ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যের পানির বেসিন হচ্ছে সিলেট। ওই দু’রাজ্যে টানা বৃষ্টিপাত হলেই ডুবে যায় সিলেট। এই অবস্থা যুগ যুগ ধরে বিদ্যমান। এ দু’রাজ্যের পানি অপসারণের বিকল্প কোনো পথ নেই। ফলে বছর বছর বৃষ্টির মৌসুমে ডুবছেই সিলেট। এবার সিলেট অঞ্চলে প্রথম দফা উজানের ঢল আঘাত হেনেছিল ২৭শে মে। এই ঢলে তলিয়ে গিয়েছিল সিলেট। নতুন করে ১৭ই জুন থেকে ঢল এসেছে। এই ঢলে দ্বিতীয় দফা বিপর্যয় ঘটেছে। এখন সিলেট জেলার অর্ধেক পানির নিচে।
প্রায় ১২ লাখ লোক পানিবন্দি। এবারের বিপর্যয় সহসাই কাটার সম্ভাবনা নেই। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে; সিলেট ও মেঘালয়ের উপরে মেঘমালা রয়েছে। আরও কয়েকদিন বৃষ্টি ঝরবে এ অঞ্চলে। আর বৃষ্টি ঝরলেই পানি বাড়বে। আবহাওয়াবিদদের মতে; স্থানীয় বৃষ্টিপাতে সিলেটের তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয় না। উজানের ঢলই মূলত বিপর্যয়ের কারণ। পরিবেশবাদীরা জানিয়েছেন- সিলেট অঞ্চল দিয়ে যেসব নদী প্রবাহিত হয়েছে তার উৎপত্তি পাহাড়ি অঞ্চল থেকে। ফলে এসব নদ-নদীর মুখে বাঁধ বা ড্যাম আছে। বৃষ্টির মৌসুমে এসব বাঁধ বা ড্যাম খুলে দেয়া হলে প্রবল বেগে সিলেটে পানি ঢুকে। এটি এবারো ঘটেছে। জৈন্তাপুরের সারি নদীর উজানে রয়েছে লেসকা মাইন্ডু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। আর কোম্পানীগঞ্জের ধলাইয়ের উপর রয়েছে উমিও হাইড্রো ইলেক্ট্রিক প্রজেক্ট। জাফলংয়ের উজানে উমঘট নদীতে এখনো কোনো প্রকল্প হয়নি। বাস্তবতা হচ্ছে; গোটা মেঘালয় রাজ্যই হচ্ছে পাহাড়বেষ্টিত। শত শত মাইলের পাহাড় আর পাহাড়। বিশে^র সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি। সুতরাং বৃষ্টি হচ্ছে। আর এই বৃষ্টির পানি খুব দ্রুতই বাংলাদেশের সিলেটে নেমে আসে। কিছু অংশ নামে আসামের গৌহাটি ও করিমগঞ্জ এলাকা দিয়ে। যেদিকে পানিই নামুক সেটি অপসারণের একমাত্র স্থানই হচ্ছে সিলেট। সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় এই বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। সিলেটকে এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে সরকারের পলিসি লেভেলে নানা চিন্তাভাবনা চলছে। সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী প্রথমে সিলেট নগরকে রক্ষায় ২০ কিলোমিটার সুরমা নদী খননের জন্য একটি প্রকল্প পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু গতকাল মেয়র জানিয়েছেন; এই প্রকল্প দিয়েও তেমন লাভ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাতের ফলে কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাটের পানি এসে সিলেট নগরে প্রবেশ করে। এখন এই দুই এলাকা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। এ ছাড়া; সারি ও সুরমার পানি তো আছেই। এসব বিষয় নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। ২০২২ সালে সিলেটে প্রলয়ঙ্করী বন্যা হয়েছিল। এর আগে ২০০৪ সালে এর চেয়ে বেশি বন্যা হয়। এসব বন্যা নিয়ে চিন্তিত সিলেটের মানুষ। ‘সেইভ দ্যা হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’র সিলেটের সভাপতি আব্দুল হাই আল হাদী মনে করেন- সিলেট অঞ্চলে বন্যা দূর করতে হলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক রাখতে হবে। যেমনি ভাবে পরিবেশ ঠিক রাখতে হবে তেমনি করে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। নদী যদি পানি ধারণ না করতে পারে তাহলে বন্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়। পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি বলেন- ভারতের মেঘালয়ের একমাত্র বেসিন হচ্ছে সিলেট। সুতরাং যখন পানি আসে তখন তীব্র বেগেই আসে। এবার মেঘালয়ে ১৫১ ভাগ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে জানান তিনি। বন্যাকবলিত সিলেট গতকাল পরিদর্শন করেছেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শনের পর তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
