বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের গর্ব মাত্র তিন বছরেই খর্ব হয়েছে। বর্তমানে সেই রিজার্ভ অর্ধেকে নেমে ২৪ বিলিয়নের ঘরে নেমেছে। যা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) সরবরাহের জন্য নেট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ (এনআইআর) বা ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ হিসাবে মাত্র ১৩ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। এমন পরিস্থিতিতে আইএমএফ চলতি জুনেই রিজার্ভ সংরক্ষণের মাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে ১৪ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। আর তাই হিসেব অনুযায়ী, নির্ধারিত লক্ষ্যের চেয়ে রিজার্ভ ঘাটতি ১ দশমিক ৫২ বিলিয়ন। এই লক্ষ্য পূরণ না হলে ৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ঋণের তৃতীয় কিস্তির ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার আইএমএফ’র ২৪ জুন বোর্ডে ছাড় নাও পেতে পারে এমন অনিশ্চয়তা ঘনীভূত হয়েছে। আর অনিশ্চয়তা কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি বন্ধ করে উল্টো রিজার্ভ বাড়াতে ডলার কেনাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
অথচ ৪৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ নিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর কম ছিল না। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকার রিজার্ভকে অর্থনৈতিক আলোচনার টেবিল থেকে রাজনৈতিক আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসে। দলের নেতা-কর্মীরা রাজনৈতিক মঞ্চে বক্তৃতা করতেও ভুল করেননি। এমনকি রিজার্ভ থেকে ডলার নিয়ে প্রকল্পেও বিনিয়োগ করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। বিপিএম ৬ হিসাবে ১৯ দশমিক ৫২ বিলয়ন। সেখান থেকে চলতি দায় বাবদ ৫ দশমিক ২৪ বিলিয়ন বাদ দিলে ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। যা আইএমএফ’র বেধে দেওয়া লক্ষ্য ১৪ দশমিক ৮০ বিলিয়ন থেকে প্রায় ১ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার কম। রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় জড়িত বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আগামীকাল সোমবার ২৪ জুন আইএমএফের বোর্ডে তৃতীয় কিস্তির বিষয় উঠবে। রিজার্ভের লক্ষ্য পূরণ করতে না পারলে এবারের কিস্তি ছাড় পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। গত ৬ জুন পর্যন্ত রিজার্ভের তথ্য আইএমএফকে সরবরাহ করা হয়েছে। তাদের লক্ষ্যের তুলনায় প্রায় দুই বিলিয়ন ঘাটতি ছিল। এরমধ্যে বিদেশ থেকে ঋণ এসেছে। বিশ্বব্যাংকের ৫০০ মিলিয়নসহ আরও ৯০০ মিলিয়ন ঋণ শিগগির আসবে। তাহলে ঘাটতি কমে যাবে। আর চলতি জুনে মাত্র ৪০ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। সোয়্যাপর মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ডলার কেনায় আইএমএফ’র আপত্তি থাকায় বাজার থেকে সরাসরি ডলার কেনা চলমান রয়েছে। নতুন করে ঋণনের ৯০০ মিলিয়ন যোগ হলে রিজার্ভ ১৪ বিলিয়ন পার হতে পারে। তবুও ঘাটতি পূরণ হবে না বলে ধারণা। তবে যেকোন মূল্যে তৃতীয় কিস্তি পেতে রিজার্ভ বাড়াতে বদ্ধপরিকর কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অর্থ মন্ত্রনালয় সূত্র জানায়, আইএমএফ ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্ত হিসাবে চলতি জুনে রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা পুন:নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। যা পুরণে ঘাটতি দেড় বিলিয়নের বেশি। সবশেষে গতকাল শনিবার আইএমএফকে রিজার্ভের হালনাগাদ তথ্য পাঠাবে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর লক্ষ্য পূরণ না হলেও ঋণের তৃতীয় কিস্তি বাবাদ ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার ২৪ জুন বোর্ড অনুমোদন পাওয়া নিয়ে ঝামেলা হতে পারে।
এ বিষয় বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, রিজার্ভের নতুন লক্ষ্যমাত্রা ১৪ দশমিক ৮০ বিলিয়ন হলেও তার পূরণ করা কঠিন। কারণ, দেশের রিজার্ভে বৈদেশিক মুদ্রা যেসব উৎস থেকে আসে ও ব্যয় হয়, সেখানে ভারসাম্য নেই। ফলে রিজার্ভ ধরে রাখা যাচ্ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে ঋণের তৃতীয় কিস্তি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে আইএমএফ’র অন্যান্য শর্ত পূরণে অগ্রগতি থাকায় ঋণে ইতিবাচক মনোভাব দেখাতে পারে বোর্ড।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রিজার্ভ হচ্ছে বিপদে ব্যবহারের জন্য। কিন্তু রিজার্ভ বাড়ায় সরকার এর অপব্যবহার শুরু করে। একদিকে অপব্যবহার করে রিজার্ভ ক্ষয় করেছে, অন্যদিকে এসেছে মন্দা। এ দুইয়ে মিলে রিজার্ভ সঙ্কট প্রকট হয়েছে। রিজার্ভ ভালো থাকলে ডলারের দাম এত বাড়ত না। পণ্যের দামও এত আকাশচুম্বী হতো না। মূল্যস্ফীতিও হতো না এত ঊর্ধ্বমুখী। এখন যে অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়েছে দেশ, এর সূত্রপাত হচ্ছে সুশাসনের অভাব এবং রিজার্ভ সঙ্কট থেকে। এছাড়া বৈশ্বিক সঙ্কটের প্রভাবও রয়েছে।
অর্থমন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে রিজার্ভ লক্ষ্যমাত্রা ১৪ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার এবং ডিসেম্বর শেষে ১৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া ২০২৫ সালের মার্চ শেষে ১৬ দশিক ৬১ বিলিয়ন ডলার এবং একই বছর জুনে তা ১৯ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। অথচ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ব্যয়যোগ্য রিজার্ভের লক্ষ্য ছিল ২৬ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের আগস্ট মাসে মোট রিজার্ভের রেকর্ড ছিল ৪৮ দশমিক শূণ্য ৬ বিলয়ন ডলার। যা কমতে মাত্র ৩৪ মাসে এসে নেমেছে ২৪ বিলিয়নের ঘরে। আর ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আইএমএফ’র বাধা সত্ত্বেও রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরের ৯ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৩ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন। এবং ২০২১-২২ বছরে ছিল ৭ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। এই তিন অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৩০ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। অপরদিকে আইএমএফ’র আপত্তির মুখে চলতি অর্থবছরে সোয়াপ পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ৪ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জানা গেছে, আইএমএফের ৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭৬ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার এসেছে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। আর দ্বিতীয় কিস্তি হিসেবে প্রায় ৬৮১ মিলিয়ন ডলারের আসে গত বছরের ডিসেম্বরে। আর তৃতীয় কিস্তি ছাড়ে বোর্ডে উঠতে যাচ্ছে আগামীকাল ২৪ জুন।