করোনা মহামারিতে বিশ্বজুড়ে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমে, তার প্রভাব পড়েছিল বাংলাদেশেও। ফলে ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত টানা তিন বছর বিনিয়োগে খরা দেখা যায়। করোনা মহামারি কাটিয়ে ২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ঘটে, সেই সময়ে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়ে যায়। কিন্তু ২০২৩ সালে এসে আবারও এফডিআইয়ে পতন দেখা যায়।
২০২৩ সালে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ১৩.৬৭ শতাংশ। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা আংকটাডের ২০২৪ সালের বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত বৃহস্পতিবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে আংকটাড।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালে অনেক দেশের অর্থনৈতিক গতি হ্রাস পাওয়া এবং ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে বিশ্বজুড়ে এফডিআই কমেছে প্রায় ২ শতাংশ।
এফডিআই কমে হয়েছে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার। এ সময়ে বাংলাদেশে কমেছে ১৩.৬৭ শতাংশ। ফলে টানা তিন বছর বৃদ্ধির পর দেশে এফডিআই আসা কমল। গত বছর বাংলাদেশে ৩০০ কোটি ৪০ লাখ ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, যা দেশি মুদ্রায় হয় ৩৫ হাজার ৪৪৭ কোটি ২০ লাখ টাকা (প্রতি ডলার ১১৮ টাকা ধরে)।
২০২২ সালে এফডিআই এসেছিল ৩৪৮ কোটি ডলারের, ২০২১ সালে আসে ২৮৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার, ২০২০ সালে আসে ২৫৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার, ২০১৯ সালে আসে ২৮৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার এবং ২০১৮ সালে আসে ৩৬১ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
নতুন বিনিয়োগের পাশাপাশি এফডিআই স্টক বা মোট বিনিয়োগের স্থিতিও কমে গেছে। গত বছর বিনিয়োগের স্থিতি কমে দুই হাজার ৫৪ কোটি ডলারে নেমেছে, যা ২০২২ সালে ছিল দুই হাজার ৭৫ কোটি ডলারে।
স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে এফডিআই প্রাপ্তিতে শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। যদিও সামগ্রিকভাবে গত বছর এলডিসিভুক্ত দেশগুলোয় এফডিআই প্রবাহ ১৭ শতাংশ বেড়েছে, সেখানে বাংলাদেশের উল্টো কমেছে।
৪৫টি এলডিসির পাওয়া মোট এফডিআইয়ের ৫০ শতাংশই পেয়েছে পাঁচটি দেশ। এর মধ্যে তৃতীয় স্থানে আছে বাংলাদেশ, গত বছরও তা-ই ছিল। শীর্ষ দুই দেশ হচ্ছে ইথিওপিয়া ও কম্বোডিয়া। আর চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে আছে সেনেগাল ও মোজাম্বিক।
বাংলাদেশে বিদেশিদের বিনিয়োগ যেমন কমেছে, তেমনি বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের দেশের বাইরে বিনিয়োগও গত বছর কমেছে। গত বছর বৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে তিন কোটি ডলারের বিনিয়োগ বিদেশে গেছে। তার আগের বছর বিদেশে বিনিয়োগ হয়েছিল পাঁচ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
অবশ্য গত বছর বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নতুন প্রকল্পে বা গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগের জন্য ঘোষিত অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। এতে ভবিষ্যতে প্রকৃত বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। গত বছর বাংলাদেশে ৩৪টি প্রকল্পের জন্য ২৮৯ কোটি ডলারের নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের ঘোষণা হয়েছে, যা ২০২২ সালে ছিল ২২ প্রকল্পের জন্য ৬৫ কোটি ডলার।
আংকটাডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নত দেশগুলোতে গত বছর এফডিআই প্রবাহ ৯ শতাংশ বেড়েছে। ৪৬ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে উন্নত দেশগুলো। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় এফডিআই কমেছে ৭ শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশগুলো সম্মিলিতভাবে গত বছর ৮৬ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে।
আংকটাড বলছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গত বছরের তুলনায় গ্রিনফিল্ড বা নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের ঘোষণা ১৫ শতাংশ বেড়েছে। এসব দেশে আট হাজার প্রকল্পে ৭৪ হাজার ৯০০ কোটি ডলার গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগের ঘোষণা রয়েছে। যদিও উন্নত দেশে নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের ঘোষণা কিছুটা কমেছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় গত বছর সার্বিকভাবে এফডিআই কমেছে ৩৭ শতাংশ। সব মিলিয়ে বিনিয়োগ এসেছে তিন হাজার ৬০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ভারত দুই হাজার ৮১৬ কোটি ডলারের বিনিয়োগ পেয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ৪৩ শতাংশ কম। পাকিস্তানে এফডিআই গেছে ১৮২ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ২৪.৬৫ শতাংশ কম। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কায়ও এফডিআই কমেছে। তবে নেপাল ও মালদ্বীপে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে ৮ শতাংশ। কৃষি খাদ্য ব্যবস্থায় বেড়েছে ১৩ শতাংশ এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বেড়েছে ৬ শতাংশ। এর বিপরীতে ২০২২ সালের তুলনায় বিনিয়োগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে কমেছে ৫ শতাংশ এবং পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিনে কমেছে ১৭ শতাংশ।
https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2024/06/23/1399595