কোরবানি এলেই ভারত ও মিয়ানমারের দিকে তাকিয়ে থাকত বাংলাদেশ। বিশেষ করে ভারতীয় গরু ছাড়া বাংলাদেশে কোরবানির পশুর হাট ছিল অকল্পনীয়। প্রতিবেশী দেশ দু’টি থেকে গরু না এলে কিংবা কম এলে বড় প্রভাব পড়ত কোরবানির হাটে। চড়া দামে কোরবানির গরু কিনতে হতো। এক দশক আগে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে গরু আসা বন্ধ হয়ে যায়। চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশে বাড়ে গবাদিপশু পালন। দেশে এখন ছোট-বড় মিলিয়ে ২০ লাখ খামার রয়েছে। তৈরি হয়েছে অসংখ্য শিক্ষিত উদ্যোক্তা। গত কয়েক বছর হলো গবাদিপশুতে স্বয়ংসম্পর্ণূতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। দেশে এবার কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা এক কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭, যা চাহিদার চেয়ে প্রায় ২৩ লাখ বেশি। এ সংখ্যা গত বছরের চেয়েও চার লাখ ৪৪ হাজার ৩৪টি বেশি। দেশেই যখন গবাদিপশু উদ্বৃত্ত তখন সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে দেদার ঢুকছে গরু।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর হাটে এখন ভারত ও মিয়ানমারের গরুতে ভরপুর। কোনো কোনো হাটে তো আবার দেশী গরুর চেয়ে বিদেশী গরুর সংখ্যাই বেশি। গবাদিপশুতে বাংলাদেশে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আসার পর গত কয়েক বছরে এভাবে দেদার ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে গরু আসেনি। খামারি সংগঠনের নেতারা বলছেন, কোরবানি ঈদের আগে সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। কিন্তু এবার সীমান্ত অনেকটাই ঢিলেঢালা। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনের লোকজন দেখেও যেন না দেখার ভান করছেন। এতে যেমন বাংলাদেশে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি এসব গরুর সাথে নানা রোগবালাইও ঢুকছে, যা দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ডেইরি খাতে।
জানা যায়, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি; কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া, রামু, চকরিয়া; সিলেট, কুমিল্লা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রামসহ দেশের ৩৮টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ভারত ও মিয়ানমার থেকে গবাদিপশু ঢুকছে। স্থানীয়রা বলছেন, রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তাসহ অনেকেই এই চোরাই সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত।
খামারিরা বলছেন, এক দিকে পশুখাদ্যের উচ্চমূল্য, তীব্র তাপদাহে বাড়তি যতে্নর জন্য বেশি উৎপাদন খরচ এবং ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে এমনিতেই খামারিরা ভালো নেই। এ অবস্থায় চোরাই পথে অবাধে গরু ঢোকায় পথে বসার উপক্রম খামারিদের। বিশেষ করে ক্ষুদ্র খামারিরা পড়েছেন মহাবিপাকে। তাদের অভিযোগ, ২০১৪ সালের নিষেধাজ্ঞার পর এবারের মতো এত খোলামেলাভাবে সীমান্ত দিয়ে গরু ঢোকেনি।
দেশের সীমান্ত এলাকার স্থানীয়দের সূত্রে জানা যায়, মূলত চোরকারবারিরা গরু পারাপারের জন্য গভীর রাতকে বেছে নিয়েছে। রাতের আঁধারে কাপড়ে মুখ ঢেকে হাতে লাঠি নিয়ে রাখালের ভূমিকা পালন করছেন। অবাধে গরু আসাতে খামারিদের মাথায় হাত পড়লেও ঈদের আগেই যেন ঈদ লেগেছে চোরাকারবারিদের।
প্রাণিসম্পদ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে গত মাসখানেক ধরে সীমান্ত দিয়ে গরু ঢুকছে। ঈদ যত ঘনিয়ে এসেছে বানের পানির মতো নদী সাঁতরিয়ে কিংবা বনজঙ্গল দিয়ে ঢোকানো হচ্ছে গরু। সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে আসা গরুতে স্থানীয় বিভিন্ন খামারের পশুর শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে নানা রোগবালাই। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে বৈধ পথে পশু আনতে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। অথচ চোরাই পথে আসা গরুর শরীরে রোগ আছে কি না, তা জানার সুযোগ নেই। এতে দেশের প্রাণিসম্পদ খাতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হতে পারে। দেশজুড়ে অজানা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে তা সামাল দেয়া কঠিন হবে। চোরাই পথে আসা পশু মানব স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি বয়ে আনতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, ৫৫ হাজার খামারি আমাদের সংগঠনের সদস্য। অনেক দিন ধরে আমাদের সদস্যরা তথ্য দিয়ে বলছেন, বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে হাজার হাজার গরু ঢুকছে। হঠাৎ করে উত্তরবঙ্গসহ বিভিন্ন এলাকায় দেশী গরুতে রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। লাম্পি স্কিন (এলএসডি) রোগে হাজার হাজার গরু আক্রান্ত হচ্ছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো: আব্দুর রহমান বরাবরই বলে আসছিলেন দেশে পর্যাপ্ত কোরবানির গরু রয়েছে। তাই আমদানির কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা আমদানির অনুমোদনও দেবো না। অনুমতি দেয়াও হয়নি। কিন্তু এরপরও সীমান্ত দিয়ে অনেকটা প্রকাশ্যেই গরু ঢুকছে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় খামারিরা। এ অবস্থায় গত ৯ জুন সাভারে একটি অনুষ্ঠান শেষে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রহমান বলেন, রাষ্ট্র কোনোভাবেই কাউকে পশু আমদানি করার অনুমতি দেয়নি। তবে রাতের অন্ধকারে কী ঘটছে সেটি ঠেকাবেন কী করে? সীমান্ত রক্ষা বাহিনী তার চেষ্টা করছে। আমরা সামাজিক ক্যাম্পেইন করছি, সব প্রস্তুতিও নিয়েছি। তবে চোরাই পথে দেশে পশু ঢুকলে কিছু করার নেইথ।