সরকারের বেঁধে দেয়া দরে এবারো কাঁচা চামড়া বিক্রি হয়নি। শুধু তাই নয়, আড়তদার সিন্ডিকেটের কারণে কোরবানিদাতারা সরকারের বেঁধে দেয়া দামের অর্ধেকও পাননি। বাধ্য হয়ে অনেকে স্থানীয় মাদ্রাসা ও এতিমখানায় চামড়া দিয়ে দিয়েছেন। চামড়ার আড়তদার ও ট্যানারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদুল আজহায় এক কোটির বেশি পশু কোরবানি হয়েছে। ঈদের দিন কাঁচা চামড়া আসার হারও সন্তোষজনক। এবার লবণের দাম কিছুটা কমলেও শ্রমিকের মজুরি ও গাড়িভাড়া বেড়েছে। সব মিলিয়ে নির্ধারিত দরের চেয়ে কিছুটা কমে কাঁচা চামড়া কিনতে হয়।
এর আগে গত ৩রা জুন চামড়া খাতের একাধিক বাণিজ্য সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে কোরবানি পশুর চামড়ার দর নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫৫-৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০-৫৫ টাকা। ঢাকার বাইরে গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫০-৫৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৪৫-৪৮ টাকা।
সাধারণত বড় আকারের গরুর চামড়া ৩১-৪০ বর্গফুট, মাঝারি আকারের গরুর চামড়া ২১-৩০ এবং ছোট আকারের গরুর চামড়া ১৬-২০ বর্গফুটের হয়। নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, ঢাকায় মাঝারি আকারের গরুর ২৫ বর্গফুটের একটি লবণযুক্ত চামড়ার দাম হওয়ার কথা ১ হাজার ৩৭৫ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা।
এই হিসাব থেকে লবণ, মজুরি ও অন্যান্য খরচ বাবদ গড়ে ৩০০ টাকা বাদ দিলে ওই চামড়ার আনুমানিক মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৫ টাকা থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা।
পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তার আড়তগুলো কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের অন্যতম বড় জায়গা। সেখানে সোমবার বড় ও মাঝারি আকারের গরুর কাঁচা চামড়া সর্বোচ্চ ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে বড় ও মাঝারি আকারের চামড়া ৭০০ থেকে ৮৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। হাজারীবাগ এলাকায়ও একই দরে চামড়া বিক্রি হতে দেখা যায়।
কাঁচা চামড়ার আড়তদারদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সভাপতি আফতাব খান বলেছেন, চলতি বছর চামড়ার সরবরাহ ভালো। আমরা পোস্তার ব্যবসায়ীরা ১ লাখ ৬০ হাজার কাঁচা চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়েছে। তিনি বলেন, নির্ধারিত দরের চয়ে কম দামে চামড়া কেনার সুযোগ নেই। কারণ, বাজারে আড়তদার, ব্যাপারী, ট্যানারি মালিক ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনছেন। অর্থাৎ প্রতিযোগিতা বেশি। ফলে একজন কম দাম বললে আরেকজনের কাছে যাওয়ার সুযোগ আছে। আর কাঁচা চামড়ার অন্তত ১০ শতাংশ নষ্ট হয়। কেনার সময় এটি সমন্বয় করা হয়।
ছাগলের চামড়ায় অনীহা: গত কয়েক বছরের কোরবানির ঈদের মতো এবারও ছাগলের চামড়ার বিক্রি করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে। ঢাকায় চামড়ার পাইকারি আড়ত পোস্তায় গিয়ে দেখা গেছে, যারা খাসির চামড়া নিয়ে গেছেন, তাদের হতাশ হতে হয়েছে। ছাগলের চামড়া কিনছে, এমন আড়তের খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কয়েকজনকে ১০ টাকা দরে চামড়া সংগ্রহ করতে দেখা গেছে। চামড়ার এই দর সরকারের ঘোষণা করা দরের তুলনায় অনেক কম। এবার ট্যানারিতে প্রতি বর্গফুট ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা দরে খাসির চামড়া বিক্রির ঘোষণা এসেছে, গত বছর যা ছিল ছিল ১৮ টাকা থেকে ২০ টাকা। একটি খাসিতে যদি ৫ থেকে ৬ বর্গফুট চামড়া হয়, তাহলে লবণ দেয়ার পর দাম পাওয়া যাবে ১০০ থেকে দেড়শ’ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পোষায় না বলে এই চামড়া কেনেন না তারা। তারা জানান, ছাগলের চামড়ার কোনো আড়ত পোস্তায় নাই। আগে ট্যানারি ছিল হাজারীবাগ, তা এখন সাভারে চলে গেছে। ব্যবসাটা আসলে তারাই করছে।
দুইদিনে প্রায় পাঁচ লাখ কাঁচা চামড়া সংগ্রহ: ঈদুল আজহার প্রথম দুইদিনে প্রায় পাঁচ লাখ পিস কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেছেন ট্যানারি মালিকরা। গতকাল বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ ধানমণ্ডি কনভেনশন হলে এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান। তিনি বলেন, এবার সারা দেশে ৮০ লাখ পিস চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে ৪ লাখ ৭৫ হাজার পিস চামড়া সংগ্রহ হয়েছে। তবে অদক্ষ শ্রমিক দিয়ে চামড়া প্রক্রিয়া করায় তিনদিনে কয়েক লাখ পিস চামড়া নষ্ট হয়েছে। ছাগল ও খাসির চামড়া অনেক বেশি নষ্ট হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ছাগলের চামড়া সংরক্ষণ করতে হাজার টাকা খরচ হয়। সেজন্য ঝুঁকি নিতে চায় না ব্যবসায়ীরা। অসাবধানতাবশত চামড়া ছাড়াতে গিয়ে অন্তত ২০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তর ও করোনা মহামারিসহ বৈশ্বিক নানা সংকটে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের চামড়া খাতে। মূলত আন্তর্জাতিক লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ না থাকায় দেশের চামড়া শিল্পের অগ্রগতি হচ্ছে না। আর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় আন্তর্জাতিক সনদ অর্জনও সম্ভব হচ্ছে না।