ঈদ উল আযহার কুরবানিকে কেন্দ্র করে মসলার বাজার অস্থির করে তুলেছে ব্যবসায়ীরা। পাইকারী বাজারে দাম বাড়ার সাথে সাথে খুচরা বাজারে হু হু করে দাম বেড়ে যাচ্ছে মসলার। এ ঈদে কুরবানির গোশত রান্নায় মসলার প্রয়োজন অনেক বেড়ে যায়। বিশেষ করে গোশত রান্নার জন্য পেঁয়াজ, রসুন, আদার মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সঙ্গে লাগে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গরম মসলাও। এসব পণ্যের দাম এখন আকাশচুম্বী। মসলার পাশাপাশি সবজি ও কাঁচা মরিচের দামও অনেক বেশি।
গতকাল শুক্রবার বিভিন্ন বাজারে দেখা গেছে, গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় সব ধরনের মসলার দাম বাড়তি। শেষ কয়েকদিনের ব্যবধানেও দাম বেড়েছে আরেক দফা। এখন রাজধানীর বাজারে দেশি পেঁয়াজ দামের দিক থেকে শতক ছুঁইছুঁই করছে। কোথাও ছুঁয়েছেও। তবে মোটা দাগে খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা। যা এক সপ্তাহ আগে ৮০ টাকা আর একমাস আগে ৬০ টাকা ছিল।
একইভাবে গত একসপ্তাহে রসুনের দাম ২০ টাকা বেড়ে ২৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বড় লাফ দিয়েছে আদার দাম। ৮০ টাকা বেড়েছে কেজিপ্রতি। এখন বিক্রি হচ্ছে ৩২০ থেকে ৩৩০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ২৪০-২৫০ টাকা ছিল। এছাড়া অন্যান্য গরম মসলার দামও আকাশছোঁয়া। এমন পরিস্থিতিতে ঈদের প্রয়োজনীয় এসব মসলা কিনতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। একেবারে নি¤œবিত্ত ও নি¤œ মধ্যবিত্তরা নিত্যপণ্যের দরে ঊর্ধ্বগতিতে নাজেহাল হয়ে পড়ছেন।
এদিকে, দাম বাড়ার জন্য ছোট ব্যবসায়ীরা দায় চাপাচ্ছেন আমদানিকারক ও পাইকারদের ওপর। আর আমদানিকারক ও পাইকাররা দাঁড় করাচ্ছেন বিশ্ববাজার, ডলারের দর, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি ও রপ্তানিকারক দেশগুলোতে উৎপাদন কমে যাওয়াসহ নানা অজুহাত। তবে ক্রেতাদের অভিযোগ, রমজানের আগে যেমনি নিত্যপণ্যের দর বাড়ালেন কৌশলী ব্যবসায়ীরা তেমনি কোরবানির আগেও সেই পথেই হাঁটলেন তারা। সুযোগ নিলেন চাহিদা বাড়ার।
দাম বাড়ার বিষয়ে পরিসংখ্যান উঠে এসেছে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার দরের তথ্যেও। সংস্থাটির বাজারদর অনুযায়ী, এক বছরে দেশি পেঁয়াজের দাম প্রায় ১০ শতাংশ, রসুনের দাম সর্বোচ্চ ৬৯, আদার ২৩, দারুচিনি ১৯, লবঙ্গ ১১, এলাচ ৮৭ ও তেজপাতার ৮৫ শতাংশ বেড়েছে। এক বছরে জিরার দর না বাড়লেও এক মাসে বেড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ।
গরম মসলার বাজারে এ বছর সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে এলাচের। গত বছরের তুলনায় এখন মসলাটির দর প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি। মানভেদে প্রতি কেজি এলাচ বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৬শ থেকে ৪ হাজার ২শ টাকা। গত বছর এ দর ছিল ১ হাজার ৬শ থেকে ২ হাজার ৪শ টাকা। অর্থাৎ এখন ১০০ গ্রাম খোলা এলাচ কিনতে গুনতে হচ্ছে প্রায় ৪০০ টাকা। জিরার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকা। খুচরা নিলে প্রতি ১০০ গ্রাম ১০০ টাকা রাখা হচ্ছে। গত বছর কোরবানির আগে জিরার কেজি কেনা গেছে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায়।
