বাজার থেকে ব্যাগ ভরে টাটকা শাক-সবজি বাসায় নিয়ে যাচ্ছি। পরিবারের জন্য কিনছি ফলমূল। রান্না করার জন্য বাহারি মাছের শুঁটকি। কিন্তু একবারও কি ভেবেছি, এসবের মধ্যেও বিষ থাকতে পারে? যাতে রয়েছে ক্যান্সার, আলসারের মতো জটিল রোগের উপাদান? হ্যাঁ-বাংলাদেশে উৎপন্ন শাক-সবজি-সালাদ ও শুঁটকিতে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক বালাইনাশকের (কীটনাশক) উপস্থিতি পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি)-এর পেস্টিসাইড অ্যানালাইটিক্যাল ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষায় এমন ক্ষতিকর বালাইনাশকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ফলমূল, শাকসবজি, সালাদ ও শুঁটকিতে ব্যবহৃত বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ মানবদেহের জন্য মাত্রার ওপরে থাকে। এ কারণে মানুষের আলসার, ক্যান্সার, গ্যাস্ট্রিক, দৃষ্টিশক্তি লোপ, ¯œায়বিক শক্তির অপচয় এবং বন্ধ্যত্বের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বারির বিজ্ঞানীরা বলছেন, বালাইনাশক ভেদে প্রয়োগের ৪ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত থাকে এর কার্যকারিতা। নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার আগেই এই ফসল বা ফসলের অংশবিশেষ খাওয়ার ফলে মানবদেহে এমনকি পশুর দেহেও বিষাক্ততা প্রবেশ করে এবং অনেক দিন পর্যন্ত তা শরীরে থাকে। নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত না হওয়ার আগে বেগুন, শিম, বরবটি, লালশাক, ডাঁটা, কাঁচামরিচ, টমেটো, ধনেপাতা, বাঁধাকপিসহ অধিকাংশ শাক-সবজি না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্টদের জনসচেতনা তৈরির তাগিদ দেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বারির ল্যাবরেটরিটি আন্তর্জাতিক মানের। এখান থেকে বিভিন্ন ফল-সবজি, মাছসহ বিভিন্ন পণ্য পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়ে আসছে। শুরু থেকেই এই ল্যাবরেটরির সাথে আছেন বারির কীটতত্ত্ব বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো: সুলতান আহমেদ। তার নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী দেশের বিভিন্ন বাণিজ্যিক এলাকা যেমন- বগুড়া, ঈশ্বরদী, কুমিল্লা, জামালপুর, শেরপুর, চট্টগ্রাম, নরসিংদী, রাজশাহী অঞ্চল থেকে ফলমূল, শাকসবজি ও শুঁটকি সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। পরীক্ষায় বেগুন, শিম, বরবটি, ফুলকপি ও লালশাকে শতকরা ১২.২৫ শতাংশ হারে মানদেহের জন্য ক্ষতিকর বালাইনাশক (ক্লোরপাইরিফস, কুইনালফস, এসিফেট, ডায়াজিনন, ফেনিট্রোথিয়ন ও ডাইমেথোয়েট গ্রুপ)-এর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। সালাদ জাতীয় ফসল যেমন- লেটুস, ধনেপাতা, কাঁচামরিচ, গাজর ও ক্যাপসিকামে ক্ষতিকর বালাইনাশকের (কুইনালফস, ডাইমেথোয়েট, ক্লোরপাইরিফস, এসিফেট ও এসিটাইমপ্রিড গ্রুপ) উপস্থিতির হার পাওয়া গেছে ১০.২৪ শতাংশ। আর শুঁটকি মাছে (লইট্টা, চেপা, কাঁচকি, মলা, চান্দা, ছুরি, সিদোল ও পাইশা) মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর বালাইনাশকের (ডাইমেথোয়েট, এসিফেট, ফেরিট্রোথিয়ন, ডায়াজিনন ও ক্লোরপাইরিফস গ্রুপ) উপস্থিতি পাওয়া গেছে প্রায় ১১ শতাংশ। এসব ক্ষতিকর বালাইনাশক মানবস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। আলসার, ক্যান্সার, গ্যাস্ট্রিক, দৃষ্টিশক্তি লোপ, স্নায়বিক শক্তির অপচয় এবং বন্ধ্যত্বের মতো জটিল রোগের কারণ হতে পারে বলে মনে