ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি জেলায় প্রায় ৯৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এতে কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ফসল বিনষ্ট হয়েছে প্রায় দেড় লাখ হেক্টর জমির। প্রায় হাজার কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে জলোচ্ছ্বাসে। বেড়িবাঁধ ভাঙার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, কমপক্ষে ১১টি কারণে উপকূলের বেড়িবাঁধ সামান্য জোয়ারের পানিতে ভেঙে যায়। জীবন ও সম্পদহানির ঘটনা ঘটে।
যেসব কারণে বেড়িবাঁধ সহজেই ভেঙে যায়, সেগুলো হচ্ছে-ষাটের দশকের ডিজাইনে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা, তড়িঘড়ি করে বাঁধ নির্মাণ, রোলার দিয়ে ভালোভাবে মাটি না দাবিয়ে বাঁধ তৈরি, বাঁধে ইঁদুরের গর্ত খোঁড়া, হতদরিদ্র ছিন্নমূল মানুষ বেড়ির ঢালে ঘর-দরজা নির্মাণ করা এবং প্রভাবশালীরা বেড়িবাঁধের নিচ দিয়ে পাইপ ঢুকিয়ে নদী থেকে বালু উত্তোলনের পর সৃষ্ট ছিদ্র ভরাট না করা। এছাড়াও রয়েছে তদারকির জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের জনবল সংকট, ডিজিটাইজেশনের ছোঁয়া না লাগা, মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণ খাতে বরাদ্দ না থাকা, জমি অধিগ্রহণের সমস্যা এবং বেড়িবাঁধের এপার-ওপারের মানুষের মধ্যে রেষারেষির কারণে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বাঁধ ছিদ্র করে দেওয়া।
উপরন্তু বেড়িবাঁধ কাজের গুণগত মান নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। জানতে চাইলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান যুগান্তরকে বলেন, ষাটের দশকের ডিজাইনে বেড়িবাঁধ হচ্ছে এটা ঠিক, তবে সম্প্রতি বেশকিছু নতুন ডিজাইন করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, উপজেলা পর্যায়ে জনবল একেবারেই নেই, তা কিন্তু নয়। তবে সব উপজেলায় নেই। মেরামত বা রক্ষাণাবেক্ষণ খাতে বরাদ্দ একেবারেই নেই, তা কিন্তু নয়। বরাদ্দ কোনো এলাকার জন্য হয় না। জাতীয়ভাবে হয়। সেক্ষেত্রে যেখানে বেশি দরকার, সেখানে খরচ করা হয়। প্রভাবশালীরা বেড়িবাঁধের মাটির ভেতর দিয়ে ড্রেজারের পাইপ ঢুকিয়ে বালু উত্তোলনের কথা স্বীকার করে সচিব বলেন, এগুলো দুঃখজনক বাস্তবতা। তিনি জনগণকে সরকারি সম্পদ রক্ষায় আরও সচেতন হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, দেশের বেড়িবাঁধের বর্তমান ডিজাইন ষাটের দশকের। তখনকার তুলনায় বর্তমানে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস আরও ক্ষীপ্রগতিতে আঘাত হানছে। প্রকৃতির গতিপ্রকৃতির পরিবর্তন হলেও বেড়িবাঁধের ডিজাইন আধুনিকায়ন হয়নি। আনা হয়নি কোনো ধরনের পরিবর্তন। ফলে একটু বেশি জোয়ার হলেই বাঁধ ভেঙে স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, আগে বেড়িবাঁধে ৬ মাস সময় নিয়ে মাটি ভরাট করা হতো। বিশেষ করে ডিসেম্বরে মাটি ভরাট শুরু হতো, শেষ হতো জুনে। প্রায় ৬ মাস মাটি ভরাটের ফলে মাটি স্বাভাবিক নিয়মে ভালোভাবে বসে শক্ত বাঁধ তৈরি হতো। এখন বেড়িবাঁধের টেন্ডারে সর্বোচ্চ ৩ মাস বা ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়। অনেক সময় আরও কম সময়ে বর্ষার মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে বেড়িবাঁধের কাজ করতে হয়। এতে কাজের মান বলে কিছু থাকে না। ফলে সামান্য জোয়ারের পানিতে ভেঙে যায় বাঁধ।
তারা আরও জানান, তৈরি বেড়িবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই। দেখভালের জন্য নেই কোনো জনবল। বেড়িবাঁধ তৈরির পর ইঁদুর গর্ত খুঁড়ে, অন্যান্য প্রাণীও গর্ত তৈরি করে, ছিন্নমূল মানুষ বেড়িবাঁধের ঢালুতে ঘর তৈরি করে বসবাস করে। অনেকে বেড়িবাঁধের ওপর নানা ধরনের গাছ, শাকসবজি আবাদ করে। এসব দেখভালে উপজেলা পর্যায়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বা পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন জনবলও নেই। জেলা পর্যায়ে নির্বাহী প্রকৌশলী ও জোনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর কার্যালয় থেকে ইউনিয়ন কিংবা উপজেলা পর্যায়ের বেড়িবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
