বিষাদ ও যন্ত্রণাময় সময়। কালো রাতের কথা অনেক শোনা যায়। কিন্তু ইতিহাসে কিছু কিছু দিনও থাকে এমন। নিকষ অন্ধকার। বাংলাদেশ দু’টি এরকম দিনেরই সাক্ষী হলো। সবচেয়ে খারাপ খবর কোনটি? জাতির কাঁধে ছাত্রদের লাশ। এসব মরদেহের ওজন মাপতে পারে এমন যন্ত্র কোথায়! নিউজরুমে সবচেয়ে কঠিন কাজ কী? লাশের কাউন্টডাউন করা। মঙ্গলবার দুপুর পেরিয়ে প্রথম নিহতের খবরটি আসে রংপুর থেকে। পুলিশের গুলি, সংঘর্ষ। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নিহত।
পরের স্পট চট্টগ্রাম। ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে। বুকে গুলি। শিক্ষার্থীসহ নিহত তিন। এবার ঢাকা। নিউমার্কেটের সামনে সংঘর্ষে নিহত ২। লেখা এগোয় না। গুলির আওয়াজ পাওয়া যায়।
শুধু দিনের কথা উল্লেখ করাও ঠিক হয়নি। আসলে গেল ৪৮ ঘণ্টার প্রতিটি মুহূর্তই ঘটনাবহুল। লাল চোখ দেখানো হচ্ছিলো ক’দিন ধরেই। পুলিশ না ছাত্রলীগ কে অ্যাকশনে যাবে তা নিয়ে একধরনের প্রশ্ন ছিল। তবে রোববার রাতের শুরু থেকেই পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন হতে থাকে। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি মন্তব্যকে ঘিরে ক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। হলে হলে শুরু হয় স্লোগান, বিক্ষোভ। তাদের স্লোগান নিয়ে ফেসবুকে কেউ কেউ প্রশ্নও তোলেন। তবে রাতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকে উত্তেজনা। হল থেকে দলে দলে বেরিয়ে আসেন ছাত্রীরা। এ মিছিলের যেন শেষ নেই। একপর্যায়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেন ছাত্ররাও। অন্যরকম এক রাতের নজির তৈরি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে অন্যদিকে চলতে থাকে ভিন্ন প্রস্তুতি। ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাত্রলীগ এবং ক্ষমতাসীনদের সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীরা জড়ো হতে থাকেন। তাদের অনেকের হাতেই ছিল হকিস্টিক, নানা ধরনের অস্ত্র। আতঙ্ক আর উত্তেজনা বাড়তে থাকে। গভীর রাতে ছাত্ররা ফিরে যান হলে। একপর্যায়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন ছাত্রলীগের বহিরাগতরা। উদ্বেগের রাত শেষ হয়।
মানবজমিনে এই শিরোনাম বহুবার ছাপা হয়েছে- মেসেজ লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার।
সোমবার দৃশ্যপট পরিষ্কার করে দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বলেন, ক্যাম্পাসে ঐদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের জবাব দিতে ছাত্রলীগ প্রস্তুত। ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব কোটা আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করে চরম হুঁশিয়ারি। ধারণা করা যায়, ছাত্রলীগকে লাইসেন্স দেয়া হয় শিক্ষার্থীদের শায়েস্তা করার। প্রশ্ন উঠে, এর কি কোনো বিকল্প ছিল না? শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার কি কোনো সুযোগ ছিল না। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আদালতে ফয়সালার কথা বলা হচ্ছে। যদিও হাইকোর্টের রায়ে এটাও বলা হয়েছে, সরকার চাইলে কোটার হার বাড়াতে, কমাতে পারবে, পরিবর্তন করতে পারবে। একটি সহযোগী দৈনিকে শিরোনাম পড়ছিলাম, শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ রক্ষা হবে কি? আরেকটা কথাও হয়তো জিজ্ঞেস করা যায়, তাদের হত্যা করেও কি কোনো কিছু শেখানো যাবে? শিক্ষকদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা অতীতে কখনো কখনো শোনা যেতো। তবে সেদিন যে বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে তা না বললেও চলে। এমনকি তাদের আন্দোলনে কেউ আজকাল তেমন কর্ণপাত করে না। আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়েও তাদের বৈঠক করতে হয়। সে যাই হোক, ক্যাম্পাসে যখন লাঠি-অস্ত্র হাতে শত শত বহিরাগত তখন ভিসির ভূমিকা কি? তিনি কোথায়? এ দৃশ্য তো শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়।
একই ঘটনার সাক্ষী হয়েছে অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির বাস ভবনে আশ্রয় নিয়েও শিক্ষার্থীরা রক্ষা পাননি। তাদের ওপর সেখানেই বর্বর নির্যাতন করা হয়েছে। একজন শিক্ষক আহত হয়েছেন। কিছু কিছু শিক্ষক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু মোটাদাগে শিক্ষার্থীদের জীবনের এক সংকটময় মুহূর্তে ভিসিরা রীতিমতো নিখোঁজ, শিক্ষকরা নিরুদ্দেশ। না, গতকাল বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি বহিরাগতদের কাছে অনুনয়, বিনয় করেছে ক্যাম্পাস ছেড়ে দিতে। তবে তাদের কথায় কেইবা কর্ণপাত করে। অতীতে জাতির ক্রান্তিকালে বুদ্ধিজীবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বর্তমানে দেশে কোনো বুদ্ধিজীবী আছেন কি-না তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে যারা আছেন সংকটের সুরাহার পরিবর্তে তারা তা আরও উস্কে দেন। কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের দোষারোপ করে অনেকটাই আগুনে ঘি ঢেলেছেন। তবে পুরো ঘটনাপ্রবাহে ছাত্রীদের ওপর নির্মম হামলার দৃশ্য বহুজনকে বিস্মিত, হতবাক করেছে। অনেকেই বলছেন, এটা নজিরবিহীন। ছাত্রীদের ওপর এ ধরনের টার্গেটেড হামলা অতীতে কখনো হয়নি। তবে এবার আন্দোলনে শুরু থেকেই ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ছিল বেশি। মূলত এ অংশগ্রহণ কমাতে পরিকল্পিতভাবেই এ আক্রমণ হতে পারে।
এবারের ঘটনাপ্রবাহে অবশ্য দুটি ব্যতিক্রমী ঘটনাও আছে। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের বেশ কিছু নেতাকর্মী পদত্যাগ করেছেন। ‘মিলিয়নিয়ার পিয়নদের’ যুগে এই ত্যাগ কম নয়। আরেকটি বিষয়ও বড় ঘটনাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব ছাত্র ছাত্রলীগের হয়ে হামলায় অংশ নিয়েছেন তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। সহপাঠীরা তাদের বর্জনের ঘোষণা দিচ্ছেন। বলছেন, তাদের সঙ্গে জীবনে তারা কোনো দিন ক্লাস করবেন না, বসবেন না পরীক্ষার হলে।
রক্তাক্ত দু’টি দিন। লাশ গোনা হয়তো শেষ হয়নি। মর্মান্তিক এক অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি। ফুল আর রক্ত। বাংলাদেশ যেন রক্তই বেছে নিলো। কিন্তু যাদের জীবন চলে গেল সে পরিবারগুলোর কী হবে? এ কষ্ট তাদের মতো করে কে বুঝবে! দুনিয়ার দেশে দেশে সংকটের সুরাহা হয় আলোচনার টেবিলে। বন্ধু কিংবা শত্রু সবার সঙ্গেই হয় সংলাপ। এমনকি হামাস-ইসরাইল আলোচনাও কি হচ্ছে না? সংলাপ ব্যর্থ হতে হতেই কি-না আমরা সংলাপের দরজাই বন্ধ করে দিয়েছি। কিন্তু সংলাপের বিকল্প কী? রক্তপাত। কার যেন লেখায় পড়েছিলাম, রাষ্ট্র হলো মায়ের মতো। মা কি সন্তানদের এভাবে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিতে পারে?