প্রতি কেজি লবঙ্গের দাম ১ হাজার ৮০০ টাকা। ১০০ গ্রাম ২০০ টাকাও বিক্রি হচ্ছে। যা গত বছর ১৫০ টাকা ছিল। এছাড়া প্রতি ১০০ গ্রাম দারুচিনি ২০ টাকা বেড়ে ৫০ টাকা, লং ৪০ টাকা বেড়ে ২০০ টাকা, গোলমরিচ ১০০ টাকা, তেজপাতা ৩০ টাকা এবং কালো এলাচ ৪০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে বেড়েছে শুকনো মরিচের 1দামও। প্রতি ১০০ গ্রাম শুকনো মরিচ ৫০ টাকা এবং কেজি ধরে কিনলে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় কেজিপ্রতির দাম বেড়েছে প্রায় ১৫০ টাকা।
বাংলাদেশ পাইকারি গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এনায়েত উল্লাহ জানান, অন্যান্য মসলার দাম আমদানি খরচের হিসেবে তুলনামূলক বাড়েনি বরং কম রয়েছে। শুধু এলাচের দামটা একটু বেশি। কারণ বেশিরভাগ এলাচ আসে ভারত থেকে। সেখানে এবার গরমের কারণে উৎপাদন কম হয়েছে। তিনি বলেন, এখন ডলারের দাম বেশি। বিশ্বব্যাপী মসলার দাম বেশি। মসলা আমদানিতে পরিবহন খরচ বেড়েছে। এসব কারণে দাম বেড়েছে।
এদিকে, মসলার পাশাপাশি ঈদকে সামনে রেখে বাড়তে দেখা গেছে সালাদের উপকরণ শসা, টমেটো ও গাজরের দাম। প্রতি কেজি শসা ১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যা দিন আগেও ৮০ টাকা ছিল। একইভাবে বেড়ে টমেটো ১২০ টাকা, পুরাতন গাজর ৮০ টাকা ও নতুন গাজর ১৪০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। লেবু হালি বিক্রি হচ্ছে ২০-৩০ টাকা দরে। এদিকে, আবারও বেড়েছে ডিমের দর। বাজারে প্রতি ডজন ফার্মের বাদামি রংয়ের ডিম ১৬০ থেকে ১৬৫ এবং সাদা রংয়ের ডিম ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাজারে দেখা গেছে, ব্রয়লার মুরগি ১৮৫ থেকে ১৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে ব্রয়লার ১৯৫ থেকে ২০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। বাজারগুলোতে সোনালি মুরগি কেজিতে ৩২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সোনালি হাইব্রিড ২০ টাকা কমে ৩০০ টাকা, দেশি মুরগি ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি, লেয়ার মুরগি ৩০ টাকা কমে ৩১০ টাকা এবং সাদা লেয়ার ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। দেশি পেঁয়াজ কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ৮৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহেও পেঁয়াজ ৮০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। বাজারগুলোতে গত সপ্তাহে কাঁচা মরিচ ২০০ টাকা দরে বিক্রি হলেও চলতি সপ্তাহে ২৪০ থেকে ২৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মরিচের দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।
সবজি বাজারগুলোতে গ্রীষ্মকালীন সবজি কচুরমুখী ৮০ টাকা, বেগুন ৫০ থেকে ৬০ টাকা, করলা ৬০ টাকা, পটল ৪০ টাকা, ঢেঁড়স ৪০ টাকা, বরবটি ৮০ টাকায়, প্রতিটি লাউ বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা, পেঁপে প্রতি কেজি ৬০ টাকা, ধুন্দুল ৫০ থেকে ৬০ টাকা, চিচিঙ্গা ৬০ টাকা, কচুর লতি ৮০ টাকা, ঝিঙা ৭০ টাকা, সাজনা ১৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে ঈদকে সামনে রেখে শসার ১০০ থেকে ১২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
