জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে বাজেট আসে; আবার যায়ও। কিন্তু আমজনতার ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। ভাগ্য পরিবর্তন হয় শ্রেণিবিশেষের। তাইতো পরিহাস করে কেউ কেউ বলে থাকেন ‘খায়-দায় জব্বর, আর মোটা হয় মাতবর’। আর এই যখন অবস্থা তখন বাজেট নিয়ে সাধারণ মানুষের বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির কোন প্রতিক্রিয়া না থাকাই স্বাভাবিক।
বস্তুত বাজেট হল একটি শৃঙ্খলা, হিসাব-নিকাশ ও গণনার পরিকল্পনা মাত্র। একটি বাজেটে প্রত্যাশিত বিক্রয়ের পরিমাণ এবং রাজস্ব, সময়, খরচ এবং ব্যয়সহ সম্পদের পরিমাণ, পরিবেশগত প্রভাব; যেমন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন, অন্যান্য প্রভাব, সম্পদ, দায় এবং নগদ প্রবাহ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। সরকার, কোম্পানী, পরিবার এবং অন্যান্য সংস্থাগুলো পরিমাপযোগ্য শর্তে কার্যকলাপের কৌশলগত পরিকল্পনা প্রকাশ করতে বাজেট প্রণয়ন ও ব্যবহার করে থাকে। যা একটি অত্যাবশ্যকীয় ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
সার্বিকভাবে বাজেট হচ্ছে একটি দেশের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাব। সরকারকে দেশ পরিচালনা করতে হয়, সরকারের হয়ে যারা কাজ করেন বা যারা রাষ্ট্রীয় কাজে নিয়োজিত থাকেন, তাদের বেতন দিতে হয়, আবার নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য রাস্তাঘাটসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়। নাগরিকদের জীবনযাত্রা যাতে সহজ, সাবলীল ও স্বাচ্ছন্দপূর্ণ হয় সেদিকেও বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হয় বাজেট প্রণেতাদের। বস্তুত একটি নির্দিষ্ট অর্থবছরে কোথায় কত ব্যয় হবে, সেই পরিকল্পনার নামই বাজেট। তাই এটি সর্বজনীন হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। সাধারণত একজন মানুষকে আয় ও ব্যয়ের হিসাব করে জীবন-জীবিকা চালাতে হয়। তবে ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের বাজেটের একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সাধারণত ব্যক্তি আগে আয় কত হবে, সেটি ঠিক করেন, তারপর ব্যয়ের খাতগুলো নির্ধারণ করেন। অন্যদিকে, রাষ্ট্রের নীতি উল্টো। রাষ্ট্র আগে ব্যয়ের খাতগুলো নির্ধারণ করে তার কোন কোন খাত থেকে আয় করা যায় সেটি ঠিক করে থাকে।
সম্প্রতি নতুন অর্থবছরের বাজেট জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়েছে। এই বাজেট নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে পরস্পর বিরোধী প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অবশ্য এটি আমাদের দেশের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। উল্লেখ্য, ঘোষিত বাজেট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি জরিপ চালিয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডি। ওই জরিপে অংশ নেয়াদের মধ্যে ৬৪ শতাংশই বলেছেন এবারের বাজেট নিয়ে তারা নতুন কিছু প্রত্যাশা করছেন না। কারণ, প্রস্তাবিত বাজেট পুরোনো বৃত্তেই রয়ে গেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ শুধু সীমিতই নয় বরং একেবারে নেই বললেই চলে। যে কারণে তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতিফলন বাজেটে দেখা যায় না। আর আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সে সুযোগও নেই। এবারের বাজেটেও সে বৃত্ত ভাঙা সম্ভব হয়নি। এত ঘটা করে বাজেট ঘোষণা করা হলো, তারপরও কেন সাধারণ মানুষ এ বিষয়ে রীতিমত ভাবলেশহীন এ প্রশ্ন ছিল অর্থনীতিবিদদের কাছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রতিবছর মানুষ কর দিচ্ছে। করের টাকায় সরকারের ব্যয় নির্বাহ হচ্ছে। কিন্তু এর বিনিময়ে তারা যখন কাক্সিক্ষত সুফল পাচ্ছে না, তখন বাজেট আসলেও তারা খুব একটা আগ্রহ দেখান না। আর দেখিয়েই বা লাভ কী? কারণ, সকল বাজেটে জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য না দেয়ার অভিযোগটা বেশ জোরালো। তবে এবারের জরিপে মতামত দানকারীরা কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষার মতো বিষয়গুলোর ওপর জোর দিয়েছিলেন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজেটে সরকারের মূল লক্ষ্য থাকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে। কীভাবে সহনীয় পর্যায়ে রাখা যাবে, বাজেট ঘাটতি কীভাবে কমিয়ে আনা যাবে এবং দারিদ্র্য বিমোচন কীভাবে সম্ভব হবে? কিন্তু এবারের প্রস্তাবিত বাজেট প্রায় সকল মহলকেই আশাহত করেছে। একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, এবারের বাজেট মোটেই গণমুখী হয়নি বরং তা একেবারে গতানুগতিকই হয়েছে। এখানে সাধারণ মানুষের স্বার্থের কথা মোটেই বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবারের বাজেটে বেশ হতাশই হয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে লাগামহীন মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বড় সমস্যা। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লেও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বাজারের ওপর সরকার বা সরকারি কোন সংস্থার নিয়ন্ত্রণ নেই। বস্তুত বাজার চলেছে বাজারের গতিতে। বলা চলে স্বশাসনে। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ও বাজার সিন্ডিকেটই দেশের বাজার ব্যবস্থার দ-মু-ের কর্তা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয় এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে এতদবিষয়ক কোন দিকনির্দেশনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের বিষয় এবারের বাজেটে প্রায় ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত হয়েছে। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে এমন কিছু করা হয়েছে যা মূল্যস্ফীতিতেই সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। ফলে দেশে জনদুর্ভোগ থেকে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা একেবারে ভাবলেশহীন।
ঘোষিত বাজেটে সবচেয়ে বেশি আশাহত হয়েছেন দেশের মধ্যবৃত্ত শ্রেণি। কারণ, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখীতে সংসার খরচ প্রতিনিয়তই বাড়ছে। মূল্যস্ফীতির এই পাগলা ঘোড়া কোথায় গিয়ে থামবে, কে থামাবে, তা জানতে বাজেটের দিকে চোখ ছিল অনেক মধ্যবিত্তের। চেয়েছিলেন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে। ভেবেছিলেন, নির্বাচন-পরবর্তী প্রথম বাজেটে জনতুষ্টির কথা ভেবে অর্থমন্ত্রী নিত্যপণ্যের দাম কমাতে ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে হতাশই করেছেন। প্রস্তাবিত বাজেটে মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্তের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি বরং তাদের সার্বিক অবস্থার আরো অবনতিই হয়েছে। সরকার সব সময় জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা বললেও ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠীর। সাধারণ মানুষের নয়। এ বিষয়ে কোন দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ নেই।
বর্তমানে প্রায় ১০ ছুঁইছুঁই মূল্যস্ফীতিকে টেনে ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা শুধু আশার বাণীই শোনালেন অর্থমন্ত্রী; কিন্তু এতদবিষয়ক কোন রূপরেখা নেই ঘোষিত বাজেটে। সবকিছুই সরকারের কথামালার ফুলঝুড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে, যা অর্থমন্ত্রীর ছেলে ভোলানো কথাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। উল্টো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্তের চাপে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ব্যাপক হারে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের ওপর করারোপ করেছেন একেবারে অস্বাভাবিকভাবে। তাতে পকেট কাটা যাবে সাধারণ জনগণের। বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রার ওপর। কিন্তু ঘোষিত বাজেটে এসব কথা ভাবা হয়নি। ফলে এবারের বাজেট গণমুখী হয়ে শ্রেণি তুষ্টির বাজেট বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশে যেভাবে অনাকাক্সিক্ষতভাবে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে বা এখনো ঘটছে, তাতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। কিন্তু সার্বিক দিক বিবেচনায় বর্তমানে দেশের মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। ঘোষিত বাজেটেও এ বিষয়ে কার্যকর কোন পদক্ষেপের উল্লেখ নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, মে মাসে দেশে মজুরি বৃদ্ধির হার ৭.