তাছাড়া বিভিন্ন কারণে বেড়িবাঁধের যে ক্ষতি সাধিত হয়, তা মেরামতের জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো বরাদ্দ নেই। ফলে বেড়িবাঁধ তৈরির পর তা আছে কি নেই, তাও অনেক ক্ষেত্রে বলতে পারেন না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। শুধু বন্যার কারণে কোথাও পানি ঢুকে বড় ধরনের কোনো ক্ষতি সাধিত হলে কয়েকদিন আলোচনা-সমালোচনা হয়। তারপর যেই-সেই অবস্থা। তখন কারও আর মাথাব্যথা থাকে না। এছাড়া ডিজিটালি অফিসে বসে বাঁধের বর্তমান অবস্থা মনিটরিং করার কোনো ব্যবস্থা নেই। মনিটরিং পদ্ধতি আধুনিকায়ন করা হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বেড়িবাঁধের মাটি রোলার দিয়ে ভালোভাবে চাপা দেওয়া হয় না। পাউবির কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার কেউ থাকে না। কারণ, যে এলাকায় বেড়িবাঁধ তৈরি করা হয়, ওই এলাকার সংসদ-সদস্যের লোকরা বেড়িবাঁধের মাটি ভরাটের কাজ পায়। সুতরাং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কাজের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো নজির নেই। বরং ঠিকাদার কাজ না করে বিল নিতে চাইলে তা আটকে গেলে সেই বিল ছাড়করণের তদবির নিয়ে আসেন কোস্টাল বেল্টের সংসদ-সদস্যরা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডে কর্মরত একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, আমরা যে ডিজাইনে বেড়িবাঁধ তৈরি করতে বলি, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমলেই নেওয়া হয় না। প্রতিটি লেয়ারে রোলার দিয়ে মাটি ভালোভাবে বসিয়ে বাঁধ তৈরি করার ডিজাইন দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, উপকূলের প্রভাবশালীরা নদী থেকে বালু উত্তোলন করে বেড়িবাঁধের নিচ দিয়ে পাইপ ঢুকিয়ে ড্রেজিং করে।
তাদের বাধা দেওয়ার সাধ্য কারও নেই। ড্রেজিং বন্ধ করার পর বেড়িবাঁধের নিচ দিয়ে পাইপ ঢুকানোর গর্ত ভরাট করে না। ফলে অতিবর্ষণ ও জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবে বাঁধ ভেঙে এলাকার পর এলাকা প্লাবিত হয়।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, একসময় দেশে বেড়িবাঁধের জন্য জমি অধিগ্রহণ ছিল খুবই সহজ কাজ। তখন অনেকে বেড়িবাঁধের জন্য বিনামূল্যে জমি দান করত। এখন আর সেই দিন নেই। এখন অধিগ্রহণ করে বেড়িবাঁধ তৈরি করতে হয়। বিপুল পরিমাণ জমি অধিগ্রহণের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রে সরকারের থাকে না। ফলে যে ধরনের গুণমানসম্পন্ন বেড়িবাঁধ অতীতে হয়েছে, এখন জায়গাজমির অভাবে তা গড়ে তোলা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উপকূলের বেড়িবাঁধের নদীর সাইড এবং লোকালয়ের মানুষের মধ্যে এক ধরনের রেষারেষি থাকে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অনেক সময় রাতের আঁধারে বাঁধ ফুটো করে দেয় একটি পক্ষ। ফলে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় ভেতরের অংশের জনপদ। জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. মোহসিন যুগান্তরকে বলেন, বেড়িবাঁধ তৈরির পর তা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। বেড়িবাঁধের ওপর গাছ লাগানো হয়। গাছের শিকড় যতদূর যাবে, ততদূর পর্যন্ত দ্রুত পানি ঢুকে পড়বে। দেখভালের জন্য কোনো জনবল নেই। মেরামত হয় না বছরের পর বছর। বন্যা-জলোচ্ছ্বাসের ফলে ক্ষয়ক্ষতি হলে কিছুদিন আলোচনা হয়, তারপর যেই-সেই। এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার।