বাংলাদেশে রাজনৈতিক অধিকার অনেকটাই সরকারের হাতে অন্তরীণ হয়ে গেছে। জনগণের ইচ্ছার পক্ষে শাসনব্যবস্থায় কোনো ধরনের পরিবর্তন আপাতত অসম্ভব মনে হচ্ছে। এ ধরনের একটি বন্দী অবস্থার জন্য দেশের মানুষ প্রধানত ভারতকে দায়ী মনে করে। এই জিম্মি অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ভারতে সরকারের পরিবর্তনের মধ্যে এ দেশের মানুষ একটি আশা খুঁজতে চেষ্টা করে। যদিও এটি নিশ্চিত করে বলা যায়, দেশটির বিরোধী জোট ক্ষমতায় এলেও তারা বাংলাদেশের জনগণের চেয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে অধিক সমর্থন দেবে। এ দেশে ভোটবিহীন সরকার কায়েমে কংগ্রেস প্রথম মেয়াদে পুরোদমে দৃষ্টিকটু সহযোগিতা করেছে। নরেন্দ্র মোদি কংগ্রেসের সেই নীতিকে সমর্থন করে গেছেন। ক্ষেত্রবিশেষে হাসিনা সরকারের জন্য সহযোগিতা তিনি আরো বাড়িয়েছেন।
ভোট দিতে না পারা বাংলাদেশের জনগণ চেয়ে চেয়ে দেখছে, ভারতের জনগণ ভোট দিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থী বাছাই করছে। যেমন ভোট নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের জন্য পছন্দ করছেন না, সেই একই ধরনের অবাধ ভোটে তিনি পরাজয়ের শঙ্কা নিয়ে লড়ছেন। তিনি পরাজিত হলেও ভারত থেকে ভোট ব্যবস্থা হারিয়ে যাক, এটি চান না। সদ্য ভোটের আগে মরণপণ প্রচারণার স্টাইল বুঝিয়ে দিয়েছে, মোদির আগের মতো জোয়ার আর নেই। তাই তাকে ধর্মীয় বিভাজনের অগ্নিতে আরো বেশি ঘি ঢালতে হয়েছে। তিনি মন্দিরে গিয়ে বিশেষ কায়দায় পূজা দিয়েছেন, কোথায়ও প্রাণ প্রতিষ্ঠা করছেন। এগুলোতেও কাজ হচ্ছে না টের পেয়ে ঘোষণা করে বসলেন, তিনি একজন অবতার। খোদ ঈশ্বরের মনোনীত। পৃথিবীতে তার আগমনের একটি বিশেষ কারণ রয়েছে বলে উল্লেখ করলেন। এই চটকদার কথাবার্তা গভীর রাতে শ্মশানের পাশ দিয়ে যাওয়া মানুষের ভয়তাড়ানিয়া গানের মতো। বিজয়রথ তার আর আগের মতো নেই। মানুষ তাকে এক ধরনের প্রত্যাখ্যান করেছে। ভোটের বাক্সে তার প্রমাণ পাওয়া গেল।
উত্তর প্রদেশের বারানসিতে তিনি দেড় লাখ ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন। একই আসন থেকে ২০১৯ সালে চার লাখ ৭৯ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয় পেয়েছিলেন তিনি। অনেকে তাকে জওয়াহেরলাল নেহরুর সাথে তুলনা করছেন। অথচ নেহরু তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময় বিপুল ভোটে জিতেছিলেন। বর্তমান মোদির চেয়ে সেটি তিন গুণ বেশি ভোটের ব্যবধানে। সেই অর্থে এটি মোদির জন্য পরাজয়ের স্বাদ নেয়া বিজয়। যার প্রকাশ দেখা গেছে মোদির চেহারা, আচার-আচরণে। চন্দ্রবাবু নাইড়– ও নীতিশ কুমারকে তিনি যেভাবে তোয়াজ করলেন, সেটি বড় বেমানান।
হিন্দুত্ববাদের জোয়ার ও মোদির ব্যক্তিগত ভাবমর্যাদা দুটোই বড়দাগে নিম্নমুখী। এই নির্বাচনে ২২৪ জন প্রার্থী তার চেয়ে বেশি ব্যবধানে জয় পেয়েছেন। বিরোধী জোটের নেতা রাহুল প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছ থেকে প্রায় চার লাখ বেশি ভোট পেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল নেতা অভিষেক সাত লাখ ১০ হাজার বেশি ভোটে জয় পেয়েছেন। নিজ দলের মধ্যেও মোদি ফিকে হয়ে গেছেন। তার দলেরই ১১২ নেতা তার চেয়ে বেশি ভোটে জিতেছেন। এর মধ্যে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ চৌহান আট লাখ ২০ হাজার বেশি ভোট পেয়ে জিতেছেন। মোদির বদলে তাকে প্রধানমন্ত্রী করার আলাপও উঠেছিল।
