দেশের স্থানীয় বাজারে ওষুধের গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য ওষুধের বায়ো-ইকুব্যালেন্স টেস্ট করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। স্থানীয় বাজারের ওষুধের বায়ো-ইকুব্যালেন্স টেস্ট না থাকায় অধিকাংশ কোম্পানির ওষুধের গুণগত মান জানা যাচ্ছে না। কিন্তু বিদেশে রপ্তানি হওয়া ওষুধগুলো ঠিকই সব শর্ত পূরণ করেই ওইসব দেশে ঢুকছে। দেশীয় বাজারের ওষুধের গুণগত মানের ঘাটতি আছে বলেও জানিয়েছেন চিকিৎসকদের বড় সংগঠন বিএমএ’র মহাসচিব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসক থাকলেও ওষুধের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। দেশের ওষুধ সেবন করে রোগীরা ভালো হচ্ছেন না, অথচ একই ওষুধে থাইল্যান্ডে অনেক রোগী ভালো হয়ে যাচ্ছেন। মার্কেট শেয়ার অনুযায়ী উপরের দিকের বেশ কিছু কোম্পনির ওষুধের মান বেশ ভালো। তবে, আমাদের কোন ওষুধটার মান খারাপ আর কোন ওষুধটার মান খারাপ না- সেটা আমরা জানি না। কারণ, আমাদের লোকাল মার্কেটের ওষুধের বায়ো-ইকুব্যালেন্স টেস্ট করা হয় না। তাই আমাদের দেশের বাজারে ওষুধের কোয়ালিটি কতোটুকু সেটা জানি না।
দেশের ওষুধ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ মানবজমিনকে বলেন, এখানকার ওষুধ কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজ করছে না।
এমনও উদাহরণ আছে, বাংলাদেশের কোনো ওষুধ রোগীকে দিলে কাজ করছে না। ওই রোগী যখন সিঙ্গাপুর, ভারত বা থাইল্যান্ডে গেলেন সেখানকার একই থেরাপিউটিক গ্রুপের ওষুধ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজ করছে। দায়টা দিন শেষে চিকিৎসকের উপরে চলে আসে। কেননা, রোগীরা মনে করেন বাংলাদেশি ডাক্তাররা যে ওষুধ দিলেন তাতে কাজ হলো না। এ ক্ষেত্রেও দায়টা ডাক্তারের উপর আসলো, যদিও সমস্যাটা ওষুধের। আমাদের সব ওষুধের মান খারাপ না। মার্কেট শেয়ার অনুযায়ী উপরের দিকের বেশ কিছু কোম্পানির ওষুধের মান বেশ ভালো। তবে, আমাদের কোন ওষুধের মান খারাপ আর কোন ওষুধের মান খারাপ না সেটা আমরা জানি না। কারণ, আমাদের লোকাল মার্কেটের ওষুধের বায়ো-ইকুব্যালেন্স টেস্ট করা হয় না। তাই আমাদের দেশের বাজারে ওষুধের কোয়ালিটি কতোটুকু সেটা জানি না। অথচ আমরা যে ওষুধগুলো রপ্তানি করি সেগুলোর বায়ো-ইকুব্যালেন্স টেস্ট করা হয়। বায়ো-ইকুব্যালেন্স টেস্টে উত্তীর্ণ হয়ে আমাদের ওষুধ সেই সব দেশে ঢুকছে। না হলে ঢুকতেই দেবে না। তিনি জানান, ভারতে বেশির ভাগ ওষুধ বায়ো-ইকুব্যালেন্স টেস্ট করা। তাই, তাদের ওষুধের কোয়ালিটি জানার সুযোগ আছে। অথচ আমাদের এখানে সে সুযোগ নেই। তাই, নানাভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর আমাদের আস্থা নষ্ট হচ্ছে। বিদেশে গিয়ে আমাদের চিকিৎসা করানো দেশের ডলার সংকটের অন্যতম একটা কারণ। এ বিষয়ে খরচের প্রকৃত হিসাব বা পরিসংখ্যান কারোরই কাছে নেই। তবে এখাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে।
এদিকে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধে বাজার সয়লাব। কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ তা যাচাই করার সুযোগ নেই। বর্তমানে দেশে ৬২টি কোম্পানি প্যারাসিটামল বিক্রি করছে। একেকটা একেক মানের। আবার কিছু কোম্পানির প্যারাসিটামল সেবনে কোনো কাজই হয় না। দেশে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। অন্যদিকে বাংলাদেশে এক শ্রেণির চিকিৎসক কমিশন খেয়ে যেসব কোম্পানি ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করে প্রেসক্রিপশনে সেসব ওষুধ দেন। এতে রোগীর রোগ তো ভালোই হয় না, উল্টো নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দয়। মিটফোর্ডসহ রাজধানীর আশপাশে ও দেশের বিভিন্ন স্থানে এক শ্রেণির ওষুধ বিক্রেতা আছেন, তারা নিজেরাই ওষুধ তৈরি করে বাজারে সরবরাহ করেন। বিভিন্ন সময়ে ওষুধ প্রশাসন ও র্যাব-পুলিশের হাতেও অনেকে ধরা পড়েছেন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধে রোগীর রোগ ভালো তো হবেই না, উল্টো