ভারত থেকে নেমে আসা ঢল আর অতিবৃষ্টিতে সিলেটে চলমান বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় বন্যার পানি কমছে ও কোনো এলাকায় বাড়ছে। ফলে দুর্ভোগ বাড়ছে বানভাসি মানুষের। সুরমা কুশিয়ারার পানি কোথাও এক সেন্টিমিন্টার কমছে ও অন্য পয়েন্টে বাড়ছে। কুড়িগ্রাম, শেরপুর, চট্টগ্রামের মীরসরাইসহ বিভিন্ন এলাকায় ভোগান্তি বেড়েছে পানিবন্দি লাখো মানুষের। বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ৩২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় অন্যত্র আশ্রয় নিতে হচ্ছে দুর্গতদের। নদনদীগুলোতে অস্বাভাবিক হারে পানি বৃদ্ধির ফলে গরু-ছাগল, সহায়-সম্পদ ও সন্তানদের নিয়ে বিপাকে পড়েছে বানভাসি মানুষ। ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
সিলেট, জকিগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ : সুরমা কুশিয়ারার সব পয়েন্টে বৃহস্পতিবার পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। উজান থেকে পানি নামতে থাকায় নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। নদী ও হাওড়াঞ্চল পানিতে ভরপুর থাকায় দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিচ্ছে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি। নগরের ভেতরে বিভিন্ন এলাকা বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত জলাবদ্ধ অবস্থায় আছে। বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় অনেক বাসিন্দা আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। অনেকেই আবার ঠাঁই নিয়েছেন স্বজনদের বাড়িতে। ২৯ মে ভারি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটে প্রথম বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ৮ জুনের পর পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়। এরপর দ্বিতীয় ধাক্কা আসে ১৬ জুন। পাহাড়ি ঢলে সিলেটের সীমান্তবর্তী দুই উপজেলায় বন্যা দেখা দেয়। পরে নগরীসহ জেলার ১৩টি উপজেলায় বন্যা হয়। গত ১৯ জুন ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ফের সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যা দেখা দেয়। পরে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলায় বিস্তৃত হয়। ২৫ জুন থেকে সিলেট অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করে। এরই মধ্যে গত সোমবার থেকে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে নদীর পানি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতি গুরুতর আকার ধারণ করেছে। সিলেট জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, সিলেটের ১৩টি উপজেলার মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ নেই শুধু সিলেট সদর, জৈন্তাপুর ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায়। সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর ও কোম্পানীগঞ্জে বন্যার পানি নামছে। ওসমানী নগর, বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলায় দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কারণে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। গোলাপগঞ্জে প্রায় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলছে অঘোষিত ছুটি। বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকায় এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আসতে পারছে না। ফলে বিদ্যালয়গুলোতে ঝুলছে তালা।
কুড়িগ্রাম, উলিপুর, রৌমারী, চিলমারী ও ফুলবাড়ী : ব্রহ্মপুত্র নদের পানি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী-তীরবর্তী ছয়টি উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার ফলে ৩৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ করা হয়েছে। দুই হাজার ৩০০ হেক্টর ফসলি জমি নিমজ্জিত এবং বানভাসিদের সহায়তায় ইউনিয়ন পর্যায়ে ৮৩টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলা প্রশাসন থেকে ৫০০ মেট্রিক টন চাল ও ২০ লাক টাকা বিতরণের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টির কারণে কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃহস্পতিবার বিকালে হাতিয়া পয়েন্টে ৭৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও ধরলা নদীর পানি ৪ সেন্টমিটার কমে গিয়ে বিকালে ২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। হঠাৎ করে পানি বৃদ্ধির ফলে বিপাকে পড়েছে বানভাসি মানুষ। তারা ছুটছে আশ্রয়ের খোঁজে। বেশির ভাগ বানভাসি মানুষ নৌকার মধ্যে রাত যাপন করছে। সরকারি প্রশাসন থেকে দুর্গতদের পাশে দাঁড়ালেও এখনো সবার কাছে পৌঁছেনি সরকারি সহায়তা। গত চার দিন ধরে নদনদীগুলোতে অস্বাভাবিক হারে পানি বৃদ্ধির ফলে গরু-ছাগল, সহায়-সম্পদ ও সন্তানদের নিয়ে বিপাকে পড়েছে বানভাসি মানুষ। ঘরের ভিতর পানি প্রবেশ করায় যাদের নৌকা আছে তারা নৌকায় আশ্রয় নিয়েছে। যাদের নৌকা নেই তারা ঘরের ভেতর মাচা ও চৌকি উঁচু করে সেখানেই আশ্রয় নেয়। রান্নাবান্না করে সেখানেই। আশপাশে যত উঁচু বাড়ি ও ফ্লাড শেল্টার রয়েছে, সেখানে আশ্রয়ের খোঁজে ছোটে বানভাসি মানুষ। এরকম পরিস্থিতিতে মাঠে থাকা পাট, সবজি, তিল, তিশিসহ কৃষিজাতীয় ফসল পানিতে নিমজ্জিত অবস্থায় রয়েছে। এভাবে কিছু দিন থাকলে বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছে চাষিরা। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পেয়ে ফেরিঘাটের সংযোগ সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় গত বুধবার থেকে চিলমারী-রৌমারী রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফেরি চলাচল বন্ধ থাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন পণ্যবাহী পরিবহণগুলো।
