সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে কাজ না করলে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থানীয়রা দুর্নীতিমুক্ত না হলে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান কাজে আসবে না। এর আগে ঘটা করে করা মাদকবিরোধী অভিযান, শুদ্ধি অভিযানের মতো এটাও ব্যর্থ হবে। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিয়ে সরকারকে আগে দুর্নীতি দমনের রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রমাণ করতে হবে। বিশিষ্ট নাগরিকরা এই অভিমত জানিয়েছেন।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য মতিউর রহমানের বিপুল সম্পদের তথ্য সংবাদমাধ্যমে আসার পর তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে সরকার। আরও কয়েক সাবেক ও বর্তমান আমলার সম্পদের তথ্য সামনে এসেছে। আবারও দুর্নীতির শূন্য সহিষ্ণুতার নীতির কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শনিবার সংসদে ঘোষণা দেন, দুর্নীতিবাজদের ধরতে অভিযান শুরু হবে। গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে সরকারপ্রধান বার্তা দেন, দুর্নীতিবাজদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো হবে না।
এসব ঘোষণাকে ইতিবাচক মনে করলেও এতে দুর্নীতির মূলোৎপাটন হবে না বলে মনে করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না। সাবেক সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের অভিমত, এসব ঘোষণা রাজনৈতিক বক্তব্য মাত্র।
আর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, দুর্নীতি দমনে প্রথমেই প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতায় ফাওজুল কবির সমকালকে বলেন, সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি ধরতে হলে একেবারে মাঠ পর্যায় থেকে শুরু করতে হবে। সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা সম্ভব, কে কত সম্পদের মালিক হয়েছেন। সেখান থেকেই শুরু করতে হবে।
তবে তারও আগে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন ফাওজুল কবির। তিনি বলেছেন, এ কাজটি করতে পারলে অন্তত বার্তা যাবে– সরকার দুর্নীতি বন্ধ করতে চায়। বর্তমানে যারা আছে, তাদের নিয়ে দুর্নীতি বন্ধ সম্ভব নয়। সম্ভব হলে দুর্নীতি এতটা বে-লাগাম হতো না।
কোথায় পাওয়া যাবে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির কর্মকর্তা– প্রশ্নে সাবেক বিদ্যুৎ সচিব ফাওজুল কবির বলেছেন, প্রশাসনে অনেক ভালো মানুষ রয়েছেন। কোন কর্মকর্তা কেমন, কে ভালো আর কে মন্দ– তা মোটামুটি সবার জানা। সরকার চাইলেই ভালোদের দায়িত্ব দেওয়া সম্ভব। পুলিশে, এনবিআরে সৎ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হোক। যে নিজে দুর্নীতিবাজ, তার পক্ষে দুর্নীতি রোধ সম্ভব নয়। বর্তমানে যে ব্যবস্থা চলছে, তাতে দুর্নীতি রোধ হবে না। ব্যবস্থায় বদল প্রয়োজন। শাস্তি দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে, যা সিঙ্গাপুর পেরেছে। সে কারণেই দেশটিতে দুর্নীতি কমেছে। বক্তৃতা দিয়ে সেখানে দুর্নীতি কমেনি।
সবার আগে বিচার অঙ্গনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে বলে অভিমত জেড আই খান পান্নার। তিনি বলেছেন, শুধু বিচারক নন; আইনজীবী, বেঞ্চ অফিসার, কেরানি থেকে শুরু করে সবাইকে নিয়েই দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। আদালত দুর্নীতিমুক্ত হলে সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়ে যাবে। কারণ, দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো সাংবিধানিক বা সরকারি যে প্রতিষ্ঠানই দুর্নীতি ধরুক, বিচার তো করবেন আদালত। আদালত দুর্নীতিমুক্ত না হলে দুর্নীতির মূলোৎপাটন অসম্ভব।
আদালতকে দুর্নীতিমুক্ত করার পথ বাতলে জেড আই খান পান্না বলেছেন, বিচার বিভাগকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। বিচার বিভাগে যদি এ ধারণা থাকে, পদোন্নতি পদায়ন আটকে যাবে, তাহলে তো সেই বিচার বিভাগকে স্বাধীন বলা যায় না।
দুর্নীতি দমনে দুদকের চেয়ে বিচার বিভাগের বাধামুক্ত কাজ করা জরুরি বলে মনে করেন জেড আই খান পান্না। তিনি বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টে ক্ষমতা রয়েছে স্বপ্রণোদিত হয়ে আদেশ দেওয়ার। কিন্তু একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং একজন সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির সঙ্গে যা হয়েছে, তাতে অন্যদের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতি দমনের প্রতিশ্রুতি রয়েছে জানিয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা একাধিকবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলেছেন। জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। কিন্তু দুর্নীতি তো কমেনি, বরং মহিরুহ আকার নিয়েছে। ঘোষণা কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই।
আইন বিভাগ দুর্নীতিতে উৎসাহ জোগাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেছেন, যে সংসদে এমপিরা দুর্নীতিবিরোধী কড়া ভাষণ দিচ্ছেন, সেই সংসদে কালো টাকা সাদা করার অসাংবিধানিক আইন পাস হয়েছে।
দুদকের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, দুর্নীতি দমন কমিশনই এমনভাবে দায়িত্ব পালন করে, ক্ষমতাসীন দলের সংশ্লিষ্টরা পার পেয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, রাজস্ব বোর্ডসহ দুর্নীতি দমনের কাজে নিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধেই অনিয়মের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। এসব প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যেভাবে দুর্নীতির খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতেই এসব অভিযোগের সত্যতা রয়েছে বলা যায়। তাই দুর্নীতি কমাতে এখন সরকারের ঘোষণার ওপর ভরসা করা ছাড়া আপাতত আর কোনো উপায় নেই। তবে তা কতটুকু কার্যকর হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতি রোধে স্বচ্ছ রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে। এ ছাড়া দুর্নীতি দমনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে ঢেলে সাজিয়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সংস্থাগুলোতে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও শাস্তির ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।