এসব ওষুধ সেবন করে অনেক রোগীর অঙ্গহানিসহ প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। তারা বলেন, মানুষ মানসম্মত ওষুধ পাচ্ছে কিনা, ওষুধ সহজলভ্য কিনা- তা নিশ্চিত করতে হবে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, ওষুধ শিল্প সমিতি, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও ওষুধ শিল্পের গবেষকরা জানিয়েছেন, ১০ বছর আগেও আমদানিকারক দেশের সংখ্যা ছিল ৯০, এখন তা ১৫৭। ভ্যাকসিন বাদে বাংলাদেশে উৎপাদিত প্রায় সব ধরনের ওষুধই বিদেশে যাচ্ছে। ৩০ বছর আগে বিদেশে ওষুধ রপ্তানি শুরু করার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৫৪টি কোম্পানি রপ্তানি করছে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক (আইন) নুরুল আলম এ প্রসঙ্গে মানবজমিনকে বলেন, যেসব কোম্পানির ওষুধ বিদেশে রপ্তানি করে তাদেরকে ওইসব দেশের শর্ত শতভাগ পূরণ করে ঢুকতে হয়। কিন্তু দেশের বাজারে বা স্থানীয় বাজারে ওষুধের গুণগত মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে শিথিলতা থাকলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। লোকাল মার্কেটের ওষুধের বায়ো-ইকুব্যালেন্স টেস্ট করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নিবন্ধের সময়ে তাদের এসব বিষয়গুলো দেখা হয়। এরপর ওষুধ বাজারে আসার পর পোস্ট সার্ভিলেন্স করা হয়। তিনি স্বীকার করে বলেন, কিছু কোম্পানির ওষুধের গুণগত মানে ঘাটতি পাওয়া যায়। ওষুধের গুণগত মানের জন্য মাঝে মাঝে বাজার থেকে ওষুধের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তাতে খারাপ পাওয়া গেলে তদন্ত শেষে প্রমাণিত হলে মামলা হয় এবং লাইসেন্সও বাতিল করা হয়। প্রতি মাসেই এরকম ঘটনা পাওয়া যাচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নতুন আইন অনেক শক্তিশালী বলেও জানান তিনি।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, দেশে প্রায় ৩১০টি নিবন্ধিত ওষুধ কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে সচল ২২০টির বেশি কোম্পানি ১ হাজার তিনশ’র বেশি জেনারের ১৮ হাজারেরও বেশি ওষুধ তৈরি করছে। এসব ওষুধের বাজারমূল্য ৩৪ থেকে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। অথচ ২০১৪ সালে ওষুধের অভ্যন্তরীণ বাজার ছিল সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকার। অর্থাৎ গত ১০ বছরে ওষুধের বাজার বেড়েছে তিনগুণের বেশি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন (বিএমএ)’র মহাসচিব ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, আমরা বিদেশে যে ওষুধটা রপ্তানি করি সেটা খুবই গুণগত মানের। কিন্তু স্থানীয় বাজারে যেটা দেয়া হয় তার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। ঔষধ প্রশাসনের উচিত বাজার থেকে র্যানডমলি নমুনা সংগ্রহ করে যাচাই করা। দেশের বাজারে ওষুধের গুণগত মানের ঘাটতি আছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান এ ব্যাপারে মানবজমিনকে বলেন, দেশের বাজারের স্থানীয় বাজারের ওষুধের বায়ো-ইকুব্যালেন্স টেস্ট করা হলে ওষুধের গুণগত মানের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। মানুষ মানসম্পন্ন ওষুধ পাবেন। তবে বিদেশে গিয়ে ওই দেশের ওষুধ সেবনে রোগ সারে, দেশের একই গ্রুপের ওষুধে রোগ সারে না- ঢালাওভাবে এমন কথা মানতে নারাজ এই বিশেষজ্ঞ।
স্থানীয় বাজারের ওষুধের বায়ো-ইকুব্যালেন্স টেস্ট প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব ও হাডসন ফার্মার স্বত্বাধিকারী এসএম শফিউজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, বাংলাদেশের ওষুধ ভালো। ২২০টি কোম্পানির মধ্যে দেড়শ’ কোম্পানির ওষুধের গুণগত মান শতভাগ ঠিক আছে। এগুলোর স্থানীয় বাজারের ওষুধের বায়ো-ইকুব্যালেন্স টেস্টও করা হয় বলে দাবি করেন তিনি। বাকি ছোট ছোট কোম্পানির ওষুধের অন্যান্য পরীক্ষা হলেও বায়ো-ইকুব্যালেন্স টেস্ট হয় না। বেহাল স্বাস্থ্যখাত নিয়ে রিপোর্টের শেষ কিস্তি প্রকাশিত হলো আজ।