ঋণখেলাপিদের জন্য আবারও বড় ছাড় দিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো খেলাপি সুদ মওকুফ নিয়ে তিন বছরের মধ্যে দায় সমন্বয় করতে পারবে। এমনকি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি করেও ঋণ সমন্বয় করা যাবে। এ ধরনের আবেদন পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে ব্যাংক থেকে তা নিষ্পত্তি করতে হবে। এ জন্য ব্যাংকগুলো স্থায়ীভাবে একটি নীতিমালা করবে। এর আগে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে এক্সিট সুবিধা দেওয়া হলেও তাতে তেমন সাড়া মেলেনি। গতকাল সোমবার নতুন করে এ-সংক্রান্ত নীতিমালা ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক এর আগে ২০১৯ সালের মে মাসে একবার ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে এক্সিটের জন্য বিশেষ নীতিমালা জারি করেছিল। এতে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে অনারোপিত সুদের সম্পূর্ণ অংশ এবং স্থগিত সুদ মওকুফের বিধান যুক্ত করা হয়। ওই সময়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এক হাজার ৩২২ কোটি টাকার এক্সিট সুবিধার বিপরীতে সুদ মওকুফ হয় এক হাজার ৬১৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক্সিটের ২৯৫ কোটি টাকা বেশি সুদ মওকুফ হয়। নতুন করে এমন এক সময়ে এক্সিটের নীতিমালা করা হলো যখন আইএমএফের শর্ত মেনে খেলাপি ঋণ কমানোর পরিবর্তে উল্টো বাড়ছে। গত মার্চ শেষে কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ ঠেকেছে এক লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকায়। ওই সময় পর্যন্ত তা বিতরণ করা মোট ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। ব্যাংক খাতে এখন প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকার মতো ঋণ অনাদায়ী রয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, এ রকম সুবিধা ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমানোর স্থায়ী কোনো সমাধান না। খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য কঠোর হতে হবে। অনাদায়ী ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন করে মামলা করতে হবে। ভবিষ্যতে যেন এ রকম না হয় সে জন্য ঋণ বিতরণের সময় যথাযথ ব্যক্তিকে দিতে হবে। এ জন্য পরিচালনা পর্ষদকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তা না করে শর্ষের মধ্যে ভূত রেখে সমস্যার সমাধান হবে না । খেলাপি ঋণ কমাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সুশাসন নিশ্চিত করা। এ জন্য প্রয়োজনে কিছু পরিচালককে জেলে দিতে হবে। যারা অনিয়মে জড়িত মালিকানায় থাকলেও তারা যেন পর্ষদে থাকতে না পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, ঋণগ্রহীতার ব্যবসা, শিল্প বা প্রকল্প কখনও কখনও বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে বন্ধ বা লোকসানে পরিচালিত হয়। এতে নগদ প্রবাহ বন্ধ বা অপর্যাপ্ত হয়ে ঋণ আদায় বাধাগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে গ্রাহকের প্রকৃত বিরূপ আর্থিক অবস্থার কারণে ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ– এরূপ ঋণ এক্সিটের আওতায় আদায় বা সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তবে এক্সিটের আওতায় ঋণ আদায় বিষয়ে কোনো নীতিমালা না থাকায় ব্যাংকগুলো ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি বা মানদণ্ড অনুসরণ করছে। এ রকম অবস্থায় ব্যাংকের তারল্য প্রবাহ অব্যাহত রাখা এবং শ্রেণীকৃত ঋণ কমানোর অনুসরণীয় নীতিমালা জারি করা হলো।
এতে আরও বলা হয়েছে, এ নীতিমালা এক্সিট প্রদানের ক্ষেত্রে ন্যূনতম মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হবে। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্যাংকগুলো পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিয়ে নিজস্ব নীতিমালা করতে হবে। সার্কুলারে দেওয়া শর্তের চেয়ে নমনীয় কোনো শর্ত যুক্ত করা যাবে না। আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ– এ রকম খেলাপি অথবা নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে প্রকল্প বা ব্যবসা বন্ধ বা ঋণগ্রহীতা কর্তৃক প্রকল্প বা ব্যবসা বন্ধ করার ক্ষেত্রে নিয়মিত ঋণে এক্সিট সুবিধা দেওয়া যাবে। এ সুবিধার আওতায় সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে ২০২২ সালে জারি করা সার্কুলারের নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মওকুফযোগ্য সুদ আলাদা ব্লকড হিসাবে স্থানান্তর করতে হবে। সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধ বা সমন্বয়ের পর ব্লকড হিসাবে রক্ষিত সুদ চূড়ান্ত মওকুফ হিসেবে গণ্য হবে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, সাধারণভাবে এক্সিট সুবিধা পাওয়া ঋণ পরিশোধের মেয়াদ হবে দুই বছর। তবে পরিচালনা পর্ষদ যুক্তিসংগত কারণ বিবেচনায় সর্বোচ্চ আরও এক বছর সময় বাড়াতে পারবে। এক বা একাধিক কিস্তিতে এ ঋণ পরিশোধ করা যাবে। একাধিক কিস্তিতে পরিশোধের ক্ষেত্রে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে পরিশোধসূচি করতে হবে। সমন্বয়ের আগে ঋণের বিপরীতে গৃহীত জামানত অবমুক্ত করা যাবে না। তবে ব্যাংক, গ্রাহক ও ক্রেতা আগ্রহী হলে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে আলোচ্য ঋণের বিপরীতে বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রির মাধ্যমে ঋণ সমন্বয় করতে পারবে। নিয়মিত ঋণেও এক্সিট সুবিধা দেওয়া যাবে। ঋণস্থিতির ন্যূনতম ১০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নগদে পরিশোধ করে এক্সিট সুবিধার জন্য আবেদন করতে হবে। আবেদন পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে ব্যাংক তা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নেবে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বা নির্বাহী কমিটি থেকে এক্সিট সুবিধা অনুমোদিত হতে হবে। তবে মূল ঋণ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত হলে এক্সিট সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর দেওয়া যাবে।