৮৮ শতাংশ। সেখানে মূল্যস্ফীতির হার ৯.৮৯ শতাংশ। অর্থাৎ আয়ের চেয়ে ব্যয় ২ শতাংশ বেশি। যা রীতিমত উদ্বেগের।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের বেসামাল দরের প্রেক্ষাপটে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হয়নি। আগামী দুই অর্থবছরের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হচ্ছে না। অবশ্য ন্যূনতম আয়করের পরিমাণ আগের মতোই রাখা হয়েছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার করদাতাদের পাঁচ হাজার, অন্য সিটি করপোরেশন এলাকার করদাতাদের চার হাজার এবং অন্য জেলা শহর ও পৌর এলাকার করদাতাদের তিন হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে। অবশ্য বিত্তশালীদের কাছ থেকে বাড়তি কর আদায়ের পদক্ষেপ থাকায় একটু সান্ত¡না পেতে পারেন মধ্যবিত্তরা। বর্তমানে ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ রয়েছে। এটিকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে করদাতা হয়রানি কমাতে আয়কর রিটার্ন অ্যাসেসমেন্টের বিধান বাতিল করা হচ্ছে। এ জন্য বাজেটে আয়কর আইনে বড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে ব্যক্তি ও কোম্পানি দুই শ্রেণির করদাতাই কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন। করমুক্ত আয়সীমা অপরিবর্তিত রাখার পাশাপাশি ধনীদের সারচার্জ বা সম্পদ করে ছাড় দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। পাশাপাশি পরিবেশ সারচার্জেও কোনো হাত দেওয়া হয়নি। ফলে স্বস্তিতে থাকার সুযোগ থাকছে বিত্তবানদের।
কিন্তু নিম্নবিত্তদের সুবিধা হয় তেমন কোন পদক্ষেপ বাজেটে নেয়া হয়নি বলে অভিজ্ঞ মহলে অভিযোগ রয়েছে।
চাকরির প্রয়োজনে অনেক মধ্যবিত্তের ফিটফাট হয়ে অফিসে যেতে হয়। সে জন্য লন্ড্রিতে কাপড়চোপড় পরিষ্কার বা আয়রন করতে দেন। বাজেটে সেখানেও ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ কাপড় ধোয়া ও আয়রন খরচ বাড়বে। অনেকে আবার দেশে-বিদেশে ঘুরতে পছন্দ করেন। এ জন্য ট্যুর অপারেটরদের সাহায্য নেন। এই সাহায্য নিতেও বাড়তি অর্থ খরচ করতে হবে। কারণ ট্যুর অপারেটরদের ওপর নতুন ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। যা কেউই বাস্তবসম্মত মনে করছেন না।
যান্ত্রিক শহরের কোলাহল ও নাগরিক জীবনের ব্যস্ততা থেকে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে কম সময়ের জন্য অনেকেই পরিবার নিয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটাতে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। তবে ভ্রমণপিপাপু সেসব মানুষের জন্য দুঃসংবাদ রয়েছে ঘোষিত বাজেটে। অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও থিম পার্ক সেবার ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। আগে এই সেবায় ভ্যাট ছিল ৭.৫ শতাংশ। অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টিতে একটু ঘুরতে যাওয়াও এখন বিলাসিতা। ঘুরতে যাওয়ার পর বাচ্চারা আইসক্রিম, চকোলেট কিংবা কোমল পানীয়, বিভিন্ন ধরনের জুস, আমসত্ত্ব খাওয়ার আবদার করলে আগেই জেনে নিন খরচ বাড়ছে। জনস্বাস্থ্য ও রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে এসব পণ্যের ওপর ভ্যাট যুক্ত করা হয়েছে।
তীব্র দাবদাহ থেকে বাঁচতে সাধ্য অনুযায়ী এসি কেনার স্বপ্ন দেখছিলেন যাঁরা, তাঁদের স্বপ্নে এবার গুঁড়েবালি পড়েছে। কারণ এসি তৈরির মূল উপকরণ কম্প্রেসার ও অন্য উপকরণ আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি উৎপাদন পর্যায়ে ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হয়েছে। এতে এসির দাম বাড়বে। একই অবস্থা ফ্রিজের ক্ষেত্রেও। ফ্রিজের কম্প্রেসার আমদানিতে শুল্ক এবং ভ্যাট আড়াই শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া খরচ বাড়বে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বাল্ব, টিউব লাইটের। ফলে সংসারের ঘানি টানতে খরচ আরো বৃদ্ধি পাবে। যা মধ্যবৃত্ত শ্রেণির জন্য গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দেবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
