চলতি বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় খাতা পুনঃমূল্যায়নের আবেদনের পর ফলাফলে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এতে প্রশ্ন উঠেছে পাবলিক পরীক্ষায় খাতা মূল্যায়নের ব্যবস্থাপনা নিয়ে। পরীক্ষকদের পাশাপাশি প্রশ্নের মুখে পড়েছেন খাতা নিরীক্ষক ও প্রধান পরীক্ষকরাও। একজন পরীক্ষক খাতা পরীক্ষার পর তা নিরীক্ষা করেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ের আরেকজন শিক্ষক। এরপর তা জমা দেওয়া হয় প্রধান পরীক্ষকের কাছে। তারও এটি নিরীক্ষা করার নিয়ম রয়েছে। এভাবে কয়েক স্তরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ফল তৈরি করা হয়। কিন্তু এসবই যে দায়সারাভাবে চলছে তা প্রকটভাবে ফুঠে উঠেছে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় ব্যাপক ফল পরিবর্তনে। খাতা দেখা আর নিরীক্ষার ক্ষেত্রে বিরাজমান এ ধরনের অবহেলার মাশুল দিচ্ছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী।
জানা যায়, এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত ফল না পেলে সেটি পুনঃমূল্যায়নের জন্য আবেদন করে থাকে। এক্ষেত্রে শিক্ষা বোর্ডগুলো সেই সুযোগ দিয়ে থাকে। কিন্তু অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার পুনঃনিরীক্ষণের ফলে অস্বাভাবিক পরিবর্তন হয়েছে। আবেদনের সংখ্যাও বেড়েছে বহুগুণ। চলতি বছর ৯টি সাধারণ বোর্ডসহ ১০টি শিক্ষা বোর্ডে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল পুনঃনিরীক্ষণের জন্য আবেদন করেছিল তিন লাখের বেশি শিক্ষার্থী। যদিও কারিগরি বোর্ড এখনো ফলাফল প্রকাশ করেনি। ২০১৪ সালে ফল পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করেছিল মাত্র ৪৩ হাজার শিক্ষার্থী। অথচ ১০ বছরের ব্যবধানে সেই আবেদনের সংখ্যা পাঁচগুণের বেশি বেড়েছে। পুনঃনিরীক্ষার আবেদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফল রদবদলের হারও বেড়েছে।
চলতি বছর প্রকাশিত এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার উত্তরপত্র পুনঃমূল্যায়ন করে ৮ হাজার ৮৭৫ পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। তাদের মধ্যে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে এক হাজার ২২৪ পরীক্ষার্থী, ফেল থেকে পাশ করেছে ১ হাজার ১১০ পরীক্ষার্থী। ফেল থেকে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে সাতজন। বাকি পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে বিভিন্ন গ্রেডে। দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে ৯টি সাধারণ এবং মাদ্রাসা বোর্ডের প্রকাশিত পুনঃনিরীক্ষণের ফল বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বলছেন, ভালো পরীক্ষা দেওয়া সত্ত্বেও পরীক্ষকদের অবহেলা ও অদক্ষতায় শিক্ষার্থীরা যথাযথ ফল পাচ্ছে না। যাদের ফল পরিবর্তন হয়েছে তারা পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সবার কাছে হেয় হয়েছে এবং নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করেছে। অনাকাঙ্ক্ষিত ফল বিপর্যয়ের শিকার হয়ে অনেক শিক্ষার্থী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। সবাই জেনেছে তারা ভালো ফল করতে পারেনি। এবার ফল প্রকাশের পর ৮ জন শিক্ষার্থীর আত্মহননের খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু যাদের কারণে এ বিপর্যয়, দায়ী সেই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে না। এতে অন্য পরীক্ষকরাও সতর্ক হচ্ছেন না। ফলে প্রতিবছর বাড়ছে ভুলের হার। সম্প্রতি আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের তদন্তেও পরীক্ষকদের ভুলের বিষয়টি উঠে এসেছে।
