পাহাড়ি ঢলের কাছে বার বারই হার মানছে সিলেট। ভৌগোলিক অবস্থানে সিলেট অঞ্চল ভারতের মেঘালয় ও আসামের পার্শ্ববর্তী এলাকা। ওই দুই রাজ্যের পানির বেসিন বা অপসারণের স্থান হচ্ছে সিলেট জেলা। দু’রাজ্যের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকায় বৃষ্টি হলেই ডুবে যাচ্ছে সিলেট। নগরও ডুবছে। এই অবস্থায় সিলেটের মানুষের দুঃখে পরিণত হয়েছে উজানের পাহাড়ি ঢল। বার বারই থমকে যাচ্ছে জীবনযাত্রা। এতে বছর বছর ক্ষতি হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে ভোগান্তি। খাবার সংকটে পড়ে সিলেটের মানুষ।
২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার ক্ষত কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই এবার তৃতীয় দফা বন্যার কবলে সিলেট।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এখনো উজানে ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যে তীব্র বর্ষণ হচ্ছে। ওই এলাকায় যতই বৃষ্টিপাত হয় ততই শঙ্কা জাগে সিলেটে। এবারো তাই হয়েছে। পরপর তিন দফা বন্যার শেষ দফার পানি কোথায় গিয়ে ঠেকে তা এখনো বলা মুশকিল। আকাশে মেঘ আছে। এই বৃষ্টি ঝরা শেষ হলে বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে বলা যাবে। সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ মানবজমিনকে জানিয়েছেন, বন্যা থেকে সিলেটকে উদ্ধার করতে হলে সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন। রাতারাতিই পানি চলে আসে সিলেটে। ডুবে যায় নগর।
এজন্য সিলেটের সব দপ্তরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে আগামীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিতে আলোচনা করতে হবে। নতুবা সিলেট প্রতি বছরই ডুববে। তিনি বলেন, এবারের তিন দফা বন্যার কারণে সিলেটের বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে গেছে। এখনো ঢল নামছে। এই ঢল নদী উপচে তীরবর্তী এলাকা কিংবা হাওরে ঢুকছে। এতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে আশঙ্কা করেন তিনি। সিলেটের এই পাহাড়ি ঢল নিয়ে কোথাও স্বস্তি নেই। ঢলে ইতিমধ্যে তলিয়ে গেছে কানাইঘাট সদর। লোভা ও সারি নদীর পানি বাড়লে কানাইঘাট, বড়হাওরসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় পানি বাড়ে। এই পানি দু’একদিনের মধ্যে এসে আঘাত করে সিলেট নগরে। এতে করে নগরের এক তৃতীয়াংশ এলাকাও অচল হয়ে পড়ে। নগরের কালীঘাটের ব্যবসায়ীরা পানি বাড়ায় আতঙ্কে আছেন। দ্বিতীয় দফা বন্যায় তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এবার পানি বাড়লে তারা আরও লোকসানে পড়বেন বলে জানিয়েছেন।
সিলেট নগরকে ঢলের পানি থেকে রক্ষা করতে শুধু নগর বাঁচালেই হবে না বলে মন্তব্য করেছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। তার মতে, পানি আসে উজান থেকে। এজন্য নগর এলাকা ছাড়াও উজান ও নিম্নাঞ্চলে নদীতে পানি প্রবাহের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। সুরমা নদী বেশি পরিমাণ পানিধারণ করতে পারলে নগরে পানি ওঠা কমে যাবে। আর নগর অংশে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে প্রতিটি খালের মুখে স্লুইসগেট বসিয়ে দিতে হবে। নগরের অবৈধ দখলে থাকা ছড়া ও খালকে উদ্ধার করে পানি প্রবাহের পথ সুগম করতে হবে। তিনি জানিয়েছেন, সিলেট বাঁচাও, নগর বাঁচাও এই স্লোগানে একটি কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছি। সেখানে শুধু সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরাই নয়, সিলেটের মানুষকেও এতে সম্পৃক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। বছর বছর বন্যা থেকে নগর ও সিলেটকে বাঁচাতে কার্যকর উদ্যোগের চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।
এদিকে সিলেট নগরে সুরমার পানি উপচে পড়লেই তলিয়ে যায় নগর। এনিয়ে ক্ষোভের অন্ত নেই। এ কারণে নগর বাঁচাতে বেড়িবাঁধ নির্মাণের কথা কয়েক বছর ধরেই বলে আসছেন নগরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার নুর আজিজুর রহমান। তিনি জানিয়েছেন, সুরমার পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি নগরে বাঁধ নির্মাণ জরুরি হয়ে পড়েছে। একইসঙ্গে প্রতিটি ছড়া বা খালের মুখে স্লুইসগেট নির্মাণ করা জরুরি। নগরের পানি পাম্প দিয়ে সুরমাতে ফেলে দেয়া সম্ভব হবে। এতে করে হঠাৎ ডুবে যাওয়া নগর রক্ষা পাবে বলে জানান তিনি। বার বার ডুবে যাওয়া বন্যা নিয়ে সিলেটের পরিবেশবাদীরাও চিন্তিত। সেইফ দ্য এনভায়রনমেন্ট সিলেটের সভাপতি আব্দুল হাই আল হাদী জানিয়েছেন, সিলেটের এই বিপর্যয়ের মূলে রয়েছে পরিবেশ বিপর্যয়। এজন্য সবারই দায় আছে। সিলেটে নদী খননের পাশাপাশি হাওর, বিল, খাল ও পুকুর দখল করে স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। নতুবা এই সিলেটকে রক্ষা করা কষ্টকর হবে বলে জানান তিনি।