আমাদের কপালে অনেক দুঃখ আছে, আছে দুর্দশাও। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন গভীর সংকটে। এ সংকটের অচিরেই সমাধান হবে, এমনটি মনে করছেন না দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা। গত কয়েক বছর ধরে, বিশেষ করে গত দু’বছরে যে হারে মূল্যস্ফীতি হয়েছে, তাতে নাভিশ্বাস উঠেছে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্রদের। নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমনই অবস্থা বিরাজ করছে নিম্ন আয় ও দুর্বল শ্রেণির মানুষদের জীবনে। যে দুর্দশাগ্রস্ত শ্রেণিগুলোর উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের কেউই বাজারে বিদ্যমান অগ্নিমূল্যের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। সরকারিভাবে যদিও বলা হচ্ছে মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি, বাস্তবে এ হার আরও অনেক বেশি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য পর্যালোচনা করলে বুঝতে কষ্ট হয় না মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। সরকারের পরিসংখ্যান বিভাগ দেখাতে চায় ঘটনা যাই হোক, মূল্যস্ফীতি এখনো দুই ডিজিট হয়নি। পরিসংখ্যান মেনিপুলেট করে আত্মতৃপ্তি পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু মানুষের মন ভোলানো যায় না। সাম্প্রতিককালে মূল্যস্ফীতির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে উদ্বেগজনক তথ্য বেরিয়েছে। এ তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, ফুড প্রাইস ইনফ্লেশন নন ফুড প্রাইস ইনফ্লেশনের তুলনায় বেশি। এ থেকে বোঝা যায়, দেশের গরিব মানুষ যাদের জন্য খাদ্যসামগ্রী জোগাড় করাই প্রধান বিবেচ্য, তারা খাদ্যসামগ্রী আগের মতো জোগাড় করতে পারছেন না। সাধারণ মানুষের এই ভয়াবহ অবস্থা বলে দেয় বাংলাদেশের উন্নয়নের চাকচিক্য সাধারণ মানুষের জীবনে কোনোরকম স্বস্তির উদ্রেক ঘটাতে পারেনি।
এ সপ্তাহে মঙ্গলবারের সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, চলমান অর্থনৈতিক সংকট আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা করেছেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি ভঙ্গুর ও অস্থিতিশীল অবস্থায় থাকলেও সরকার সংস্কারের পথে হাঁটছে না। দেশ থেকে পুঁজি পাচার হচ্ছে: ব্যাংক খাত রয়েছে বিশৃঙ্খল অবস্থায়। ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় বেড়েই চলেছে: কিন্তু এ পরিস্থিতির মধ্যেও সরকার-ঘনিষ্ঠ একটি গোষ্ঠী অন্যায় সুবিধা পাচ্ছে।
শীর্ষস্থানীয় এ অর্থনীতিবিদরা আরও মনে করেন, প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থনীতির চলমান সংকট মোকাবিলায় তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। বাজেটে সাধারণ করদাতা ও পরিশ্রমী উদ্যোক্তাদের সুবিধা দেওয়া হয়নি। সুবিধা পেয়েছে কালো টাকার মালিকরা।
গত সোমবার নিউজ পেপারস্ ওনার অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (নোয়াব) ও সম্পাদক পরিষদ কর্তৃক যৌথভাবে আয়োজিত ‘অর্থনীতির চালচিত্র ও প্রস্তাবিত বাজেট ২০২৪-২৫’ শীর্ষক আলোচনা সভায় অর্থনীতিবিদরা এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা যা বলেছেন, তা তুলে ধরতে চাই। ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘ক্রমেই আমরা নৈতিকতাহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছি। দুর্নীতি-অনিয়মের বড় উৎস হলো ক্ষমতার রাজনীতি। এর মূল ভিত্তি হলো এখানে বিভিন্ন অনুগত স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে অন্যায় সুবিধা দেওয়া হয়।’ তার মতে এ রকম পরিস্থিতিতে সম্পদের বৈষম্য বাড়ে, অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে এবং বিনিয়োগের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সৎ করদাতারা বঞ্চিত হন। তিনি আরও বলেন, ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণহীন। প্রশাসনে দুর্নীতি আছে। অর্থনীতিতে নেই আস্থার পরিবেশ। অবাধে কালো টাকার সঞ্চালন হচ্ছে, পাচার হচ্ছে টাকা। এ সমস্যা আগে থেকেই ছিল; কিন্তু তা ঢাকা ছিল। এখন এসব সমস্যা বেরিয়ে আসছে। তিনি আরও বলেছেন, করনীতি দেখে মনে হচ্ছে দুর্বল করদাতারাই এখন লক্ষ্যবস্তু। বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি, যদিও অনেকদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। মোবাইল ফোন সেবাকে কর সংগ্রহে সহজ উপায় হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে। সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। কিন্তু স্মার্ট মানুষ নীতিহীন হলে ভয়ংকর পরিস্থিতি হয়। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে অনুগত ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী অন্যায় সুবিধা পাচ্ছে। তিনি বাজেটকে ‘যূপকাষ্ঠে বাধা পশুর’ সঙ্গে তুলনা করেছেন। তার মতে, অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে বাজেট সংকোচনের বিকল্প নেই। তিনি আরও বলেছেন, ‘এতদিন ধরে যে পথে এসেছি, সেই পথের পরিবর্তন না হলে ঈপ্সিত গণতন্ত্রে পৌঁছানো যাবে না।’
অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের মতে, অর্থমন্ত্রী তিন গোষ্ঠীর কথা শুনেছেন। এগুলো হলো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), অলিগার্ক ও আমলা। যাদের কথা তিনি শোনেননি, তারা হলো পরিশ্রমী উদ্যোক্তা ও পরিশ্রমী কর্মী। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের মতে, বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকারের ব্যাংক ঋণনির্ভরতা বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বেসরকারি খাত ঋণ না পেলে কর্মসংস্থান হবে কীভাবে? খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, আপনি ব্যাংক থেকে ঋণ নেবেন, আর ফেরত দেবেন না-দেশে এখন এ মডেল চলছে। খেলাপি ঋণের এ মডেলই এখন দেশের বিজনেস মডেল। তিনি আরও বলেন, ব্যাংক খাতের অবস্থা মর মর এবং এ খাতে সুশাসনে চরম ঘাটতি চলছে। প্রস্তাবিত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার যে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে, তা উচিত হয়নি বলে মনে করেন সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, এ মুহূর্তে এডিপির আকার ১ থেকে দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি করার দরকার ছিল না।
দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করার তেমন কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। জাতীয় অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে হলে এসব অর্থনীতিবিদের মতামতকে আমলে নিতে হবে। সমস্যা পর্বতপ্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা থেকে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। অন্যদিকে সর্বাত্মকভাবে কঠোর পদক্ষেপ নিলেও হীতে বিপরীত হতে পারে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ব্যবস্থার পতনের পর রাশিয়ার অর্থনীতি চরম বেহাল অবস্থার মধ্যে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে রাশিয়ার জিডিপি ৫০ শতাংশ হ্রাস পায়। এমন পরিস্থিতিতে আইএমএফের পরামর্শদাতারা ‘শক থেরাপি’ প্রয়োগের পরামর্শ দেন। পরিস্থিতি শক থেরাপির ফলে আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। রাশিয়ার পরিস্থিতি অবশ্য ভিন্ন ছিল। দেশটি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে হঠাৎ করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অর্থনৈতিক কাঠামো ও প্রতিষ্ঠান সেই সময় রাশিয়ায় ছিল না। ফলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাও সহজে দানা বেঁধে উঠছিল না। অর্থনীতিতে দেখা দেয় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য। এর সুযোগে রাতারাতি অলিগার্ক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। রাশিয়া আজও অলিগার্কদের হাত থেকে মুক্ত হতে পারেনি।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি রাশিয়ার সঙ্গে তুলনীয় নয়। এখানে সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনজনিত সমস্যার উদ্ভব হয়নি। বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার গর্ভেই বৈকল্যের সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং এ বৈকল্য থেকে কিভাবে মুক্ত হওয়া যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে।
অর্থনীতিকে ঘুণপোকার মতো খেয়ে ফেলছে সরকারের সুদ ব্যয়। প্রতিবছর দেশি-বিদেশি উৎস থেকে নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। যত বছর গড়াচ্ছে, সুদের ব্যয় দাঁড়াচ্ছে গগনচুম্বি! সরকারের মধ্যমেয়াদি হিসাব থেকে জানা যায়, আগামী ৩ অর্থবছরে সরকারকে সুদ ব্যয় মেটাতে খরচ করতে হবে ৪ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে দেড় বছরের বেশি উন্নয়ন ব্যয় মেটানো সম্ভব। আগামী অর্থবছরে এডিপি ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এর ভিত্তিতেই বলা হচ্ছে আগামী তিন অর্থবছরে সুদ পরিশোধ বাবদ যে অর্থ ব্যয় করতে হবে, তা দিয়ে দেড় বছরের এডিপি ব্যয় মেটানো সম্ভব। তিন বছরের সুদ বাবদ যে অর্থ ব্যয় হবে, তা দিয়ে ১২টির চেয়েও বেশি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। উল্লেখ্য, পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা।
সুদ ব্যয়ের এ চিত্র উঠে এসেছে অর্থ বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি-২০২৪-২৫ থেকে ২০২৬-২৭’ এর মাঝে। এই নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আগামী ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সুদখাতে ব্যয় করতে হবে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে নেওয়া সুদ ব্যয় ৯৩ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। একইভাবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সুদ ব্যয় বেড়ে হবে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ সুদ ব্যয় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি সুদ ব্যয় হবে ২৩ হাজার কোটি টাকা। ২০২৬-২৭ অর্থবছরে তা আরও বৃদ্ধি পেয়ে হবে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে দেশি সুদ ব্যয় হবে ১ লাখ ২৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং বিদেশি সুদ ব্যয় হবে ২৬ হাজার কোটি টাকা। মধ্যমেয়াদি এ হিসাব থেকে বোঝা যায় আগামী বছরগুলোতে সরকারের সুদ ব্যয় বাড়তেই থাকবে। ২০২১ অর্থবছরে সুদ ব্যয় ছিল ৭৭ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। সেখানে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে তা বেড়ে হবে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাজেট ব্যয়ের হিস্যা হিসাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে সুদ ব্যয় ছিল ১৫.৩ শতাংশ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই হার ১২.৪ শতাংশে নেমে আসে। তবে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে এ হিস্যা ১৫.৩ শতাংশে বাড়তে পারে।
সব মিলিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশ কি ঋণের ফাঁদে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে? কোনো দেশ একবার ঋণের ফাঁদে পড়লে তা থেকে বের হয়ে আসার ধকল ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। স্পষ্টতই সরকারের নীতিতে বিচক্ষণতার চরম ঘাটতি দেখা যায়।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