মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর নতুন কিছু নয় বরং বেশ পুরোনো। এমনিতেই এই কেন্দ্রটি চলছে অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। প্রয়োজনীয় কয়লা আমদানির অভাবে মাঝে মাঝে বন্ধ হওয়ার উপক্রমের ঘটনাও ঘটেছে নিকট অতীতে। তারপরও দেশের এই বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কোনমতে চালু রাখতে হয়েছে। কিন্তু কোনভাবেই দুর্নীতি ও অনিয়ম পিছু ছাড়ছে না বরং অভিযোগের ফিরিস্তি ক্রমেই দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হচ্ছে। কেনাকাটায় পুকুর চুরির অভিযোগ কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি নিয়ে একেবারেই উদাসীন ও নির্বিকার।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানির দরপত্রপ্রক্রিয়ায় অভিযোগ ওঠার পর এবার বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লা থেকে উৎপাদিত ‘ড্রাই অ্যাশ’ বিক্রির দরপত্রেও বড় ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান কোল পাওয়ার জেনারেশন কম্পানির (সিপিজিসিবিএল) বিরুদ্ধে। যা কেন্দ্রটির অনিয়ম ও দুর্নীতির ধারাবাহিকতায় প্রমাণ করে। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, কয়লার ‘ড্রাই অ্যাশ’ বিক্রিতে সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ দেওয়ার কথা থাকলেও সর্বনিম্ন দরদাতাকে দরপত্র পাইয়ে দিতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কিছু অসাধু কর্মকর্তা। এবার মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লার ছাই নিয়ে নয়ছয় হচ্ছে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘দরপত্রপ্রক্রিয়ায় প্রাথমিক বাছাইয়ে আর্থিক বিবরণীতে স্বচ্ছতার ঘাটতি থাকায় যে কোম্পানিকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়, সেই প্রতিষ্ঠানকেই কাজ পাইয়ে দিতে অদৃশ্য কারণে ১০ মাস ধরে দরপত্রকে আটকে রাখা হয়েছে। যা জনমনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে।
জানা গেছে, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির এক সদস্যের ছেলে ওই বিশেষ কনসোর্টিয়ামের একটি কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত আছেন। পাশাপাশি আর্থিক সুবিধা নেওয়া সাপেক্ষে কমিটির কয়েকজন সদস্য ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতি পক্ষপাত করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, সিপিজিসিবিএলের পরিচালকের ছেলে বিভিন্ন সময় দরপত্রপ্রক্রিয়ার সুবিধা গ্রহণে নিজেকে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর আস্থাভাজন ব্যক্তি এবং প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের কাছের লোক’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। এ ধরনের প্রতারণা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তার বিরুদ্ধে কোন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না।
জানা গেছে, গত এপ্রিলে সিপিজিসিবিএলের বোর্ড সভায় ‘বিশেষ একজন কর্মকর্তা’ কারিগরি কমিটির প্রতিবেদন আমলে না নিয়ে উক্ত কনসোর্টিয়ামকে যোগ্য ঘোষণা করতে বোর্ডকে প্রভাবিত করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে বোর্ড এ বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে দরপত্র পুনর্মূল্যায়নের জন্য কারিগরি কমিটিকে নির্দেশ দেয়। এরই মধ্যে দরপত্রের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও গত এপ্রিল মাসে চিঠি পাঠিয়ে মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধ করে সিপিজিসিবিএল। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দরপত্রের নিয়ম অনুযায়ী কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি তার প্রতিবেদন পেশ করার পরপরই অংশগ্রহণকারীদের আর্থিক প্রস্তাব উন্মুক্ত করার নিয়ম রয়েছে। তবে ব্যক্তিগত সুবিধা গ্রহণ করে সিপিজিসিবিএলের বিশেষ এক কর্মকর্তা সবার আর্থিক প্রস্তাব উন্মুক্ত না করে একটি ‘বিশেষ’ কম্পানিকে সুবিধা দিতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডি বিভাগের অধীন বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটির (বিপিপিএ) দরপত্র মূল্যায়ন ট্রাইব্যুনালের পরামর্শ না নিয়ে ওই দপ্তরের একজন প্রশিক্ষকের মতামত নেওয়া হয়। বিষয়টি প্রকল্পের অনুদানকারী প্রতিষ্ঠান জাইকাকেও জানানো হয়নি। ফলে ওই বিশেষ কর্মকর্তার জালিয়াতিতে পুরো দরপত্রপ্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এর আগে কয়লা আমদানির দরপত্রের প্রাথমিক শর্তানুযায়ী কমপক্ষে ১২ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা আমদানির অভিজ্ঞতার শর্ত উল্লেখ ছিল, যা কয়লা আমদানিসংশ্লিষ্ট দরপত্রের জন্য একটি প্রাসঙ্গিক শর্ত। কিন্তু একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে ‘অনৈতিক সুবিধা’ প্রদানের উদ্দেশ্যে ওই শর্ত শিথিল করে ১২ মিলিয়ন মেট্রিক টন লোহা, সার, কেমিক্যাল, সিমেন্ট অথবা খাদ্যশস্য আমদানির অভিজ্ঞতাকে যোগ্যতা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা একটি অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে।
এদিকে সম্প্রতি মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য সাধারণ কিছু ‘হ্যান্ড টুলস’ আমদানিতে বড় ধরনের অনিয়মের বিষয় উঠে এসেছে। যা জনমনে রীতিমত চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। এতে ছোট ছোট পাইপ কাটার, হাতুড়ি, মেটালসহ মোট ১৯টি সাধারণ যন্ত্রপাতি কিনতে হাজার গুণ পর্যন্ত বেশি মূল্য ধরা হয়েছে। একটি পাইপ কাটারের দাম ধরা হয়েছে ৪৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা, যেটির সাধারণ বাজারমূল্য সর্বসাকুল্যে সাত হাজার টাকা। একটি হাতুড়ির দাম ধরা হয়েছে ৯১ হাজার টাকা, যেটির বাজারমূল্য ৮৩৪ টাকা। গত ৯ জানুয়ারি সিপিজিসিবিএলের অনুকূলে জার্মানি থেকে ৩৪৪.৫ কিলোগ্রাম ওজনের একটি চালান আসে। এই চালানের আমদানিমূল্য মোট ২.৭৫ কোটি টাকা, যেখানে দুটি পাইপ কাটারের দাম দেখানো হয়েছে ৯২ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। তা রীতিমত তুঘলকী কাণ্ড বলে বিবেচনা করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বিষয়টি নিয়ে বারবার গণমাধ্যমে ফলাও করে সংবাদ প্রকাশ করা হলেও সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অভিযুক্তদের জন্য কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি বরং তা এখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। এমতাবস্থায় দেশের বৃহত্তর এই বিদ্যুৎপ্রকল্প অনিয়ম ও দুর্নীতিমুক্ত করতে অপরাধীদের বিরুদ্ধ শূন্য সহনশীলতা দেখানোর কোন বিকল্প নেই। অন্যথায় এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানটি আগামী দিনে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।