মোদির নেতৃত্বে ভারতে ঘৃণা-নির্ভর এক বিশেষ সংস্কৃতি চালু হয়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ক্ষয়ে একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। গণতন্ত্র মূল্যায়নকারী বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলো তার সরকারকে নির্বাচিত স্বৈরাচার আখ্যা দিয়েছে। এ অবস্থায়ও মোদিকে ধন্যবাদ দিতে হয় নিজের একার সুবিধার জন্য তিনি ভারতের ভোটব্যবস্থা ধ্বংস করে দেননি। দেশটির নির্বাচন কমিশন নিয়ে বহু বিতর্ক উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটিকে মোদি পকেটবন্দী করছেন এমন অভিযোগ করা হয়েছে। ভোটের ফল বলছে, ভোটের দিনে কমিশন পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করেছে এবং ভারতবাসীকে একটি নিরপেক্ষ ভোট উপহার দিয়েছে। ভোট কারচুপি নিয়ে কারো অভিযোগ নেই।
এই নির্বাচনে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের জন্য কোনো সুখবর নেই। তবে ভারতের মানুষের জন্য আশাজাগানিয়া কিছু লক্ষণ আছে। কোণঠাসা হয়ে যাওয়া সংখ্যালঘুরা সাহস পুনরুদ্ধার করছে। মনে রাখতে হবে, সেখানে নিম্নবর্ণের লোকেরাও এই সংখ্যালঘুদের কাতারে রয়েছে। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ হতে শুরু করলে চাপে পড়া মানুষ নানাভাবে আনন্দ প্রকাশ শুরু করে। বলিউড অভিনেত্রী কঙ্গনা রনৌতের চড় খাওয়ার ঘটনাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিমানবন্দরে কর্মরত সাধারণ এক নারী কর্মী তাকে সপাটে চড় দিয়েছেন। কেউ কাউকে চড় দিয়ে দেবেন, নিশ্চই অন্যায় কর্ম। তবে রনৌতের চড় খাওয়ার পর বেশ উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে।
হিমাচল প্রদেশে একটি আসনে প্রথমবার ভোটে দাঁড়িয়ে জিতেছেন তিনি। দেশে বহু গুণী অভিনেতা থাকলেও এই নারী কেন বিজেপির পছন্দ- সেই প্রশ্নও করেছেন অনেকে। বেশ কয়েক বছর ধরে বিজেপির বিতর্কিত সব কর্মকাণ্ডে তিনি নগ্ন সমর্থন করেছেন। কিছু ক্ষেত্রে তিনি উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে সংখ্যালঘু নিপীড়নের সমর্থন দিয়েছেন। অব্যাহতভাবে উগ্র ও অশালীন মন্তব্য করে গেছেন। বহু অপ্রাসঙ্গিক বিষয় ঘৃণা উগড়ে দিয়েছেন। টুইটার এ ধরনের কিছু অশোভন মন্তব্য মুছে দিয়েছে। এমন বাজে মন্তব্য তিনি করেছিলেন চড় দেয়া নারীর মায়ের বিরুদ্ধেও। কৃষক আন্দোলনে তিনি শরিক হয়েছিলেন। ওই নারীদের তিনি ১০০ টাকার কর্মী বলেছিলেন। চণ্ডিগড় বিমানবন্দরে চড় খাওয়ারও একটা কারণ রয়েছে। নিরাপত্তা তল্লাশির সময় তিনি উগ্র আচরণ করেন। ওই নারী কর্মী তখন ক্ষিপ্ত হয়ে মায়ের প্রতি করা বিশ্রী মন্তব্যের প্রতিশোধ নিয়ে নেন।
রনৌতের গালে চড়টি কোথায় লেগেছে তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ট্রল হয়েছে। তারা মনে করেন, এই চড় আসলে ক্ষমতার একেবারে কেন্দ্রে আঘাত করেছে। বিজেপির দাবি অনুযায়ী, ৪০০ আসনে জিতলে এই সামান্য নারী কর্মী বলিউড অভিনেত্রী ও সদ্য বিজয়ী রনৌতকে চড় মারার এই দুঃসাহস দেখাতেন না। এই নির্বাচনে পীড়নের শিকার ভারতীয় সমাজ জেগে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জি পরীক্ষামূলক ভারতীয় জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় ইউসুফ পাঠানকে বহরমপুরে দাঁড় করান। পাঁচবারের লোকসভা সদস্য অধিররঞ্জন চৌধুরীকে তিনি বিপুল ভোটে পরাস্ত করেছেন।
ভারতের জনসংখ্যার ১৪ শতাংশের বেশি মুসলমান। কিন্তু সেখানে জনসংখ্যার অনুপাতে কখনোই লোকসভায় প্রতিনিধিত্ব পায়নি তারা। সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব পেয়েছে ১৯৮০ সালে। সেটি কমতে কমতে এবার এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪ শতাংশে। এবার মাত্র ২৪ জন মুসলমান প্রার্থী লোকসভায় গেছে। এর মধ্যে সর্ববৃহৎ দল বিজেপিতে একজনও নেই। এমনকি তাদের এনডিএ জোটে একজনও মুসলমান নেই। সদ্য গঠিত মন্ত্রিসভায় ১৪ শতাংশ মুসলমানকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য একজনও স্থান পেলেন না। এর পরও দেশটি ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক দাবি করে।
jjshim146@yahoo.com