সিলেট-সুনামগঞ্জ এবং উত্তরের রংপুর-কুড়িগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যার পানি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরছেন মানুষ। তবে সিলেটে সোমবারের বৃষ্টিতে বন্যাকবলিত মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। এদিকে নদনদীতে পানি কমার পাশাপাশি তিস্তা-যমুনাসহ বিভিন্ন নদীতে আবার তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। ফলে নদীতীরবর্তী মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। সেই সঙ্গে বেড়েছে সংকট। যুগান্তর ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
সিলেট : সিলেটে গত তিনদিন রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ার পর সোমবার সকালে বৃষ্টি হয়েছে। ফলে নদনদীর পানি কিছুটা বেড়েছে। রোববার সকাল ৬টা থেকে সোমবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৪ দশমিক ১ মিলিমিটার। তবে সোমবার সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৫১ মিলিমিটার। সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর চার পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। জেলা প্রশাসন ও আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, ২৮ জুন থেকে সিলেটে অতি ভারি বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আগাম সতর্ক থাকতে বলেছে সিলেট জেলা প্রশাসন। নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডের নিচু এলাকা এখনো পানির নিচে। সিলেট বঙ্গবীর রোডে হাঁটুসমান পানি। সিলেট-সুলতান রোডের নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজের সামনে হাঁটুজল থাকায় ইঞ্জিনে পানি ঢুকে নষ্ট হচ্ছে গাড়ি। বিড়ম্বনা ও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে পরিবহণযাত্রীদের। খোজারখলা কায়স্তরাইল, তালতলা ও উপশহর এলাকার বাসাবাড়িতে এখনো পানি। অপরদিকে সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায় প্রধান প্রধান সড়ক থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন অনেকে। কেউ কেউ রয়েছেন ফেরার অপেক্ষায়। তবে বন্যাকবলিত ওইসব এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সংকট। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বন্যাকবলিত এলাকায় পর্যাপ্ত ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। তবে বানভাসিদের দাবি, তারা যা পাচ্ছেন, তা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। আশ্রয়কেন্দ্রেগুলোয় শুকনা খাবার পেলেও বাড়ি গেলে এটি মিলবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন বন্যার্তরা।
গোলাপগঞ্জ (সিলেট) : সিলেটের গোলাপগঞ্জের কুশিয়ারা ডাইকের ওপর দিয়ে ঢুকছে পানি। উপজেলার ভাদেশ্বরের মীরগঞ্জ বাজার পয়েন্ট দিয়ে এ পানি ঢুকে পড়ার কারণে বাজারের দুই শতাধিক দোকানপাট বন্ধ রয়েছে।
ছাতক (সুনামগঞ্জ) : সুনামগঞ্জের ছাতকে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও ধীরগতিতে নামছে পানি। মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢল ও ভারি বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যার পানির প্রবল স্রোতে ভেঙে গেছে উপজেলার বিভিন্ন সড়ক। এখনো পানির নিচে তলিয়ে আছে অনেক গ্রামীণ সড়ক। লন্ডভন্ড হয়েছে বীজতলা, ফসলের মাঠ, মৎস্য খামার। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজার হাজার বসতবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। আশ্রয় কেন্দ্র থেকে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরছেন মানুষ। পানি কমতে শুরু হওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে বন্যার্তদের মাঝে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভাতগাঁও, সিংচাপইড়, দোলারবাজার, ছৈলা-আফজলাবাদ, চরমহল্লাহ, কালারুকা, ইসলামপুর ও নোয়ারাই ইউনিয়নের রাস্তাঘাট। একাধিক সড়কে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। শনিবার ওই ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেন উপজেলা চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম কিরণ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গোলাম মস্তাফা মুন্না, ছাতক সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম। আপাতত সড়কে ছোট যানবাহন চলাচলের জন্য সরকারিভাবে ইউএনও ১ লাখ, উপজেলা চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার ও ইউপি চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার মিলিয়ে দুই লাখ টাকার মাটি ভরাটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী সাব্বির আহমেদ বলেন, বন্যায় উপজেলার ৫/৬ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছাতক সওজ বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী সালাহ উদ্দিন সুহাগ বলেন, বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ছাতক-সুরমা সেতুর উভয় অ্যাপ্রোচ সড়ক। দোয়ারাবাজার উপজেলার অংশে একাধিক স্থানে গর্ত ও ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। ছাতক-গোবিন্দগঞ্জ সড়কের ঝাওয়া ও সুফিনগর এলাকায়ও একাধিক স্থানে গর্ত ও ভাঙন রয়েছে।
