কমলাপুর। দেশের প্রধান রেলস্টেশন। রেল যোগাযোগব্যবস্থার কেন্দ্রস্থল। কিন্তু কমলাপুরে ঢুকলে রেলওয়ের হতশ্রী চেহারা ছাপিয়ে লাগামহীন লুটপাটের ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে। স্টেশনের বিশাল চত্বরজুড়ে অনিয়ম-দুর্নীতির দগদগে ক্ষত। অনেকটা বেওয়ারিশ লাশের মতো এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাত্রীসেবার নানা উপকরণ। ইতোমধ্যে স্টেশন থেকে উধাও হয়ে গেছে কোটি টাকার সরকারি সম্পদ।
অদৃশ্য জাদুমন্ত্রবলে রাতারাতি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে স্বয়ংক্রিয় টিকিট ভেন্টিং মেশিন, ডিজিটাল ইনফরমেশন বুথ, এলইডি কোচ লোকেটর এবং টিভি মনিটর। এমনকি মনিটর আটকানোর লোহার গ্রিল পর্যন্ত খুলে নেওয়া হয়েছে। প্রকাশ্যে লোপাট হচ্ছে এসি, ফ্যান ও লাইটসহ নিত্যব্যবহার্য উপকরণ। বাদ যায়নি হুইল চেয়ার, ট্রলি, আসবাবপত্র বা অফিস সরঞ্জাম। যুগান্তরের সপ্তাহব্যাপী সরেজমিন অনুসন্ধানে কমলাপুর রেলস্টেশনের এমন করুণ চিত্র উঠে আসে।
অবাধ লুটপাট : সদ্য চালু হওয়া পর্যটক এক্সপ্রেসের একটি এসি কোচ (নম্বর ২৫০২) পড়ে আছে ৭ নম্বর প্ল্যাটফর্ম ঘেঁসে। দুপাশের দরজাই খোলা। ফলে ভেতরের প্রায় সব সরঞ্জাম ইতোমধ্যে লোপাট হয়ে গেছে। কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে বগির খোলস। অথচ অত্যাধুনিক সুবিধাসম্পন্ন এসব কোচের এক-একটির মূল্য ছয় কোটি টাকার বেশি। কোচ ছাড়াও আরও অনেক বহু মূল্যবান রেলসামগ্রী খোলা আকাশের নিচে পড়ে থেকে ভাঙ্গারি হওয়ার পথে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, যাত্রীসেবার নামে কিছুদিন আগে আকস্মিক স্টেশনে বসানো হয় স্বয়ংক্রিয় টিকিট ভেন্টিং মেশিন। কিন্তু এর সেবা পাওয়া যায়নি। বছর না ঘুরতেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায় সবগুলো যন্ত্র। এছাড়া ঢাকঢোল পিটিয়ে প্ল্যাটফর্মে লাগানো হয় ডিজিটাল কোচ লোকেটর। কিন্তু একদিনের জন্যও টিভি মনিটর চালু হয়নি। পরে মনিটর আটকানোর লোহার খাঁচাও খুলে নেওয়া হয়। অবশিষ্ট যা আছে তা এখন বিপজ্জনকভাবে ঝুলছে যাত্রীদের মাথার ওপর।
লোহার খাঁচা : অজ্ঞাত কারণে স্টেশনে ঢোকার মুখেই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে। প্রধান দুটি ফটকে দেওয়া হয়েছে অপরিকল্পিত লোহার খাঁচা। এতে যাত্রীদের ভোগান্তি বেড়েছে কয়েকগুণ। কারণ সংকীর্ণ খাঁচা পথ দিয়ে কোনোমতে একজন যাত্রী পার হতে পারলেও আটকে যায় মালামাল। এ সময় ফটকের দুপাশেই যাত্রীদের দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়। এছাড়া খাঁচার কারণে স্টেশন এলাকায় স্বচ্ছন্দে চলাচল করাও কঠিন। কিন্তু কমলাপুরে এসব দেখার কেউ আছে কি না সে প্রশ্ন যাত্রীদের।