করেন বারির কীটতত্ত্ব বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো: সুলতান আহমেদ। তিনি বলেন, আমরা বিগত ৫-৭ বছরে বাজারের যেসব এলাকায় ফল শাকসবজি উৎপাদন হয় সেখান থেকে নিয়ে এসে অ্যানালাইসিস করে এমন ফলাফল পেয়েছি। তবে, আশার কথা হলো আমের মধ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপস্থিতি খুবই কম (২ শতাংশ) পাওয়া গেছে। কারণ, আম বালাইনশাক প্রয়োগের নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার পর হারভেস্ট করা হয়ে থাকে। এর বাইরে পান পাতায় ৯.৬১ শতাংশ, কুল বা বরই-এ ৪.২৩ শতাংশ, লিচুতে ৪.৯৬ শতাংশ, পেয়ারায় ৪.৯৪ শতাংশ ক্ষতিকর বালাইনাশকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
কৃষককে সচেতনতা বা প্রশিক্ষণের দায়িত্ব কৃষি সম্প্রসারণ
অধিদফতরের (ডিএই)। কৃষি মন্ত্রণালয়ের এ সংস্থাটির পরিচালক (সরেজমিন উইং) মোঃ তাজুল ইসলাম পাটোয়ারী বলেন, আমরা কৃষককে কীটনাশক প্রয়োগে চারটি রাইটের কথা বলে আসছি। সঠিক নিয়মে, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় সঠিকভাবে ডোজ প্রয়োগ করতে হবে। আমাদের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা মাঠে কাজ করছেন। আইপিএমসহ বিভিন্ন প্রকল্প নিরাপদ ফসল উৎপাদনে কাজ করছে। যাতে কৃষক অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার না করেন। আমাদের কর্মকর্তারা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু, কৃষক বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায় সরাসরি কীটনাশক ডিলারের কাছে চলে যায়। আর ডিলাররা বিভিন্ন কোম্পানির কীটনাশক ধরিয়ে দেয়। তিনি বলেন, একটি ফসলে কীটনাশক প্রয়োগের তিন দিন বা পাঁচ দিন পর হারভেস্ট করার কথা বা আরো সময় পর হারভেস্ট করার কথা। কিন্তু আমাদের কৃষকরা তো শোনে না। তারা দেখে যে, বেগুন বা ঢেঁড়স ৩-৪ দিন পরে তুললে নষ্ট হয়ে যাবে বা দাম পাবে না। দেখা যায়, বিকেলে ক্ষেতে কীটনাশকদিয়ে পরদিন সকাল বেলাতেই ফসল তুলে বাজারে নিয়ে যাচ্ছে। অপেক্ষমাণ সময় তারা মানতে চায় না।
মানতে হবে অপেক্ষমাণ সময় ফল, শাক-সবজি বা ফসলে ক্ষতিকর পোকামাকড় বা রোগ দমনে বিভিন্ন রকম বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়। নির্দিষ্ট বা অপেক্ষমাণ সময় পার হওয়ার পর তা খাওয়ার উপযোগী বা নিরাপদ হয়।
কাজেই রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহৃত ফল, শাক-সবজি, সালাদ জাতীয় ফসলে এর অবশিষ্টাংশ থেকে যায়। যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার করলে অবশ্যই অপেক্ষমাণ সময় মানা উচিত। ফসলে বালাইনাশক প্রয়োগের পর বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ মুক্ত নিরাপদ ফসল তোলার পূর্ব পর্যন্ত যে সময় বিরতি দিতে হয় তাকেই অপেক্ষমাণ সময় বলে।
বারির কীটতত্ত্ব বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো: সুলতান আহমেদ বলেন, কৃষকরা রাসায়নিক বালাইনাশকের এই অপেক্ষমাণ সময় পার হওয়ার আগেই ফসল সংগ্রহ করে ভোক্তাদের জন্য বাজারে নিয়ে আসেন। ফলে কীটনাশক বা বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ থেকেই যাচ্ছে। কৃষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং মাঠপর্যায়ে উপযোগিতা পরীক্ষায় স্থাপনের মাধ্যমে তাদেরকে প্রশিক্ষিত করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ফসলে বালাইনাশক ব্যবহার করলে অপেক্ষমাণ সময় মেনেই হারভেস্ট করা উচিত।
কত সময় পর হারভেস্ট উপযোগী ফসল?
