তীব্র ডলার সংকট ও বিদ্যুতের বিশাল বকেয়া পরিশোধে হিমশিম খেলেও আরও ৬টি উচ্চ মূল্যের তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের (রেন্টাল) মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতের বকেয়া ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
জানা গেছে, উচ্চ দামের ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ৬টি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ আরও ৫ বছর বাড়ানোর প্রক্রিয়া এখন শেষ পর্যায়ে। যে কোনো সময় এ সিদ্ধান্ত অনুমোদন হওয়ার কথা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে আভাস পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে সরকারের খরচ হয় ১৬ থেকে ১৮ টাকা। মেয়াদ বাড়ানোর কারণ সম্পর্কে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রিডের ফ্রিকোয়েন্সি ঠিক রাখতে এ কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি সেচ মৌসুম ও গ্রীষ্ম মৌসুমের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে এ কেন্দ্রগুলোর প্রয়োজন আছে।
তবে জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ মূল্যের ফার্নেস অয়েল নির্ভর রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য ফ্রিকোয়েন্সির যে কথা বলা হচ্ছে, তা সঠিক নয়। রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট আসার আগেও গ্রিড এবং ফ্রিকোয়েন্সি ছিল। মূলত সরকার সমর্থিত বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের খুশি করতেই এই ৬টি রেন্টালের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে ৬টি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাবের একটি সার-সংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসাবেও দায়িত্ব পালন করছেন। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। রেন্টাল এই ছয়টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলো-সামিট নারায়ণগঞ্জ পাওয়ার লিমিটেডের মদনগঞ্জ ১০২ মেগাওয়াট, ওরিয়ন পাওয়ার মেঘনাঘাট লিমিটেডের মেঘনাঘাট ১০০ মেগাওয়াট, ডাচ-বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের সিদ্ধিরগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট, খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের নোয়াপাড়া ৪০ মেগাওয়াট ও খুলনা ১১৫ মেগাওয়াট এবং একর্ন ইনফ্রাস্ট্রকচারার সার্ভিসেস লিমিটেডের জুলদা ১০০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে মদনগঞ্জ ১০২ মেগাওয়াট বিদ্যুকেন্দ্রের মেয়াদ ২২ মার্চ শেষ হয়েছে। মেঘনাঘাট ১০০, সিদ্ধিরগঞ্জ ১০০, নেয়াপাড়া ৪০ এবং খুলনা ১১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২৩ মার্চ এবং জুলদা ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হয়েছে ১৬ এপ্রিল। বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি রক্ষা, রিলাইবিলিটি বৃদ্ধি এবং ট্যারিফ তুলনামূলক কম হওয়ায় কিছু কিছু রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ ভিত্তিতে বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ৭৫৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৯টি এবং গ্যাসভিত্তিক ৫৫৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে।
এদিকে অভিযোগ আছে পিডিবির একটি সিন্ডিকেট কম খরচের বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে উচ্চ ব্যয়ের ফার্নেস তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বেশি চালাচ্ছে। অথচ তেল ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় অন্য জ্বালানির তুলনায় তিন গুণের বেশি। এই অনিয়ম করতে গিয়ে ওই সিন্ডিকেট কৌশলে বসিয়ে রাখছে গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার বড় একটি অংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি তেল আমদানি করতেও ডলার লাগে। সেই ডলার দিয়ে গ্যাস ও কয়লা আমদানি করা যায়। তাদের মতে, বেসরকারি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সুবিধা দিতে সেগুলো থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয়। এ কারণে সরকারি ফার্নেস তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও কম চালানো হয়। এসব কেন্দ্রে সক্ষমতার মাত্র ১২ থেকে ১৪ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। কিন্তু বেসরকারি ফার্নেস তেলচালিত কেন্দ্রের সক্ষমতা ব্যবহার করা হয় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ। অথচ পিডিবির বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বেশিরভাগ সময় অলস বসিয়ে রাখা হচ্ছে। এছাড়া কিছু কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বসিয়ে বসিয়ে বিপুল অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ দিচ্ছে সরকার। বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশ্লেষণ বলছে, গত বছর সক্ষমতার ৪১ শতাংশ অলস ছিল। এদিকে গত অর্থবছরে ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ দিতে হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন-গ্যাস, কয়লা ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র চালালে এবং ভারত থেকে আমদানি করলে উচ্চ ব্যয়ের তেলভিত্তিক কেন্দ্র চালানোর প্রয়োজনই হয় না। এতে ব্যয় অনেক কমে যাবে। দেশে আরও গ্যাস উত্তোলনের সুযোগ রয়েছে। সেই প্রচেষ্টা বাড়িয়ে দ্রুততম সময়ে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো দরকার। তাহলে ডলারের ওপর চাপও কমবে।