যদি বাড়ি বানানোর পরিকল্পনা থাকে তাহলে এখনই ব্যয় বাড়ানোর হিসাব মেলাতে হবে সংশ্লিষ্টদের। বাড়ি তৈরিতে যত বেশি ইট ব্যবহার করবেন, ততই বাড়তি খরচ করতে হবে আপনাকে। প্রতি এক হাজার পিস ইটে ৫০ টাকা বাড়তি ভ্যাট আদায় করা হবে। অবশ্য বাড়তি টাকা ব্যাংকে সঞ্চয় করতে গেলেও কিন্তু স্বস্তিতে থাকার সুযোগ নেই। সেখানেও আবগারি শুল্কের বেড়াজালে পড়তে হবে। নিরাপদে থাকতে বাসাবাড়িতে এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে সিকিউরিটি গার্ড রাখা হয়। এই সেবার ওপরও ভ্যাট ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। কর আদায়ে নারীদের রূপচর্চায়ও হাত দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। সরকার নিজেদের নারীবান্ধব দাবি করলেও নারীদের রূপচর্চার সামগ্রীর ওপর ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। হাত, নখ, পায়ের প্রসাধনসামগ্রী, লিপস্টিক, চুল পরিচর্যাসামগ্রীতে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোয় কসমেটিকস আইটেমের দাম বাড়তে পারে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্লান্ট, ইকুইপমেন্ট ও ইরেকশন ম্যাটেরিয়াল আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এতে জনজীবনের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যুক্ত বিদ্যুতের দাম বাড়তে পারে। এর প্রভাব পড়তে পারে পণ্যের উৎপাদন খরচে। কর ছাড় কমিয়ে আনার খড়গ পড়তে পারে দেশীয় শিল্পে।
কর আদায়ে নানাভাবে জাল বিস্তার করা হলেও যাদের হাতে কালো টাকা আছে, তাদের জন্য আবারও অল্প করে টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে। তবে এ জন্য আগের চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি আয়কর দিতে হবে। আগে এই হার ছিল ১০ শতাংশ, এবার তা হচ্ছে ১৫ শতাংশ। এ প্রক্রিয়ায় টাকা বৈধ করলে সরকারের কোনো সংস্থা কোনো ধরনের প্রশ্ন করতে পারবে না। রাত-দিন বা অবসরে সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস থাকলে বাদ দেয়াই ভালো। কারণ, সিগারেটের দাম বাড়বে। রাজস্ব আয়ের সহজ পন্থা হিসেবে প্রতি অর্থবছরই সিগারেটের মূল্য স্তর বাড়ায় এনবিআর, এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তাই বাজারে সিগারেটের প্যাকেটের দাম বাড়বে। তাই এই বদঅভ্যাসটা ছেড়ে দেওয়াটাই এখন অধিক যুক্তিযুক্ত।
বাজেটে কত বিষয়ে পরিবর্তন হলো। এসব নিয়ে যদি কেউ বন্ধু কিংবা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন, এতেও গুনতে হবে আগের চেয়ে বাড়তি টাকা। বিকল্প হিসেবে যদি ইন্টারনেটে যোগাযোগের চেষ্টা করেন, তবু পড়বেন করের ফাঁদে। কারণ মোবাইল ফোনে কথা বলতে ও ইন্টারনেট ব্যবহারে ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক যোগ করা হয়েছে। তবে ৩০টি নিত্যপণ্যের সরবরাহ পর্যায়ে উৎস কর ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হচ্ছে। বাজেটে সবচেয়ে বড় সুখবর আপাতত এটাই।
এ প্রসঙ্গে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের বক্তব্য হলো, ‘মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় এমনিতেই অনেক বেড়ে গেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে আয় বাড়ছে না। ফলে প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে টিসিবির লাইন। মধ্যবিত্তও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। এবারের বাজেটে যেভাবে কর বৃদ্ধি করা হয়েছে, তাতে আরো বিপাকে পড়বে সাধারণ মানুষ।’ কিন্তু এসব উদ্বেগের বিষয়ে সরকার বা সরকার সংশ্লিষ্টদের কোন মাথাব্যথা নেই।
প্রতিবার বাজেট ঘোষণার পর সরকার পক্ষ ঘোষিত বাজেটকে গণমুখী এবং বিরোধীদের গণবিরোধী দাবি করা আমাদের দেশে রীতিমত ট্রাডিশনে পরিণত হয়েছে। তাই প্রতিবারই নজর দিতে হয় তৃতীয় পক্ষের বাজেট পর্যালোচনার দিকে। ঘোষিত বাজেট নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে গতানুগতিক প্রতিক্রিয়া চললেও বাস্তবতা কিন্তু সাধারণ মানুষ তথা দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী মধ্যবিত্তের পক্ষে কথা বলে না। এমনটিই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। মূলত, এবারের বাজেটে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হবেন দেশের মধ্যবিত্তসহ প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ। তাই প্রস্তাবিত বাজেট পাসের আগে এসব মানুষের কথা বিচেনায় আনা দরকার।