স্টেশনের প্রবেশপথে এমন লোহার খাঁচা দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার (ডিআরএম) সফিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, টিকিটবিহীন যাত্রী ঠেকাতে পরীক্ষামূলকভাবে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু এতে যাত্রীসাধারণের অসুবিধা হলে স্টিলের কাঠামো সরিয়ে নেওয়া হবে। শিগগিরই স্টেশন এলাকা সরেজমিন পরির্দশন করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
হয়রানি ডেস্ক : স্টেশনের ৩ নম্বর প্ল্যাটফর্ম ঘেঁষে পাশাপাশি দুটি বাহিনীর বিশেষ ‘হেল্প ডেস্ক’। একটি রেল পুলিশের (জিআরপি)। অন্যটি রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি)। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে দুটি ডেস্কই বেশির ভাগ সময় থাকে ‘ফাঁকা’। ফলে যাত্রীসেবায় তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। বরং উলটো এ দুটি ডেস্কে দায়িত্ব পালনকারীদের বিরুদ্ধে যাত্রী হয়রানির অভিযোগ পুরোনো।
বুধবার দুপুর ২টা। যথারীতি ফাঁকা জিআরপি ডেস্ক। এ সময় টেবিলে ছেঁড়াফাটা তেল চিটচিটে একটি রেজিস্টার খাতা পাওয়া যায়। এতে কয়েকজন যাত্রীর মালামাল হারানোর কয়েকটি সংবাদ লেখা। কিন্তু পানিতে ভিজে যাওয়া খাতার পাতায় পাতায় শব্দগুলো লেপ্টে গেছে কালিতে। সঙ্গত কারণে অভিযোগকারীর নাম-নিশানা বলতে কিছুই নেই।
পাশের আরএনবি ডেস্কেও দায়িত্বরত কাউকে পাওয়া গেল না। তবে সেখানে কয়েকজন উদ্বিগ্ন যাত্রীর জটলা। এদের মধ্যে কেউ জানতে চান ট্রেনের সময়সূচি। কেউ বা প্ল্যাটফর্মে মোবাইল ফোন বা ব্যাগ হারিয়েছেন। আজিজুল ইসলাম নামের এক যাত্রী যুগান্তরকে বলেন, যাত্রী সহায়তার নামে এখানে দুটি লোক দেখানো ডেস্ক খোলা হলেও বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। সংশ্লিষ্টদের অনেকেই আসল কাজ ফেলে থাকেন উপরি আয়ের ধান্ধায়। এমনকি তল্লাশির নামে ডেস্কের কাছে যাত্রীদের ধরে এনে অহেতুক হয়রানি করা হয়। অনেক সময় ভয় দেখিয়ে কেড়ে নেওয়া হয় নগদ টাকা, মোবাইল ফোনসহ মূল্যবান সামগ্রী।
তবে যাত্রী হয়রানির এমন অভিযোগ মানতে নারাজ সংশ্লিষ্ট বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। জানতে চাইলে জিআরপি’র ঢাকা রেলওয়ে জেলার পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন রোববার যুগান্তরকে বলেন, চোরাচালান প্রতিরোধে মাঝে মাঝে যাত্রীদের দেহ তল্লাশি করা হয়। তবে এক্ষেত্রে কেউ যাতে অহেতুক হয়রানির শিকার না হয় সে বিষয়ে কড়া নির্দেশনা দেওয়া আছে। এরপরও সুনির্দিস্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে আরএনবি কমান্ড্যান্ট শহীদ উল্লাহ বলেন, জনবলের প্রকট অভাব। এ কারণে সব সময় ডেস্কে লোক রাখা সম্ভব হয় না। তবে ত্রুটি-বিচ্যুতি একেবারেই যে নেই তা বলা যাবে না। এক্ষেত্রে কেউ সুনির্দিস্ট অভিযোগ দিলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারি চাকরি করলেও কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
অরক্ষিত অস্ত্রাগার : স্টেশন ঘেঁষা পাশপাশি দুটি জরাজীর্ণ কক্ষ নিয়ে আরএনবির অস্ত্রাগার। স্টেশনে যে কোনো নিরাপত্তা পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য এখানকার অস্ত্রাগারে বেশকিছু আগ্নেয়াস্ত্র এবং গোলাবারুদ মজুত রাখা হয়। কিন্তু সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব প্রকট। অস্ত্র হাতে পাহারায় একজন মাত্র পোশাকধারী আরএনবি সদস্য। এছাড়া সাদা পোশাকে আরও দুজন আরএনবি সদস্য থাকলেও তারা মূলত অফিস স্টাফ। তাদের কাছে নিরাপত্তা সরঞ্জামের বালাই নেই।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আরএনবি সদস্য যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে কয়েক দফা দাপ্তরিক চিঠি চালাচালি হয়েছে। কিন্তু শিগগিরই পরিস্থিতি বদলাবে এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
গণশৌচাগারে অফিস : তখন দুপুর ৩টা। প্ল্যাটফর্মসংলগ্ন মেডিকেল টেকনোলজিস্টের অফিসে চোখ আটকে যায়। আলো-বাতাসহীন অন্ধকার এক ঘর। নোনা ধরা দেওয়াল। ছাদ থেকে খসে পড়ছে পলেস্তারা। পাশাপাশি আরও কয়েকটি খুপড়িতে নানা ধরনের পরিচ্ছন্ন সামগ্রীর স্তূপ। এর মাঝেই গুটিসুটি মেরে বসে আছেন মেডিকেল টেনকোনলজিস্ট আরিফুর রহমান।
ঘরের এক কোণে দুটি ব্র্যান্ডনিউ অটোসুইপার মেশিনসহ বেশকিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি পড়ে থাকতে দেখা যায়। অথচ স্টেশন পরিচ্ছন্নতার কাজে এসব উপকরণের ব্যবহার নেই। এখনো সুইপারদের একমাত্র হাতিয়ার পাটের তৈরি এক ধরনের ‘মোছা’। অতি ব্যবহারে সেই মোছার অবস্থাও করুণ। অফিসের এমন বেহাল সম্পর্কে জানতে চাইলে মেডিকেল টেকোনলজিস্ট আরিফুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আগে এটি স্টেশনের গণশৌচাগার হিসাবে ব্যবহৃত হতো। জায়গার অভাব। তাই এসবের মধ্যেই অফিস করতে হচ্ছে। সমস্যা সমাধানের জন্য রেলভবনে কয়েক দফা চিঠিও দেওয়া হয়েছে।
পড়ে থাকা সুইপার মেশিন সম্পর্কে তিনি বলেন, স্টেশনের মেঝে অমসৃণ হওয়ায় অটো সুইপার ঠিকমতো কাজ করে না। তাছাড়া শুধু যন্ত্রের মাধ্যমে স্টেশন পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব নয়। এজন্য পর্যাপ্তসংখ্যক প্রশিক্ষিত দক্ষ জনবলও দরকার।
ফেমাসে বন্দি ১৪ ট্রেন : রেলের পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম বেসরকারি কোম্পানির দখলে। এজন্য একাধিক ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শুধু ট্রেনের অভ্যন্তর পরিচ্ছন্ন রাখার নামে বরাদ্দের পরিমাণ বিশাল। কিন্তু কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করেও সুফল মেলেনি। বরং রেলের এমন লোক দেখানো পরিচ্ছন্নতা অভিযান যাত্রীদের মাঝে হাঁসির খোরাক জোগায়।
সরেজমিন দেখা যায়, ট্রেন থামতেই ঝাড়ু, ডাস্টবিন হাতে প্ল্যাটফর্মে দৌড়ে ঢুকছে ৪-৫ জন কিশোর। আনাড়ি হাতে এলোপাতাড়ি ঝাড়ু মেরেই তারা ক্ষান্ত। এমনকি প্ল্যাটফর্মের পাশেই ফের খালি করা হচ্ছে আবর্জনা ভর্তি ড্রাম। এতে পরিষ্কারের বদলে উলটো উৎকট দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে স্টেশনজুড়ে।