জগন্নাথপুর (সুনামগঞ্জ) : জগন্নাথপুরে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ৩-৪ দিনে পানি কমেছে প্রায় দেড় ফুট। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় প্রয়োজনীয় খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে মানুষ কষ্ট করছে। জগন্নাথপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল-বশিরুল ইসলাম জানান, বন্যার্তদের জন্য এ পর্যন্ত সাড়ে ৭২ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বেসরকারিভাবেও বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন এগিয়ে এসেছে। পুরো উপজেলায় ১৪৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৪ হাজার বন্যার্ত আশ্রয় নিয়েছেন।
তিস্তাপারে বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক : রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছায় তিস্তা নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। বর্তমানে কাউনিয়ার তিস্তা রেল সেতু পয়েন্টে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নতুন করে ভাঙছে নদীর তীর ও বসতভিটা। দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তিস্তাপারের লোকজন। তারা ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। এছাড়াও তিস্তাবেষ্টিত কাউনিয়া উপজেলার গদাই এলাকার অর্ধশতাধিক পরিবার ভাঙনঝুঁকিতে রয়েছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, বর্ষা মৌসুমের আগে ভাঙন ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এতে তারা ভাঙনের কবলে পড়েছেন। ভাঙন রোধে নিজ খরচে কেউ কেউ বালুর বস্তা ফেলছেন। পরিবারের সব সদস্যরা মিলে নিজ বাড়ি রক্ষায় নেমে পড়েছেন। আবার অনেকে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন বাড়িঘর। কেউ কেউ গবাদি পশুসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করে দিচ্ছেন। কাউনিয়া উপজেলার গদাই এলাকায় ভাঙন আতঙ্কে আছেন আজিজুল, হাফেজ, শুরুজ আলি, তারা মিয়া, বাবুল, শহিদুল, রাজ্জাক, ফুল মিয়া, আলেফ, শাহিন, মোস্তাক, আমজাদ, ওসমান, রফিকুলসহ অনেকেই। তারা বলেন, কয়েক দফায় নদীতে ভেঙে গেছে বসতভিটা। এবার ভাঙলে আর কিছু থাকবে না। একই পরিস্থিতি গঙ্গাচড়া উপজেলার নোহালী, লক্ষ্মীটারি, আলমবিদিতর, মর্ণেয়া ও গজঘণ্টা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায়। পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ও তাম্বুলপুর এলাকায়ও ভাঙন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। কাউনিয়া উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় আমন ধানের বীজতলা ও উঠতি বাদামের ক্ষতি হয়েছে। শতাধিক পুকুর ও মৎস্য খামারের মাছ ভেসে গেছে। ফলে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এসব মৎস্য খামারিসহ কৃষকরা। কাউনিয়া সদর বালাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনসার আলী বলেন, ভাঙন এলাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ইতোমধ্যে পরিদর্শন করেছি। কিছু বস্তায় বালু ও সিমেন্ট দিয়ে ফেলা হয়েছে। আরও ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড রংপুরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব জানিয়েছেন, এক মাস আগে এক হাজার বালুর বস্তা ফেলা হয়েছে। ভাঙন রোধে চেষ্টা চলানো হচ্ছে বলে তিনি জানান।
সারিয়াকান্দিতে যমুনার ভাঙন : বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। সোমবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় পানি ২৬ সেন্টিমিটার কমেছে। তবে পানি কমলেও তীব্র স্রোত ও ঘূর্ণাবর্তে শিমুলতাইড় গ্রামে নদীতীরে ভাঙন বেড়েছে। ইছামারা গ্রামে ৪০০ মিটার এলাকাজুড়ে ধসের সৃষ্টি হয়েছে। ৫০ বিঘা কৃষিজমি যমুনায় বিলীন হয়েছে। পাশাপাশি বাঙালি নদীর পানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে যমুনা নদীর পানি কমলেও বাড়ছে বাঙালি নদীর পানি। যমুনা নদীর পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে উপজেলার চালুয়াবাড়ী ইউনিয়নের শিমুলতাইড় গ্রামে যমুনা নদীর ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। এ গ্রামের বেশকিছু বাসিন্দা গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছেন। কামালপুর ইউনিয়নের ইছামারা গোদাখালী গ্রামে যমুনা নদীর ভাঙন অনেক বেড়েছে। এখানে তীর সংরক্ষণ কাজের প্রায় ২০ মিটার এলাকার জিও ব্যাগও ধসে গেছে। এতে ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে ইছামারা গোদাখালি এলাকার ৩০০টির বেশি পরিবার। হুমকিতে রয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধও। এছাড়া মানিকদাইড় গ্রামের উত্তরপাশে জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ সীমানায় যমুনা নদীর ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে।