শাসকদল আওয়ামী লীগ এবং তাদের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনগুলোর মধ্যে বেশ কিছুকাল থেকে, বিশেষ করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ‘কথিত নির্বাচনের’ পর ভ্রাতৃঘাতী যে লড়াই শুরু হয়েছে তাকে দেশের সাম্প্রতিক আইনশৃঙ্খলার অবনতির অংশ হিসেবে বিবেচনা করে সহজ সমীকরণে পৌঁছার কোনো অবকাশ নেই। এও বিবেচনায় নেয়া যাবে না যে, দলের তৃণমূলে আদর্শের কোনো মতপার্থক্য থেকে এই লড়াই শুরু হয়েছে। গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়া এমন সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ প্রাণহানির প্রকৃত কারণ এবং তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব কেমন হতে পারে ওয়াকিবহাল মহল ও বোদ্ধা সমাজের ভাবনার বিশ্লেষণসহ আমরা তা বোঝার চেষ্টা করব।
৭ জানুয়ারি ’২৪-এর আগে এখানে সেখানে সংঘর্ষ-সঙ্ঘাতের ছিটেফোঁটা কিছু খবর হতো। সেটি শাসকদলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে মূল সংগঠন আওয়ামী লীগের মধ্যে এমন সংঘর্ষ খুব একটা লক্ষ করা যায়নি। মূল সংগঠনের সংহতি প্রায় সবসময় অটুটই ছিল। তাদের সংহতি এতটাই দৃঢ় ছিল যে, কেবল কোনো সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর সাথেই তার তুলনা হতে পারে। নেতৃত্বের দিকনির্দেশনার প্রতি ছিল প্রশ্নহীন আনুগত্য। মানবদেহের এক অঙ্গের কোনো স্থানে ব্যত্যয় ঘটলে মুহূর্তে সেটি সর্বাঙ্গকে যেমন সজাগ সতর্ক করে ঠিক তেমনই গোটা দেশের কোথাও আওয়ামী লীগের কোনো এক সদস্যের রাজনৈতিক কোনো সমস্যা হলে তার প্রতিক্রিয়া দেশের সর্বত্র লক্ষ করা গেছে। এক দেহ এক প্রাণের মতোই সবাই জেগে উঠতো। সে জন্য আওয়ামী লীগের বৃহত্তর বলয়ের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ প্রতিবাদ করেছে। রাজপথ গলিপথ সবই তাদের প্রতিবাদ বিক্ষোভে প্রকম্পিত হয়েছে। এমনকি কেন্দ্রীয় নির্দেশের জন্যও অপেক্ষায় থাকেনি; বরং সহমর্মিতা ও সমবেদনার অপূর্ব এক বন্ধনে নেতাকর্মীরা আবদ্ধ ছিল। এখন অবশ্যই একটি বিষয়ের প্রতি সবার গভীর মনোনিবেশ করতে হবে। লীগের নেতাকর্মীদের ক্ষমতার দাপট, হুঙ্কার শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক নয়। গ্রাম-গঞ্জে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে যত কর্ম অপকর্ম তার জের সব জনপদের মানুষকে ভুক্তভোগী করছে নিয়ত। ক্ষমতার উষ্ণতা লীগ নেতাকর্মীদের আচার-আচরণ পাল্টে দিয়েছে। যার ফলে তাদের অতীতের সেই সদাচরণের লেশ মাত্র এখন বজায় নেই। সাধারণ মানুষ এখন তাদের আগের চেহারার সাথে নতুন চেহারার কোনো হিসাব আর মেলাতে পারছে না। এর কারণ আর কিছু নয়। বস্তুত সে সময় আওয়ামী লীগ শাসকদলের অবস্থানে ছিল না। অতীতের অবস্থানটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে রাখা দরকার। তখন দলের রাজনৈতিক আদর্শ-বিশ্বাসই তাদের বিবেচনায় প্রাধান্য পেত। দলীয় আদর্শের চেতনায় দলের নেতাকর্মীরা সবসময় উজ্জীবিত ছিল। ক্ষমতায় না থাকলেও ক্ষমতায় যাওয়ার লক্ষ্যে তাদের প্রত্যয়-প্রত্যাশা ছিল গভীর। তবে সেখানে হিতাহিত জ্ঞান বলে কিছুর অস্তিত্ব ছিল না।
আওয়ামী লীগ এখন শাসকদল। ক্ষমতা প্রভাব-প্রতিপত্তি সবই তাদের হাতের মুঠোয়। সেই সাথে ক্ষমতার প্রতি আসক্তি তাদের প্রবল থেকে প্রবলতর। ক্ষমতা অন্য দলের সাথে শেয়ার করার ব্যাপারেই শুধু আপত্তি নয়, এমনকি দলের সহকর্মী সুহৃদদের সাথেও ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি শেয়ার করা নিয়েও নেতাকর্মীদের ঘোরতর আপত্তি। শুধু তাই নয়, সেটা প্রতিরোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করা হয়। এককভাবে কর্তৃত্ব করা, ভোগ করার মানসিকতাই আজ শাসকদলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের প্রধান কারণ বলে বোদ্ধা সমাজের অভিমত। এখানে আদর্শের কোনো প্রশ্ন নেই। কোনো দলের তৃণমূলে কখনো আদর্শ নিয়ে সঙ্কট কখনোই ছিল না। উপরে সঙ্কট তৈরি হলে পরে তা তৃণমূলে ছড়ায়। শাসকদলের কেন্দ্রে এখনো আদর্শগত সঙ্কট নেই বলা চলে। তবে এটি নিশ্চিত যে, দলের নিচের টায়ারে প্রভাব-প্রতিপত্তি কব্জা করা নিয়ে হালে যে সমস্যা সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে তা নিয়ে কেন্দ্র একেবারেই নীরব। এর কারণ উপরে ক্ষমতা-প্রভাব-প্রতিপত্তির ভাগবাটোয়ারা সম্পন্ন হয়ে আছে। বস্তুত ক্ষমতার উষ্ণতা এখন লীগের গোটা আচার-আচরণ বোধ-বিবেচনা পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে। একচ্ছত্র ক্ষমতার সুখ-আনন্দে লীগের সবাই আচ্ছন্ন আর বিভোর। এই একচ্ছত্র ক্ষমতাকে স্থায়ী করতে আওয়ামী লীগ শুধু প্রাণপাত করতেই প্রস্তুত নয়, নিজের স্বার্থ সংরক্ষণে শুদ্ধ পথে চলার কথাও ভুলতে বসেছে দলটি, এমন ধারণা জন্ম নিয়েছে। তাদের ভাব এবং দেহভঙ্গিমায় সেটি প্রকটভাবে ছায়া ফেলছে। ক্ষমতা-প্রভাব-প্রতিপত্তি আর কারো সাথে শেয়ার করা বা ভাগজোখ করতে কেউ রাজি নয়।
এখন যে কেউ তাদের ক্ষমতার প্রতিপক্ষ হলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি দিতেও তাদের কুণ্ঠা নেই। দলের সর্বত্র ও সর্বস্তরে জিঘাংসা বিস্তার লাভ করেছে। যে কারণে বর্তমান সময়ে বৃহত্তর আওয়ামী লীগের মধ্যে পর্যন্ত ‘ভ্রাতৃঘাতী’ লড়াই চলছে। শাসকদলের তিনবারের এমপি, আনারের নাকি বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল। যদিও তার এলাকার অনেকেই জননেতা হিসেবে তাকে চিনতো না। তবে চিনতো খলনায়ক পরিচয়ে। সে যা-ই হোক, তিনি নৃশংসভাবে ভিন্ন দেশের মাটিতে খুন হলেন। তার খুন হওয়ার পেছনে দায়ীদের সম্ভাব্য যে তালিকা তৈরি হয়েছে তাতে তারই দল আওয়ামী লীগের অপর এক নেতার নাম আছে। কী অদ্ভুত এই ইকোয়েশন! সন্দেহভাজন সেই নেতার সাথে এমপি আনারের দ্বন্দ্বের কারণ এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ ক্ষমতা-প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং অর্থকড়ি। দেশের সর্বত্র এমন চিত্রই এখন দৃশ্যমান।
প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের এমন সঙ্ঘাত দলটিকে কোথায় নিয়ে যাবে বা যেতে পারে এই মুহূর্তে সেটি বলা যাবে না। লীগের ৭৫ বছরেরও বেশি দীর্ঘ যে ইতিহাস তা ভালো-মন্দের এক ককটেল বা মিশ্রণ। কিন্তু এখন যে জায়গায় আওয়ামী লীগকে নিয়ে আসা হয়েছে, যার সম্মুখে গভীর আঁধার হয়তো ঘনীভূত হচ্ছে সেখান থেকে আর ফেরার কোনো পথ হয়তো নেই। একটি কথা প্রচলিত আছে। বাঘের পিঠে ওঠা অপেক্ষাকৃত সহজ; কিন্তু সেখান থেকে নেমে আসা খুব কঠিন। কোনো বৃক্ষে মই লাগিয়ে তার মগডালে ওঠা তেমন কষ্টের নয়, তবে মইটা সরানো হলে বিপদ কিন্তু ভয়ঙ্কর। আওয়ামী লীগ মই দিয়ে বৃক্ষের সে মগডালে উঠে বসেছে বটে। কিন্তু মইটা এখন সেখানে আর নেই। উপায় তাহলে কী! ঝাঁপ দিয়ে মাটিতে পড়া। এর পরিণতি কী তাও সবার জানা। মগডাল থেকে নামার পথ ছিল ভোট ব্যবস্থা, সেটি লীগ শেষ করে দিয়েছে।
যা-ই হোক আবার পেছনে ফিরে তাকাই। সেটি হলো দলের তৃণমূলে রাজনীতিটা এখন কোন পর্যায়ে উপনীত। শুধু ক্ষমতা-প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে চলছে হিসাব-নিকাশ। যে সহিংসতা লীগে শুরু হয়েছে, বোদ্ধা সমাজ মনে করে, এর পুরো দায়দায়িত্ব নিতে হবে লীগের রাজধানীতে অবস্থিত সব কেউকেটাদের। বোদ্ধাদের এমন ধারণার পেছনে আরো অনেক কথা ও বিচার বিশ্লেষণ রয়েছে। সেটি আপাতত না করি।
দেশের কৃতী সন্তান, আন্তর্জাতিক বলয়ের এক সম্মানিত ব্যক্তিত্ব প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যের একটি বাক্য স্মরণ করে এ নিবন্ধের সমাপ্তি টানতে চাই। তার সাথে বোদ্ধাদের বোধও সংযুক্ত আছে। প্রফেসর ইউনূস বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সাথে সাক্ষাৎকারে যে বাক্যটি উচ্চারণ করেছেন সেটি হলো, দেশে এখন রাজনীতি নেই। একটি মাত্র দল আছে। তার এই মন্তব্য একটি বার্তা কেবল বহন করছে, তা কিন্তু নয়। গত ১৫ বছরে একটি দল তথা শাসকদল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক জীবনের একটি অধ্যায়ের অনেক কথাই এখানে পুঞ্জীভূত হয়ে আছে। এখানে আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক দর্শনও সুপ্ত রয়েছে। এই দলটি যে তার এই ১৫ বছরে রাজনৈতিক অধ্যায়ের মধ্যে বিরাজনীতিকীকরণের যে চোরাপথ ধরে অগ্রসর হচ্ছে তারই ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়েছে। দেশের অন্যান্য ছোট বড় দলকে ভেঙেচুরে শেষ করে দিয়েছে। এই বাক্যে তারও ইশারা বিদ্যমান। ফলে রাজনীতি এখন আর বহু দলের খেলা নয়। একদলের ক্রীড়া কৌতুকে পরিণত হয়েছে। সবাই জানেন এমন এক দলের কৌতুক নিয়ে কারো কোনো কৌতূহল থাকার কথা নয়। আজ দেশের রাজনীতি কৌতুকে পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞজনরা বলেন, এক মাথার চেয়ে একাধিক তথা বহু মাথার বোধবিবেচনা অনেক বেশি অর্থবহ এবং গুরুত্বের দাবি রাখে। এক মাথার বোধ ও সিদ্ধান্ত কী হতে পারে বাংলাদেশের হাল অবস্থার দিকে তাকালেই সেটি স্পষ্ট হবে। এখন বাংলাদেশ যেন স্রোতের শেওলায় পরিণত হয়েছে, যার নিজস্ব কোনো গন্তব্য নেই। স্রোত তাকে যে দিকে নিয়ে যাবে সেটি তার নিয়তি। আর স্রোতে ভেসে থাকা শেওলার বিপদ যেকোনো মুহূর্তেই আসতে পারে। বড় মাছ ভাসমান শেওলা পিণ্ডকে নিমিষে গিলে ফেলতে পারে। যে বড় মাছের কথা বলা হয়েছে সেই মাছ ইতোমধ্যে দেশের সর্বত্র ডিম ছেড়েছে। মা মাছের কথায় পোনারা উঠবে বসবে সাঁতার কাটবে। মাছগুলো এখন সব জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। অধ্যাপক ইউনূস একটি বাক্য ব্যয় করে প্রকারান্তরে জাতিকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। এখন জেগে ওঠার সময়। তিনি যে রাজনৈতিক শূন্যতার বিষয়টি তুলে এনেছেন সেটি ক্ষুদ্র পরিসরের কোনো ব্যাপার নয়। এখানে সামগ্রিকতার যথেষ্ট স্ফুরণ রয়েছে। সবাইকে সে আলোকেই বিচার বিবেচনায় নিতে হবে। রাজনীতি না থাকার আরো অর্থ হচ্ছে বিগত বহু বছর ধরে রাজনীতিতে জবাবদিহির যে সংস্কৃতি দেশে তৈরি হয়েছিল তার সবকিছু ধ্বংস হওয়া, যার অনিবার্য ফল হচ্ছে এক অন্ধকার যুগের সূচনা।