চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ১৪ হাজার কোটি টাকার চারটি বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। বেশির ভাগ প্রকল্পের কাজই শেষ পর্যায়ে। কিন্তু জলাবদ্ধতা নিরসনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সবেমাত্র বর্ষা মৌসুম শুরু হয়েছে, এরই মধ্যে আতঙ্ক ভর করেছে নগরবাসীর মধ্যে। আগের মতো অল্প বৃষ্টিতেই তলিয়ে যাচ্ছে নগরী। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব কাজ শেষ হলে সুফল মিলবে। তবে নগর পরিকল্পনাবিদরা ডিজাইনে ত্রুটির কথা উল্লেখ করে বলছেন, প্রকল্প যারা করছে তাদের সেই অভিজ্ঞতা আছে কি না এবং যারা প্ল্যানিং, ডিজাইন ও ফিজিবিলিটি স্টাডি করেছে তারা যোগ্য কিনা তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়গুলো সঠিক না হলে, শুধু টাকা খরচ হবে।
জলাবদ্ধতা নিরসন হবে না। বিভিন্ন সময়ে আসা এসব মন্তব্য ধীরে ধীরে জোরালো হয়ে উঠছে। প্রকল্পগুলোর সুফল নিয়ে সংশয় জোরদার হচ্ছে। চার প্রকল্পের দুটি বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ও পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
রোববার দুপুর ১২টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ৬৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে পতেঙ্গাস্থ আবহাওয়া অফিস। এদিন ভোর থেকে সকাল পর্যন্ত বৃষ্টিতে নগরীর নিচু এলাকাগুলোতে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। বিশেষ করে কাতালগঞ্জ, ষোলশহর দুই নম্বর গেট, মুরাদপুর, আগ্রাবাদ কমার্স কলেজ সংলগ্ন এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সড়ক তলিয়ে যায় হাঁটুপানিতে। এর আগে গত ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ১৩২ মিলিমিটার বৃষ্টিতে নগরজুড়ে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। ওই সময় হাঁটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে যায় নগরীর বেশির ভাগ এলাকা। চকবাজার, প্রবর্তক মোড়, মুরাদপুরসহ কয়েকটি স্থানে বুক সমান পানি ওঠে। নগরীর অধিকাংশ এলাকাই তলিয়ে যায়।
জলাবদ্ধতা এখন নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। টানা আধা ঘণ্টা বৃষ্টি হলেও পানিতে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে নিচু এলাকাগুলো। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে নেওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা মনে হচ্ছে জলেই যাচ্ছে! তবে যাই হোক প্রকল্পের মেয়াদ না বাড়িয়ে দ্রুত কাজ শেষ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন নগরবাসী।
জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০১৭ সালে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘খাল পুনর্খনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ শুরু করে চউক। সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে। ২০২০ সালের জুনে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দফায় দফায় ব্যয় ও সময় বাড়ানোর কারণে এখনো শেষ হয়নি। প্রকল্পের মেয়াদ তিন দফা বাড়িয়ে ২০২৬ সালের জুন পর্র্যন্ত নির্ধারণ হয়। প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। প্রকল্পের অধীনে ৩৬টি খাল সংস্কার, ড্রেনেজ নির্মাণ, গার্ডার ব্রিজ, কালভার্ট এবং বন্যার পানি সংরক্ষণের জন্য জলাধার তৈরি করা হচ্ছে। প্রকল্প পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ সম্প্রতি এক সভায় বলেন, ‘শেষের দিকে এসে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। খাল-নালা উদ্ধার করতে গিয়ে অনেক অবৈধ ভবন ভাঙতে হচ্ছে। সবকিছুর মধ্যে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা রয়েছে। কোনো কোনো বিষয় সমাধান করতে সময় নিতে হচ্ছে। জটিলতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বর্ধিত মেয়াদের মধ্যে (২০২৬ সালের জুন) প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলে আশা করছি।’ চউকের প্রকল্প পরিচালক নির্বাহী প্রকৌশলী আহম্মদ মঈনুদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
তিনি জানান, ১৬২ দশমিক ৯৪ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়ালের মধ্যে ১২৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার শেষ হয়েছে। ৪৫টি ব্রিজের মধ্যে ৩৬টি, ৭০টি কালভার্টের মধ্যে ৬০টি, ৬টি রেগুলেটরের মধ্যে ৫টি, ২৭টি সিল্ট ট্র্যাপের মধ্যে ১১টির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া ২৩.২০ কিলোমিটার নতুন ড্রেনের মধ্যে ১৩ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার, ৯০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার ড্রেন সম্প্রসারণের মধ্যে ৪৯ দশমিক ১৬ কিলোমিটার, ৩৬ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার খালপাড়ের রাস্তা ও বিটুমিনাস রাস্তার মধ্যে ২১ দশমিক ৭৮ কিলোমিটার, ৫০ কিলোমিটার ফুটপাতের মধ্যে ১২ দশমিক ৭৮ কিলোমিটারের কাজ শেষ করা হয়েছে। এদিকে ৩৬টি খালের মধ্যে ১৭টির কাজ সম্পূর্ণ শেষ হয়েছে। আরও ৫টি খালের ৮৫ শতাংশ কাজ হয়েছে বলে জানান চউকের এ কর্মকর্তা।
চউকের আরেক প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ২ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ। প্রকল্পটি ২০১৭ সালে নেওয়া হয়। প্রকল্পের অগ্রগতি ৭০ শতাংশ। প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। প্রকল্পের অধীনে ৯ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের পাশাপাশি ১২টি খালের মুখে রেগুলেটর স্থাপন, ড্রেন, ওয়াকওয়ে, পাম্প হাউজ, বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন নির্মাণের কথা রয়েছে।
এছাড়া ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা ব্যয়ে আরেকটি প্রকল্প (বাঁধ নির্মাণ) বাস্তবায়ন করছে পাউবো। সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে নেওয়া এ প্রকল্পে ২৩টি রেগুলেটর নির্মাণ, রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণসহ বেশ কিছু কাজ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৪টি রেগুলেটর নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। এ বছর ১০টি নির্মাণ শেষ হবে। দুই দফায় মেয়াদ বৃদ্ধি করে এ বছর জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এখনো অর্ধেকের বেশি কাজ বাকি।
চতুর্থ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে চসিক। ২৮৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে নগরীর বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্র্যন্ত খাল খননের এ প্রকল্পটি ২০১৪ সালে হতে নেওয়া হয়। ১০ বছর আগে এই প্রকল্পটি যখন নেওয়া হয় তখন মেয়র ছিলেন বিএনপি থেকে নির্বাচিত এম. মনজুর আলম। দফায় দফায় মেয়াদ বাড়লেও কাজ শেষ হয়নি। এরই মধ্যে এই প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ১ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা হয়েছে। চলতি জুনে মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রকল্পের অগ্রগতি ৬০ শতাংশের মতো। আবারও মেয়াদ বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে। এর আগে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমলে জলাবদ্ধতা নিরসনে চাক্তাই খাল খনন, তলা পাকাকরণ, বর্জ্য অপসারণে একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। তবে শত কোটি টাকায় নেওয়া এসব প্রকল্প বর্তমান হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের সামনে আর আলোচনাতেই আসছে না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
তবে এসব প্রকল্পের ডিজাইনে ত্রুটি থাকায় সুফল মিলছে না বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাস বড়ুয়া। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রকল্প অনেক হচ্ছে। কিন্তু সুফল তো কেউ পাচ্ছে না। প্রকল্প যারা করছে তাদের সেই অভিজ্ঞতা কতটুকু আছে এবং যারা প্ল্যানিং ও ডিজাইন করছে, ফিজিবিলিটি স্টাডি করেছে, এই বিষয়গুলো যদি সঠিক না হয়, তাহলে তো শুধু টাকা খরচ হবে। জলাবদ্ধতা নিরসন হবে না। এ পর্র্যন্ত জনগণ এটা দেখে আসছে।’ তিনি বলেন, ফিজিবিলিটি স্টাডির ওপর যে ডিজাইন হয়েছে, তা সঠিক কিনা সেটা দেখবে কে। আমাদের এখানে আইএমইডি নামের যে প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তারাই বলছে ফিজিবিলিটি স্টাডি তাড়াহুড়ো করে করা হয়েছে। এ ধরনের প্রকল্প তাড়াহুড়ো করলে তো কোনো সুফল পাওয়া যাবে না, বরং জনগণের টাকাই খরচ হবে। ডিজাইন ও কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা, তার দেখভাল করছে কে? মনে হয় কেউ করছে না। সিডিএ প্রকল্প নেওয়ার এত বছর পর বলছে, ৭৫টি জায়গায় ওয়াসার পাইপ আছে যেগুলো জল নিষ্কাশনে প্রধান বাধা। এর আগে কিন্তু সিডিএ এই প্রকল্পে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা খরচ করে ফেলেছে। কোথায় কোথায় প্রতিবন্ধকতা আছে তা ডিজাইন ও কাজ শুরুর আগে দেখা কি উচিত ছিল না? এখন কেন এগুলো দেখছে। এটা তো কোনো ডিজাইন, প্ল্যানিং প্রসেসের মধ্যেই পড়ে না। এছাড়া খালগুলো দিয়ে কী পরিমাণ পানি সরবে, তার কোনো স্টাডিও হয়েছে কিনা দেখতে হবে। সলিড ওয়াস্ট ম্যানেজমেন্ট নিয়ে চিন্তা না করে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে তা কোনো কাজে আসবে না উল্লেখ করে প্রকৌশলী সুভাস বড়ুয়া বলেন, ‘খাল-নালা পরিষ্কার করলে হয়তো এক বছর পানি সরবে। কিন্তু পরের বছর থেকে বর্জ্য জমা হয়ে ভরাট হয়ে যাবে।’
এদিকে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে চউক ও চসিকের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে বলে বিভিন্ন সময় অভিযোগ ওঠে। সমন্বয় না থাকায় প্রকল্পগুলোর নিখুঁত বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে, এমন অভিমত নগর পরিকল্পনাবিদদের অনেকের।