চলতি অর্থবছরে ৪টি প্রকল্পের উদ্বোধন করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয়ের প্রকল্প পদ্মা রেল সংযোগ। তারপর যথাক্রমে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, খুলনা-মোংলা ও আখাউড়া-আগরতলা রেললাইন প্রকল্প। এসব প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এত ব্যয় বহুল প্রকল্প উদ্বোধন হলেও এতে ট্রেন চলছে মাত্র ৭টি। এরমধ্যে ভারতের সঙ্গে দেশের রেলকে যুক্ত করা আখাউড়া-আগরতলা রুটে একটি ট্রেনও চলছে না। আর ট্রানজিট সুবিধার আওতায় ভারত, নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহন সহজ করতে চালু হওয়া খুলনা-মোংলা রুটে ট্রেন চলছে একটি। এ ছাড়া ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনে দু’টি ও ৩৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পে ট্রেন চালু রয়েছে ৪টি। রেল সূত্র বলছে, রেললাইন চালুর পর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সংকটের কারণে এসব জায়গায় ট্রেন বাড়ানো যাচ্ছে না।
আখাউড়া-আগরতলা আন্তঃসীমান্ত ডুয়েলগেজ রেলপথটি প্রায় সাড়ে ১২ কিলোমিটার। এরমধ্যে বাংলাদেশ অংশ পড়েছে ৬ দশমিক ৭৮ কিলোমিটার, বাকিটা ভারতীয় অংশে।
এতে ব্যয় হয়েছে ৪৭৭ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি অঙ্গরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে বলে জানিয়েছিলেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। গত বছর ১লা নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে এই রেলপথটি উদ্বোধন করেন। তবে এই রুটে এখন একটি ট্রেনও চলছে না। রেলওয়ে সূত্র বলছে, এই রুটে এখনো ট্রেনের চাহিদা তৈরি হয়নি। প্রকল্প পরিচালক আবু জাফর মিঞা বলেন, আমাদের রেললাইন প্রস্তুত আছে। ট্রেন চালানো দুই দেশের সরকারের বিষয়।
ট্রানজিট সুবিধার আওতায় ভারত, নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহন সহজ করতে ২০১০ সালে হাতে নেয়া হয় খুলনা-মোংলা রেলপথ প্রকল্প। শুরুতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ ৩ বছর থাকলেও তা দফায় দফায় বাড়তে থাকে। পরে ১৪ বছর পর চলতি বছর ১লা জুন প্রকল্পটি উদ্বোধন করা হয়। ৯১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এই রেলপথের নির্মাণ ব্যয় শুরুতে ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকা থাকলেও পরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। বর্তমানে এই রেললাইনে ‘বেতনা এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি নাম পরিবর্তন করে ‘মোংলা কমিউটার’ নামে চলছে। মূলত এই লোকাল ট্রেনটি খুলনা থেকে যশোর হয়ে বেনাপোল পর্যন্ত চলাচল করে। বেনাপোল থেকে ফেরার পথে খুলনার ফুলতলা জংশন থেকে নাম পরিবর্তন করে মোংলা কমিউটার নামে চলছে। খুলনা-মোংলা রেললাইন প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী আহমেদ হোসেন মাসুম বলেন, এই রেললাইনের ফলে মোংলা বন্দর রেলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এখানে বর্তমানে একটি ট্রেনই চলছে।
