবা অচেতন অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছেন।
তাহমিনার চিৎকারে আশপাশের মানুষ ছুটে আসেন। পরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন সামছুল আলম। পুত্র সাইফও জানতে পারেন ঘটনা। ঘটনাটি ঘটেছে গত সোমবার গভীর রাতে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ১১নং ওয়ার্ড কালু হাজী সড়কে। পরে সাইফকে বিস্ফোরক আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায় পুলিশ। আদালত পিতার মৃত্যুর কথা শুনে সিনিয়র আইনজীবীর জিম্মায় পিতার জানাজায় অংশ নিতে বিকাল পর্যন্ত জামিন দেন। জানাজার পর সন্ধ্যায় ফের আদালতে তুলে জামিন চাইলে আদালত তা নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। সাইফ এখন কারাগারে রয়েছেন। আগামী ৫ই আগস্ট তার জামিনের শুনানির দিন রয়েছে। মর্মান্তিক এ ঘটনায় হতবাক এলাকাবাসী। সাইফের পরিবার ও এলাকাবাসী বলেছেন, সাইফ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ মিছিলে যাননি। পুলিশের ভাষ্য, সাইফ বিক্ষোভ মিছিলে গিয়েছে। সাইফ মোহাম্মদ আলী লক্ষ্মীপুর কফিল উদ্দিন কলেজের ডিগ্রি প্রথম বর্ষের ছাত্র। এর আগে কোনো মামলাই ছিল না সাইফের বিরুদ্ধে।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, সাইফ মোহাম্মদ আলীর বাড়ি নোয়াখালীর চৌমুহনীর বাংলা বাজার এলাকায়। ১ যুগ আগে ছেলে সন্তানকে পড়ালেখা করানোর জন্য সাইফের মা তাহমিনা আক্তার লক্ষ্মীপুর শহরের বাবার বাড়িতে চলে আসেন। সাইফের বাবা মুদি দোকানের ব্যবসা করতেন। তাহমিনা আক্তার স্থানীয় একটি প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকতা করেন। স্বামী ও দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে চলতো তাদের সংসার। একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি স্বামীকে হারিয়ে দুশ্চিন্তায় তাহমিনা। পাশাপাশি ছেলেকে বিস্ফোরক মামলা দেয়ায় কবে মুক্তি পাবে, সে নিয়ে হতাশা চোখেমুখে। স্বামীর মৃত্যু ও ছেলে কারাগারে এসব নিয়ে মিডিয়ায় যেন কোনো কথা না বলে সে বিষয়ে চাপ দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রভাবশালীরা। এতে চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন স্বজনরা। এমন অভিযোগ করেন পরিবারের লোকজন।
গ্রেপ্তারকৃত কলেজছাত্র সাইফ মোহাম্মদ আলীর মা তাহমিনা আক্তার এ অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। বর্তমানে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ঘটনার বিষয় নিয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে বৃহস্পতিবার দুপুরে কথা হয়। এ সময় তিনি বলেন, স্বামী হারানোর শোক, অন্যদিকে আমার নিরপরাধ ছেলে কারাগারে। উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়েছি। কীভাবে সন্তানদের পড়ালেখার ব্যবস্থা হবে, সে চিন্তায় রয়েছি। ছেলে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। পুলিশ জোরপূর্বক ছেলেকে ধরে নিয়ে যায়। এ সময় সাইফের বাবা বাধা দিলে আতঙ্কিত হয়ে ঘটনাস্থলে মারা যান। সেদিন লক্ষ্মীপুরে কোনো মিটিং- মিছিল কিছুই হয়নি। কিন্তু আমার ছেলেকে অন্যায়ভাবে বিস্ফোরক ও নাশকতার মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে ছেলের মুক্তির দাবি জানান তিনি।
সাইফ মোহাম্মদ আলীর আইনজীবী মহসিন কবির মুরাদ বলেন, ৩০শে জুলাই রাতে লক্ষ্মীপুর দক্ষিণ মজুপুরের বাসা থেকে গ্রেপ্তার হয় সাইফ মোহাম্মদ আলী। সন্তান গ্রেপ্তারের যন্ত্রণায় হার্ট অ্যাটাক করে মৃত্যুবরণ করেন বাবা সামছুল আলম মামুন। পূর্ব থেকে সাইফের নামে কোনো মামলা বা ওয়ারেন্ট না থাকলেও পুলিশ বেলা ১১টায় সাইফ মোহাম্মদ আলীকে বিস্ফোরক আইনের একটি মামলায় আসামি দেখিয়ে বিজ্ঞ আদালতে হাজির করে। আমরা বিজ্ঞ আদালতে জামিনের আবেদন করার পর বিজ্ঞ আদালত সাইফের বাবার জানাজায় অংশগ্রহণ করার জন্য সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট সৈয়দ মোহাম্মদ শামছুল আলম ও সাইফের নিযুক্তীয় আইনজীবী এডভোকেট মহসিন কবির মুরাদের ব্যক্তিগত জিম্মায় সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত জামিন মঞ্জুর করেন।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ইয়াছির মজুমদার ফারুক সাংবাদিকদের বলেন, নাশকতা ও বিস্ফোরক মামলায় সাইফ মোহাম্মদ আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে তার বাবা দীর্ঘদিন ধরে হার্টের সমস্যায় ভুগছেন। সে কারণে তিনি মারা যান।