পরীক্ষকরা জানিয়েছেন, খাতা মূল্যায়নের জন্য বরাদ্দকৃত সময় এবং পারিশ্রমিক খুব সীমিত। অনেক বিষয়ে রয়েছে তীব্র পরীক্ষক সংকট। খুবই স্বল্প সময়ে অনেক বেশি খাতা দেখতে হয় তাদের। এতে করেও অনেকে খাতা দেখার প্রতি সুবিচার করতে পারেন না। আবার যারা আন্তরিক তারা কম সময়েও চেষ্টা করেন সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়নের।
বর্তমানে খাতা পুনঃনিরীক্ষার আবেদনে পুরো খাতা মূল্যায়নের কোনো সুযোগ নেই। শুধু নম্বর যোগে ভুল আছে কিনা, খাতা থেকে নম্বর ঠিকমতো তোলা হয়েছে কিনা, খাতায় সব উত্তরের পাশে নম্বর দেওয়া আছে কিনা এবং ওএমআর শিটে ঠিকমতো বৃত্ত ভরাট হয়েছে কিনা এসব বিষয় দেখা হয়। আর এতে করেই প্রায় প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হচ্ছে। এটা পরীক্ষক ও খাতা নিরীক্ষার সঙ্গে যারা জড়িত সম্পূর্ণরূপে তাদের অবহেলা আর অমনোযোগিতার ফল। কিন্তু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মতে, যদি পুরো খাতা মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকত তাহলে ফলাফলে আরও ব্যাপক পরিবর্তন আসত। কিন্তু বর্তমান আইনে পুরো খাতা পুনরায় মূল্যায়নের সুযোগ নেই। অনেক অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর মতে এটি থাকা উচিত। তাহলে আবেদনকারীদের বেশিরভাগেরই ফল পরিবর্তন হতো এবং পরীক্ষকদেরও আরও কয়েকগুণ ভুল ধরা পড়ত।
আগে এসএসসি পরীক্ষার ফল ৩ মাসে প্রকাশিত হলেও কয়েক বছর ধরে তা ২ মাসে দেওয়া হয়। চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয় ১৫ ফেব্রুয়ারি। শেষ হয় ১২ মার্চ। ফল প্রকাশিত হয় ১২ মে। মাত্র ৬০ দিনের মাথায় ফল প্রকাশ করা হয়। এটি খাতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে খুব অল্প সময় বলে জানিয়ছেন পরীক্ষকরা। জানা যায়, একজন পরীক্ষককে সাধারণত ৩০০ থেকে ৪০০ খাতা দেওয়ার কথা। কিন্তু এ নিয়ম ভেঙে অনেককেই আরও বেশি খাতা দেওয়া হয়। পরীক্ষকরা যেদিন খাতা নেন সেদিন থেকে সর্বোচ্চ ১৪ দিন সময় পান। খাতার পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে সময় বাড়ে-কমে না। ফলে যারা বেশি খাতা নেন তাদের তাড়াহুড়া করতে হয়। খাতা মূল্যায়নের পর আরও অনেক কাজ করতে হয়। সময়ের অভাবে এসব কাজ অনেক সময় বাইরের লোক দিয়েও পরীক্ষকরা করান বলে জানিয়েছেন অনেকে। এ কারণে অনেক ভুলভ্রান্তি হয়। শিক্ষার্থীদের প্রতি অবিচার করা হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার যুগান্তরকে বলেন, খাতা মূল্যায়নে একেকজন পরীক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গিও একেক রকম থাকে। চলতি বছরের এসএসসির পুনঃনিরীক্ষণে ফল পরিবর্তনের হার একটু বেশি। শিক্ষার্থীদের আবেদনও বেশি ছিল। তবে এখানে খাতা মূল্যায়নে শিক্ষকদের গাফিলতি ছিল বলে মনে করেন তিনি। এ বিষয়ে তদন্ত করে দায়ীদের চিহ্নিত করা হবে বলে তিনি জানান।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, যারা পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করে তাদেরও মূল্যায়ন করা উচিত।
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক রোকনুজ্জামান শেখ যুগান্তরকে বলেন, উত্তরপত্র মূল্যায়নে সময় আরও বাড়ানো উচিত। তাহলে ভুলের মাত্রা কমে আসবে। এক্ষেত্রে অনেক শিক্ষকের গাফলতিও রয়েছে। তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, এসএসসিতে প্রত্যাশিত ফলাফল না পেলে অনেক শিক্ষার্থী মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। খাতা মূল্যায়নের আবেদনের পর অনেকের ফলে পরিবর্তন আসে। এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। তাই খাতা মূল্যায়নে পরীক্ষকদের আরও সচেতন হয়ে কাজ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।