ফুলবাড়ীতে দ্বিতীয় মেয়াদে টানা ভারি বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে বারোমাসিয়া নদীর তীব্র ভাঙনে শতাধিক পরিবারের ঘর-বাড়ি হুমকির মুখে। নদীর তীব্র ভাঙনে বারোমাসিয়া নদীর উপর নির্মিত গোরকমন্ডল সেতু ও কাঁচা-পাকা দুটি সড়ক যোগাযোগ বিছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
বগুড়া : সারিয়াকান্দির যমুনা এবং বাঙালি নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকালে যমুনা নদীতে পানি বিপৎসীমার ৩২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। গত ২৪ ঘণ্টায় নদীতে ৬৮ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রায় ১২ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদুর রহমান জানান, এ উপজেলায় বন্যা শুরু হয়েছে। বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্র জানায়, সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর বিপৎসীমা ১৬.২৫ মিটার। বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় পানির সমতল ছিল ১৬.৫৭ মিটার। অর্থাৎ নদীতে পানি বিপৎসীমার ৩২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। গত ২৪ ঘণ্টায় নদীতে পানি ৬৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পায়।
কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) : কমলগঞ্জ উপজেলায় ধলাই নদীর পানি কমে গেছে। পানি কমার পর নদীর পাড়ের বসিন্দাদের মধ্যে এখন প্রতিরক্ষা বাঁধ ভাঙনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। বাঁধভাঙনের কারণে নদীপাড়ের মানুষরা নিজেদের উদ্যোগে বসত-বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছেন।
মীরসরাই (চট্টগ্রাম) : মীরসরাই উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে সহস াধিক পরিবার। কাজ না থাকায় কষ্টে রয়েছেন দিনমজুরসহ খেটে খাওয়া মানুষ। পাহাড়ি ঢলের সে াতে ভেঙে গেছে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার গ্রামীণ সড়ক। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে খাল সংস্কার না থাকায় ও অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনা নির্মাণের কারণে পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। নিমজ্জিত রয়েছে রোপা আমন ও সবজি খেত।
শেরপুর : ঝিনাইগাতী উপজেলার আকস্মিক বন্যার উন্নতি হলেও সেখান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে শেরপুর সদর উপজেলার গাজীরখামার ও নালিতাবাড়ী উপজেলার কলসপাড় ইউনিয়নের কমপক্ষে ২০টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামের বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চলে থাকা রোপা আমন বীজতলা, সবজি খেত তলিয়ে গেছে। অনেকের বাড়ি-ঘরে পানি ওঠায় মানুষ গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। বাড়িতে পানি ওঠার কারণে অনেক পরিবার তাদের চুলা জ্বালিয়ে রান্নাবান্নার কাজ করতে পারছেন না। গ্রামীণ রাস্তাঘাট ডুবে থাকায় অনেকেই হাঁটু পানি মারিয়ে এবং ডিঙ্গি নৌকায় চলাচল করছেন।
দেওয়ানগঞ্জ ও ইসলামপুর (জামালপুর) : দেওয়ানগঞ্জে বন্যার অবনতি হয়েছে। ধসে গেছে নির্মাণাধীন মহারাণী ও খোলাবাড়ী সেতুর অ্যাপোচ সড়ক। ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছে এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা। দেওয়ানগঞ্জ চিকাজানী খোলাবাড়ী ব্রিজের অ্যাপোচ এবং হাতিভাঙ্গা নির্মাণাধীন বাইপাস সংযোগ সড়ক ধসে পড়ায় দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার সঙ্গে প্রধান এ দুই সড়ক বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ইসলামপুর উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। যমুনার বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৬৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি মাপক গেজপাঠক আব্দুল মান্নান।
গাইবান্ধা ও সুন্দরগঞ্জ : গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, করতোয়া, ঘাঘট সবগুলো নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃহ¯পতিবার বিকাল ৩টায় গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় ৭০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ফুলছড়ি পয়েন্টে বিপৎসীমার ৭২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে ঘাঘট নদীর পানি ৯ সে.মি. বৃদ্ধি পেয়ে নতুন ব্রিজ এলাকায় বিপৎসীমার ২০ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নদীর তীরবর্তী এলাকা প্লাবিত হয়ে অন্তত ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় বাড়ছে তিস্তার পানি, ডুবছে নিচু এলাকা। পাশাপাশি ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। পৌরসভার রামডাকুয়া এলাকায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় শ্মশান ঘাটে পানি উঠেছে। এখনো ঠেকানো যাচ্ছে না অব্যাহত ভাঙন।
রাঙামাটি : বাঘাইছড়ির কাচালং সরকারি ডিগ্রি কলেজকেন্দ্র বন্যাকবলিত হয়ে ওই কেন্দ্রে চলমান এইচএসসি পরীক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কলেজ ক্যাম্পাস প্লাবিত হওয়ায় সাময়িকভাবে পরিত্যক্ত স্থাপনায় পরিণত হয়েছে। ফলে ওই কেন্দ্রে বৃহস্পতিবারের এইচএসসির ইংরেজি পরীক্ষা স্থগিত করে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড।
খাগড়াছড়ি : দীঘিনালার বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে। কমতে শুরু করেছে মাইনী নদীর পানি। মেরুং ইউনিয়নের ২০ গ্রামের মানুষ আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে। দুদিন বন্ধ থাকার পর খাগড়াছড়ির সাথে রাঙামাটির লংগদুর সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়েছে। সড়কের পানি নেমে যাওয়ায় বৃহস্পতিবার সকাল থেকে যান চলাচল শুরু হয়।