ভরা বর্ষায় ঢাকার চারপাশের নদ-নদীর পানির উচ্চতা বেড়েছে। এ কারণে সরাসরি পানি নিষ্কাশনে স্লুইসগেটগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাম্প করেই পানি নিষ্কাশন করা হচ্ছে। এ অবস্থায় শুক্রবার ৬ ঘণ্টায় ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে রাজধানী ঢাকার সিংহভাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। অন্য সময় আধাঘণ্টায় পানি নিষ্কাশন হলেও শনিবার পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে থাকতে দেখা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন-বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা হওয়ায় রাজধানী ঢাকায় পানি ধারণের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা থাকা দরকার ছিল। অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে পুকুর, ডোবা ও জলাশয়গুলো ভরাট করা হয়েছে। এ কারণে ভারি বৃষ্টি হলেই ড্রেনগুলো পানি নিষ্কাশনের সক্ষমতা হারায়। তখন শহরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। বিষয়গুলো সবার জানা থাকলেও তার সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেই। ঢাকার দুই সিটি খাল, নর্দমা ও পানি নিষ্কাশন চ্যানেল আধুনিকায়নের কথা বলে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে। ইতোমধ্যে সাড়ে ৩ বছর অতিবাহিত হলেও কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি নেই। এ কাজগুলো ত্বরান্বিত করতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
ঢাকার দুই সিটির সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজধানীর খালগুলো দখলের কারণে সংকুচিত হয়ে রয়েছে। আর যত্রতত্র ময়লা আবর্জনায় ভরাট খাল, নর্দমা ও জলাশয়গুলো। এছাড়া কংক্রিট আচ্ছাদিত জায়গার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় শহরের পানি নিষ্কাশন ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। তারা আরও জানান, জলাবদ্ধতার কারণগুলো চিহ্নিত হলেও স্থায়ী সমাধানের নেই কার্যকর কোনো উদ্যোগ। ফলে একটু বৃষ্টি হলে ঢাকার প্রধান সড়ক অলিগলিসহ দোকান ও বাসাবাড়ি ডুবে যায়। মালামাল নষ্টে বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতিসহ ভোগান্তিতে পড়েন নগরবাসী।
তারা বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং ঢাকা ওয়াসা গত এক যুগে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে। তারপরও একটু ভারি বৃষ্টি হলে তলিয়ে যায় ঢাকার অধিকাংশ এলাকা। খাল ভরাট, ড্রেনেজ ব্যবস্থায় বিকল, জলাশয় ভরাট, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অভাব জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী বলে মনে করছেন।
এদিকে গত শুক্রবার ৬ ঘণ্টায় ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এ বৃষ্টিতে রাজধানীর প্রধান সড়কসহ অলিগলি, দোকানপাট ও বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে যায়। বিশেষ করে ধোলাইখাল, শাঁখারীবাজার, রায়সাহেব বাজারসহ পুরান ঢাকার অধিকাংশ এলাকা। আর মতিঝিল, টিকাটুলি, খিলগাঁও, রামপুরা হাজীপাড়া, মৌচাক, গ্রিনরোড, পান্থপথ, মিরপুরসহ দুই সিটি করপোরেশনের অধিকাংশ এলাকা তলিয়ে যায়। যদিও গত তিন বছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি ২৫৯টি এবং উত্তর সিটি ১০৩টি জলাবদ্ধতাপ্রবণ স্থান চিহ্নিত করে। দুই সিটি এসব এলাকায় সমাধানে কাজ করলেও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলছে না।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। দায়িত্ব ছাড়ার আগে ঢাকা ওয়াসা রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ৯ বছরে ব্যয় করে দুই হাজার ২৫ কোটি টাকা। ঢাকা ওয়াসা ছাড়াও ড্রেনেজ উন্নয়নে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫৭৩ কোটি টাকা ব্যয় করে। পরের দুই বছরে ব্যয় করেছে আরও ৪০০ কোটি টাকা। এছাড়া গত দুই বছর ঢাকা দক্ষিণ সিটি ১৬১টি জলাবদ্ধতাপ্রবণ স্থান নির্ধারণ করে ১০৯টি স্থানে জলাবদ্ধতা নিরসনে ২৫২ কোটি টাকা খরচ করে। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ১৬০ কোটি টাকা খরচ করে পানি নিষ্কাশনের উন্নয়নে। এর বাইরে দক্ষিণ সিটি ‘খাল পুনরুদ্ধার, সংস্কার নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি’র নামে ২০৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সব মিলিয়ে জলাবদ্ধতা নিরসনে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করেও জলাবদ্ধতা নিরসন সম্ভব হয়নি।
তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা যায়, দেশে ঢাকাকেন্দ্রিক নগরায়ণের সম্প্রসারণ ঘটেছে। একই সঙ্গে বেড়েছে কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণও। এতে বৃষ্টির পানি প্রাকৃতিকভাবে মাটিতে টেনে নেওয়ার সুযোগ অনেক কমে গেছে। ফলে জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকা বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত : বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, ঢাকায় বৃষ্টির পানি ধারণ ক্ষমতা ও পানি নিষ্কাশন ক্ষমতার খুবই নাজুক দশা। এ কারণে ভারি বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে ঢাকার দুই সিটি জলাবদ্ধতার দায়িত্ব গ্রহণের পর পানি নিষ্কাশনের অনেকাংশে উন্নতি হয়েছে। এর সুফলও নগরবাসী পেয়েছে। তবে এবারের জলাবদ্ধতা ভাবিয়ে তুলছে।
এর সঠিক কারণ অনুসন্ধান করে তা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল বিভাগের অধ্যাপক ড. ইশরাত ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সরকার একযোগে ঢাকার জলাশয়গুলো ভরাট করেছে। পাশাপাশি অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র ভবন নির্মাণ করেছে। এতে শহরের কংক্রিটের পরিমাণ বেড়েছে। ফলে বৃষ্টির পানি যথাযথভাবে নিষ্কাশন ও ভূগর্ভে রিচার্জ হতে পারছে না। ফলে জলাবদ্ধতার ধকল সইতে হচ্ছে। আমরা সবাই মিলে শহরকে ধ্বংস করেছি, এজন্য এখন এই যন্ত্রণা সবাইকে ভোগ করতে হবে। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অল্প সময়ে অধিক পরিমাণ বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এর পূর্বাভাস বহু আগে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেসব বিষয়ে আমরা কর্ণপাত করিনি। এজন্য বৃষ্টিজনিত দুর্ভোগ আমাদের সহ্য করা ছাড়া কোনো বিকল্প দেখছি না।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ড্রেনেজ সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ফারুক হাসান মো. আল মাসুদ যুগান্তরকে বলেন, ভারি বর্ষণ প্রধান কারণ বলে মনে করছি। পাশাপাশি ভরা বর্ষা মৌসুমে নদীর পানির উচ্চতা বেড়েছে। স্লুইসগেটগুলো বন্ধ করে পাম্প করে সব পানি বের করতে হচ্ছে; এ কারণে জলাবদ্ধতা দীর্ঘায়িত হলো কিনা তা বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে।
জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান জানান, ভারি বৃষ্টি জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ। পাশাপাশি নর্দমাগুলোর ক্যাচপিটে বর্জ্যরে কারণে ঠিকমতো পানি নিষ্কাশন করতে পারছে না। এছাড়া নদ-নদীর পানির স্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় স্লুইসগেটগুলো অনেক ক্ষেত্রে বন্ধ রাখতে হচ্ছে। মূলত পাম্প করেই বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন করতে হচ্ছে।
https://www.jugantor.com/index.php/todays-paper/last-page/828163