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার রেলপথ গত বছর ১১ই নভেম্বর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনিই ২০১১ সালে প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তবে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০১৮ সাল থেকে। অর্থাৎ অনুমোদনের ১৩ বছর পর প্রকল্পটি উদ্বোধন হয়। এর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে নেটওয়ার্কের ৪৮তম জেলা হিসেবে যুক্ত হয় কক্সবাজার। প্রকল্পটিতে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। প্রকল্পের জন্য কক্সবাজার জেলায় ১ হাজার ৩৬৫ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে ৯টি রেলওয়ে স্টেশন, ৪টি বড় ও ৪৭টি ছোট সেতু, ১৪৯টি বক্স কালভার্ট ও ৫২টি রাউন্ড কালভার্ট। বর্তমানে কক্সবাজার এক্সপ্রেস ও পর্যটক এক্সপ্রেস নামে দুটি ট্রেন চলছে এই রেললাইনে। তবে যাত্রীদের তীব্র চাপ রয়েছে এই রুটে। প্রকল্প পরিচালক মো. সুবক্তগীন মানবজমিনকে বলেন, আমাদের সিগনালিংয়ের কিছু কাজ বাকি আছে। জুলাই-আগস্টের মধ্যে তা শেষ হয়ে যাবে। আমাদের এখানে রেলের অনেক চাহিদা রয়েছে। এখানে রেলের আয়ও বেশি। এ ছাড়া সবচেয়ে বেশি কোচ নিয়ে ট্রেন চলছে এই রুটে।
পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেলপথ। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগের নতুন দ্বার এই রেলপথ। প্রকল্পটিতে ব্যয় ধরা হয় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে ভিত্তিপ্রস্তর হওয়া এই রেলপথ এখনো নির্মাণাধীন রয়েছে। তবে গত বছর ১০ই অক্টোবর নির্মাণাধীন পদ্মা রেল সেতু (আংশিক) উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্তমানে ঢাকা থেকে ভাঙা পর্যন্ত ৮১ কিলোমিটার পথ দিয়ে ট্রেন চলাচল করছে। বেনাপোল, সুন্দরবন, মধুমতী এক্সপ্রেস ও ভাঙ্গা কমিউটার নামের ৪টি ট্রেন চলাচল করছে এই রুটে। রেল সূত্র জানায়, পদ্মা রেল সংযোগ কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, যশোর পর্যন্ত অনেক চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে এই রুটে আরও ৪ থেকে ৬টি ট্রেনের চাহিদা রয়েছে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ কাজী সাইফুন নেওয়াজ মানবজমিনকে বলেন, এসব জায়গায় ট্রেন চলাচল আরও বৃদ্ধি করা উচিত। চট্টগ্রামে একটা বিশেষ ট্রেন বন্ধ হয়েছে। সেখানে আরও ট্রেন চালানো প্রয়োজন। নতুন লাইনে ট্রেন চালানোর জনবল আছে কিনা, তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ট্রেন চালানোর ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ানো, রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিট স্থাপন করা দরকার।
বাংলাদেশ রেলের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী মানবজমিনকে বলেন, আমাদের ভারতের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। ২০০ ব্রডগেজ কোচ আসছে। ইন্দোনেশিয়া থেকে ৩৮টা কোচ আসছে। ইঞ্জিনও আসছে। তখন আমরা পর্যাপ্ত ট্রেন চালু করবো। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক মানবজমিনকে বলেন, এগুলো হলো বিলাসী উন্নয়ন বা বেহিসেবি উন্নয়ন। যে উন্নয়নের পর ট্রেন চালাতে গেলে ট্রেন কিনতে হয়, রোলিং স্টক কিনতে হয়। যে প্রকল্প শেষ হওয়ার পর লোকবল পাওয়া যায় না। স্টেশন অপারেশন করা যায় না, চুরি হয়, সিগন্যাল অপারেশনে লোক থাকে না। এটা কখনো উন্নয়ন হতে পারে না।
তিনি বলেন, এত হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের সময় বলা হয়েছিল, জনসুযোগ তৈরি হবে, মানুষের গতিশীলতা বাড়বে, উপযোগিতা তৈরি হবে। এটা হওয়ার জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন একটা মাত্র অংশ। কিন্তু মানবসম্পদ যদি না পায় তাহলে রেলকে এটার জবাবদিহি করতে হবে। অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় রোলিং স্টক, লোকোমোটিভ, বগি এবং এসব পরিচালনার জন্য লোকবল দরকার। রেল মন্ত্রণালয় যদি এখন ভর্তুকির মধ্যে চলে যায় তাহলে বুঝতে হবে তাদের দর্শনের মধ্যে যথেষ্ট ঘাটতি আছে।