শাকসবজিতে সাধারণত কুইনালফস গ্রুপের কীটনাশকের ব্যবহার হয়ে থাকে। এই কীটনাশক ফুলকপি ও কাঁচামরিচে ব্যবহার করলে ৮ দিন অপেক্ষমাণ সময় মানতে হবে। অর্থাৎ কীটনাশক প্রয়োগের ৮ দিন পরই ফুলকপি ও কাঁচামরিচ খাওয়ার উপযোগী হবে। একই কীটনাশক শিম, বরবটি, বেগুন, বাঁধাকপি, ডাঁটা ও লালশাকে ব্যবহার করার ৭ দিন পর খাওয়ার উপযুক্ত হয়। আর টমেটো খাওয়ার উপযোগী হয় ৪ দিন পরে।
একইভাবে যদি টমেটোতে ডায়মেথোয়েট গ্রুপের কীটনাশক ব্যবহারের ১০ দিন পর খাওয়ার উপযোগী হয়। ধনেপাতা খাওয়ার উপযোগী হয় ৯ দিন পরে। এছাড়াও এই কীটনাশক বরবটি, কাঁচামরিচ, লালশাক, ফুলকপি, বেগুন, শিম ও বাঁধাকপিতে ব্যবহারের ৭-৯ দিন পর খাওয়ার উপযোগী হয়। সাইপরমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক এসব সবজিতে ব্যবহার
করলে ৩-৫ দিন পর খাওয়ার উপযোগী হয়।
ভোক্তার সাবধনতা : অধিক উৎপাদনশীলতা বা পোকামাকড় দমনের জন্য কৃষক বিভিন্ন বালাইনাশক প্রয়োগ করে থাকেন। বেশি দাম পাওয়ার আশায় অনেকে তা অপেক্ষমাণ সময় না মেনেই বাজারজাত করছেন। ফল বা সবজিতে ক্ষতিকর পেস্টিসাইড দূর করার প্রসঙ্গে বারির কীটতত্ত্ব বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো: সুলতান আহমেদ বলেন, ধরেন-বাজার থেকে পেয়ারা বা আপেল কিনে নিয়ে এসেছেন, প্রথমে পরিষ্কার পানিতে ধুতে হবে। এরপর এক লিটার পানিতে ২০ গ্রাম খাবার লবণ দ্রবণ তৈরি করে ১৫ মিনিট ভিজিয়ে রাখতে হবে। পরবর্তীতে আবার পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে যদি খাই তাহলে ৬০-৮০ শতাংশ পেস্টিসাইড রেসিডিউ দূরীভূত হওয়া সম্ভব। এভাবে অন্যান্য ফলমূল, শাকসবজি পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নেয়ার মাধ্যমে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করা যায়। আর যেসব ফসলের খোসা ছাড়িয়ে খাওয়া সম্ভব সেগুলো খোসা ফেলে সেই অংশ খেলে সমস্যা নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত রান্না করার মাধ্যমে শাক- সবজি থেকে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করা যায়। এই পদ্ধতির কার্যকারিতা নির্ভর করে রান্নার সময়কাল, তাপমাত্রার পরিমাণ, খাদ্যদ্রব্যে পানি সংযোজনের পরিমাণ এবং রান্নার ধরনের (খোলা বা বন্ধ) ওপর। সাধারণত খোলা পদ্ধতিতে ভোলাটিলাইজেশন এবং বন্ধ পদ্ধতিতে হাইড্রোলিসিসের মাধ্যমে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ হ্রাস পায়। এ পদ্ধতি অবলম্বন করে ফলমূল ও শাক-সবজি থেকে বালাইনাশকের প্রকারভেদে শতকরা ৩০ থেকে ৮০ ভাগ
পর্যন্ত বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করা যায়।