সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দারা সীমান্তে গেলেই বিএসএফয়ের গুলিতে মৃত্যুর পাশাপাশি হচ্ছেন নানা নির্যাতনের শিকার। সর্বশেষ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা সীমান্তে বিএসএফয়ের হাতে কিরণ ওরফে রাজু নামের এক হিজড়া নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বর্তমানে তিনি পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে রক্তাক্ত অবস্থায় কাতরাচ্ছেন।
গতকাল সোমবার ভোরে তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরসংলগ্ন সীমান্তের ৭৩২ নম্বর মেইন পিলারের ৫ নম্বর সাবপিলার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। সকাল ৮টার দিকে বাংলাদেশের সীমান্তে ওই হিজড়াকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে বিজিবির বাংলাবান্ধা বিওপির সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে তেঁতুলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাকে পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যার অন্যতম প্রধান কারণ দেশটির সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগ। এ ছাড়াও দুই দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো ঘনবসতিপূর্ণ। এখানকার একশ্রেণির মানুষ কৃষি ও অন্যান্য পেশার পাশাপাশি আন্তঃসীমান্ত গবাদি পশু ও পণ্য পাচারের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। এই হত্যার শিকার অধিকাংশই বিভিন্ন চোরাচালান কর্মের সঙ্গে জড়িত বলেই অভিযোগ বিএসএফের। কিন্তু দুই দেশের আইন অনুযায়ী, কেউ সীমান্তে অনুপ্রবেশ করলে, কাঁটাতার কাটলে বা পাচারের চেষ্টা করলে তাদের গ্রেপ্তার করে ওই দেশের আইনানুযায়ী বিচার করতে হবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই গুলি ছোড়া বা নির্যাতন করা যাবে না।
সূত্র মতে, সীমান্তে বছরের পর বছর ধরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলি ও নির্যাতনে প্রাণ হারাচ্ছেন নিরীহ বাংলাদেশিরা। বিগত ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারিতে বিএসএফের গুলিতে নির্মম হত্যার শিকার হয় কিশোরী ফেলানী খাতুন। তার লাশ সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। ওই সময় কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে থাকা কুড়িগ্রামের কিশোরী ফেলানীর লাশ ছবি আলোড়ন তুলেছিল দেশে-বিদেশে। ওই ঘটনার পর দফায় দফায় আলোচনায় সীমান্তে হত্যা বন্ধে প্রতিশ্রুতি দেয় বিএসএফ। তবে গত বছরগুলোতে পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় একেবারেই উল্টোচিত্র। শুধু তাই নয়, চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি বিএসএফের গুলিতে এক বিজিবি সদস্যর নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএসএফের হাতে মারা গেছেন ২০০ এর বেশি বাংলাদেশি। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন হাজার মানুষ। যার মধ্যে গত বছর ২৮ জনের প্রাণহানি ও ৩১ জন মারাত্মক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। অন্য দিকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত বিএসএফয়ের হাতে ২০ জনের অধিক বাংলাদেশী সাধারন নাগরিক হত্যার শিকার হয়েছে। নানাভাবে নির্যাতনে শিকার হয়েছেন শতাধিক মানুষ।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতে, বিএসএফ আত্মরক্ষার জন্য হত্যা করে। কিন্তু হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) ‘ট্রিগার হ্যাপি’ নামে এক প্রতিবেদনে সীমান্তে গুলি থেকে বেঁচে যাওয়া এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ ছিল, বিএসএফ তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা না করে বা সতর্ক না করেই নির্বিচারে গুলি চালায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী আত্মরক্ষার প্রয়োজনে প্রথমে সতর্ক করতে ফাঁকা গুলি ছুড়তে হবে। যদি এতে হামলাকারী নিবৃত না হয় এবং জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় সেক্ষেত্রে গুলি ছোড়া যাবে, তবে সেটা হতে হবে অবশ্যই হাঁটুর নিচের অংশে। কিন্তু এসবের কোনো তোয়াক্কাই যেন নেই বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর। ফেলানী হত্যার দৃশ্যই কি মনে করিয়ে দেয় না, বিএসএফ গুলি ছোড়ে স্রেফ হত্যার উদ্দেশ্যেই। বিএসএফ কোনো ক্ষেত্রেই প্রমাণ করতে পারেনি যে, হতাহতের শিকার মানুষগুলোর মাধ্যমে তাদের প্রাণ সংশয় বা গুরুতর আহত হওয়ার ঝুঁকি ছিল।
বিজিবির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, আমাদের নাগরিকদের গুলি করে হত্যার বিষয়টি অনাকাঙ্খিত। আমরা প্রতিটি সভাতেই হত্যাকাণ্ড বন্ধের কথা বলি আর বিএসএফ প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান বলেন, বিগত দিনে সীমান্ত হত্যা নিয়ে শুধু বিএসএফ-বিজিবির ঊর্ধ্বতনদের মধ্যেই বৈঠক হয়নি, দুই দেশের রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনা হতে দেখেছি। তখনও শুনেছি সীমান্ত-হত্যাকাণ্ড শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হবে, সীমান্তে মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হবে না। কিন্তু তারপরও দেখছি আগের মতোই হত্যাকাণ্ড-নির্যাতন চলছেই।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমরা দেখছি দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সীমান্ত-হত্যা নির্যাতন ইস্যুটির সমাধান হচ্ছে না। তাই আমি মনে করি, বিষয়টি জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক দরবারে আনতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে এর সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশের যেসব নাগরিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, তাদের কেউ সশস্ত্র ছিলÑ এমন আলামত দেখাতে পারবে না। প্রতিনিয়ত আমাদের সীমান্তে বিএসএফ যে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে, পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে যুদ্ধাবস্থা থাকার পরও কিন্তু সেখানে এমন ঘটনা ঘটে না।
ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী সীমান্তে বিএসএফ গুলিতে মো. রাজু মিয়া (২৮) নামে এক বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন গত শুক্রবার ৫ জুলাই। ওই দিন ভোররাতে উপজেলার নগরভিটা সীমান্তের বিওপি আওতাধীন মেইন পিলার ৩৭৬/৫ এস নামক স্থানে এ ঘটনা ঘটে। নিহত রাজু মিয়া বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বড় পলাশবাড়ী ইউনিয়নের গড়িয়ালী গ্রামের হবিবর আলীর ছেলে। বালিয়াডাঙ্গী থানার ওসি ফিরোজ কবির বলেন, ঠাকুরগাঁও ৫০ বিজিবির নগরভিটা সীমান্তে গরু চোরাকারবারি করতে গেলে রাজু গুলিবিদ্ধ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সীমান্তে ভারতীয় খাসিয়ার গুলিতে বিশদ খান্দজানি (৩০) নামে এক বাংলাদেশি যুবক আহত হন। শুক্রবার ৫ জুলাই বিকেল ৪টার দিকে উপজেলার দমদমা সীমান্তের নোম্যান্স ল্যান্ডে এ ঘটনা ঘটে। আহত বিশদ খান্দজানি উপজেলার উত্তর রণিখাই ইউনিয়নের কুরঙ্গ কুলিবস্তি এলাকার মৃত বাবুচান্দ খন্দজানির ছেলে।
স্থানীয়রা জানান, শুক্রবার বিকেলে সীমান্ত পিলার ১২৫৯/২ এস সংলগ্ন নোম্যান্স ল্যান্ডে যান বিশদ খান্দজানি। ভারতীয় খাসিয়ারা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। এ সময় তার পেটে গুলি লাগলে তিনি আহত অবস্থায় পালিয়ে আসেন।