এ সময় প্রতিমন্ত্রী বলেছেন- উজান থেকে পানির সঙ্গে প্রতি বছর দেড় বিলিয়ন পলিমাটি আসে। এসব পলিমাটি সিলেট অঞ্চলের নদ-নদীর তলদেশকে ভরিয়ে দিচ্ছে। সুতরাং একবার সুরমা কিংবা অন্যান্য নদী খনন করলে হবে না। এর জন্য প্রতি বছরই নদী খনন করতে হবে। তিনি জানান- সিলেটের নদী খননের প্রকল্প নিয়ে ব্যাপক আকারে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। সিলেটের মেয়র মাসখানেক আগে যে প্রকল্প জমা দিয়েছিলেন সেটি এখন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আছে। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর মতে; পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে না পারলে সহসাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। এর জন্য বছর বছর ড্রেজিং করে নদীর নাব্যতা স্বাভাবিক রাখতে হবে। সিলেট নগরকে বন্যার কবল থেকে রক্ষা করতে বেড়িবাঁধ নির্মাণ সহ নানা প্রকল্পের চিন্তা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নুর আজিজুর রহমান জানিয়েছেন- শুধু সুরমা নদী খনন করলেই হবে না; ছড়া বা খালের উপর স্লুইচ গেইট নির্মাণ করতে হবে। একই সঙ্গে নগর জুড়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে। এই বেড়িবাঁধই হবে বন্যার প্রটেকশন।
তিনি জানান- এবার নতুন করে দেখা গেছে; বিমানবন্দর সড়ক দিয়ে নগরের উঁচু অংশ ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডে পানি ঢুকে। সিলেট-এয়ারপোর্ট সড়কের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। কারণ; মেঘালয় ও আসামের পানি দু’দিক থেকে সিলেট জেলা ও নগরকে ডুবিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। এসব নিয়ে সরকারের পলিসি পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। এদিকে; ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি কিছুটা কমলেও এখনো দু’টি নদীর ছয়টি পয়েন্টের পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। বাড়িঘরে টিকতে না পেরে আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে মানুষ। জেলা প্রশাসনের হিসাবে সিলেট জেলায় প্রায় নয় লাখ ৫৮ হাজার মানুষ পানিবন্দি। বাড়িঘরে পানি উঠে পড়ায় আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছেন প্রায় ২২ হাজার মানুষ। বৃহস্পতিবার বিকালে ১৩ উপজেলা ও সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ অবস্থা জানিয়েছে সিলেট জেলা প্রশাসন। জেলার ৬৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে এখন পর্যন্ত ২১ হাজার ৭৮৬ জন আশ্রয় নিয়েছেন।
জেলায় বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন ৯ লাখ ৫৭ হাজার ৪৪৮ জন। এর মধ্যে ওসমানীনগরে ১ লাখ ৮৫ হাজার ও গোয়াইনঘাটে ১ লাখ ৪৫ হাজার ২০০ মানুষের অবস্থা বেশি খারাপ। জেলার ১৫৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৩০টি ইউনিয়নের ১ হাজার ৬০২টি গ্রাম বন্যায় প্লাবিত। আর সিটি করপোরেশনের ২৩টি ওয়ার্ডে বন্যাকবলিত মানুষের সংখ্যা ৫৫ হাজার। বন্যাকবলিত অনেক এলাকায় উদ্ধার বা ত্রাণ সহায়তা যাচ্ছে না এমন অভিযোগ রয়েছে অনেকের। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের জন্য ২৮ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে এবং ৬০০ টন চাল দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে উদ্ধার তৎপরতা চালানো হচ্ছে। সিলেট আবহাওয়া অফিস বলছে, সিলেটে গত ২৪ ঘণ্টায় ১১০ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে আর সকাল ৬টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ২০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। তবে আগামী ৭২ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।