বাজারগুলোতে ফুলকপি ৫০ থেকে ৬০ টাকা পিস, বাধা কপি ৫০ থেকে ৬০ টাকা পিস, ব্রুকলি ৪০ টাকা পিস, পাকা টমেটো প্রকারভেদে ৭০ থেকে ৮০ টাকা এবং গাজর ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। লেবুর হালি ১০ থেকে ৪০ টাকা, ধনে পাতা কেজি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে , কলার হালি বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়, মিষ্টি কুমড়া কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা। এছাড়া বাজারগুলোতে লাল শাক ১৫ টাকা আঁটি, লাউ শাক ৪০ টাকা, মূলা শাক ১৫ টাকা, পালং শাক ১৫ থেকে ২০ টাকা, কলমি শাক ১০ টাকা আঁটি দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে। বাজারগুলোতে দেশি পেঁয়াজ কেজিতে ৮৫ টাকা আর আলু ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
বাজারে গরুর গোশত কেজি প্রতি ৬৫০ থেকে ৭৮০ টাকা, গরুর কলিজা ৭৮০ টাকা, গরুর মাথার গোশত ৪৫০ টাকা, গরুর বট ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা এবং খাসির গোশত কেজি প্রতি ১১০০-১১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারগুলোতে এক ডজন লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ টাকায়, হাঁসের ডিম ২০০ টাকায়, দেশি মুরগির ডিমের হালি ৮৫ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে।
মাছের বাজারগুলোতে ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ মাছ কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা এবং ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রামের মাছ ১৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারগুলোতে এক কেজি শিং মাছ চাষের (আকারভেদে) বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকায়, প্রতি কেজি রুই মাছের দাম বেড়ে (আকারভেদে) ৪০০ থেকে ৬০০ টাকায়, মাগুর মাছ ৯০০ থেকে ১২০০ টাকা , মৃগেল ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকায়, চাষের পাঙাশ ২১০ থেকে ২৩০ টাকায়, চিংড়ি আকার ভেদে প্রতি কেজি ৬০০ থেকে ১৪০০ টাকায়, বোয়াল প্রতি কেজি ৫০০ থেকে ৯০০ টাকায়, কাতল ৪০০ থেকে ৬০০ টাকায়, পোয়া মাছ ৪০০ থেকে ৬০০ টাকায়, পাবদা মাছ ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়, তেলাপিয়া ২২০ টাকায়, কৈ মাছ ২২০ থেকে ২৪০ টাকায়, মলা ৫০০ টাকা, বাতাসি টেংরা ১৪০০ টাকায়, টেংরা মাছ ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা, কাচকি মাছ ৬০০ টাকায়, পাঁচমিশালি মাছ ২২০ টাকায়, রুপচাঁদা ১২০০ টাকা, বাইম মাছ ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা, দেশি কই ১২০০ টাকা, মেনি মাছ ৭০০ টাকা, সোল মাছ ৬০০ থেকে ১০০০টাকা, আইড় মাছ ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা, বেলে মাছ ৭০০ টাকা এবং কাইক্কা মাছ ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
বাজারে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ৪৮ থেকে ৫০ টাকা, বি আর-আটাশ ৫৫ থেকে-৫৮ টাকা, পাইজাম ৫৮ থেকে ৬০ টাকা। মাঝারি মানের চিকন চালের কেজি ৭৫ টাকা। আর ভালো মানের চিকন চালের কেজি ৮৫ টাকা।
বাজারগুলোতে আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে ডাল। দেশি ও আমদানি করা মসুর ডাল ১৫০ টাকা, আমদানি করা মোটা ডালের কেজি ১২০ টাকা, ছোলার ডাল ১৩০ টাকা, অ্যাংকর ডালের কেজি ৯০ টাকা। এসব বাজারে ঈদকে সামনে রেখে আদা ২৮০ থেকে ৩২০ টাকা এবং রসুন ২২০ থেকে ২৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।