বুধবার দুপুরে আন্তঃনগর সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস প্ল্যাটফর্মে ঢুকতেই দৌড়ে ট্রেনের বিভিন্ন বগিতে ওঠে আলামিন, রানা ও সাগর নামের তিন কিশোর। এদের হাতে নিম্নমানের সাবানের প্যাকেট এবং টয়লেট টিস্যুর রোল। কয়েকজনের গলায় ঝোলানো পরিচয়পত্র। এতে লেখা মেসার্স ফেমাস ট্রেডার্স। প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার।
পরিচয়পত্র থেকে ফেমাসের ম্যানেজার ইমরানের নম্বর নিয়ে কল করা হলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, তাদের কোম্পানি ১৪টি আন্তঃনগর ট্রেনসহ বেশ কয়েকটি লোকাল ট্রেনের অভ্যন্তর পরিচ্ছন্নতার কাজ পেয়েছে। এছাড়া রেলওয়ের আরও বেশকিছু কাজ করে ফেমাস। তার দাবি অন্য যে কোনো কোম্পানির চেয়ে তাদের কাজের মান ভালো। ফেমাসের মালিকের নাম বাহার উল্লাহ।
কালিকান্তের হোটেল : রেলওয়ের আবাসিক হোটেল ঘিরে কমলাপুরে রীতিমতো আস্তানা গেড়েছেন অবসরপ্রাপ্ত রেল কর্মকর্তা কালিকান্ত ঘোষ। তবে আবাসিক হোটেল ছাড়াও কমলাপুরের অনেক কিছুই এখন তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে। এমনকি তিনি বেশ সক্রিয় রেল ভবনেও। অবসরের পরও কালিকান্তের এমন দৌরাত্ম্যে খোদ রেল কর্মকর্তারাও ক্ষুব্ধ। জানা যায়, কমলাপুর স্টেশনের তৃতীয়তলায় অবস্থিত রেলের আবাসিক হোটেল বেসরকারি খাতে পরিচালিত হতো। নিকুঞ্জ নামে হোটেলটির পরিচালনায় ছিলেন হারুন নামের এক প্রভাবশালী। কিন্তু হঠাৎ করেই বিপুল অঙ্কের অর্থ বকেয়া রেখে পালিয়ে যায় তার লোকজন। পরে সরাসরি হোটেল পরিচালনায় নামে রেলওয়ের পর্যটন সেল। অতঃপর সুযোগসন্ধানী কতিপয় কর্মকর্তারও কপাল খুলতে আর বাকি থাকে না।
অসহায় ঘোষক : আবাসিক হোটেলের এক পাশে রেলের স্পর্শকাতর সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ কক্ষ (কেবিন)। কিন্তু এর অবস্থা বেশ করুণ। জরাজীর্ণ কক্ষ। খসে পড়ছে পলেস্তারা। ঘরময় ছড়ানো নানা সরঞ্জাম, বৈদ্যুতিক তার এবং পরিত্যক্ত আসবাবপত্র। এসবের মধ্যেই রেল যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত এক কর্মকর্তা। একদিকের টিভি পর্দায় দেখানো হচ্ছে ডিজিটাল সিগন্যালিং সিস্টেম। সংকেত অনুযায়ী মাঠ পর্যায়ে ট্রেন চলাচলের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। তার আর একপাশ থেকে আসছে ট্রেন যাত্রার সময়সূচির ঘোষণা।
দেখা যায়, রেলের ঘোষক শরিফুল ইসলাম কিছুক্ষণ পরপর ট্রেন চলাচলের সময়সূচি ঘোষণা করছেন। কিন্তু স্টেশনে দাঁড়িয়ে এর মর্মার্থ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ঘোষণা সত্ত্বেও যাত্রীদের অনেকেই ছুটছেন অনুসন্ধান কাউন্টারে। ট্রেনের অবস্থান জানতে কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন ভ্রাম্যমাণ কুলিদের। এতে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের বিরক্তি আরও বাড়ছে।
এমন পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে রেলের ঘোষক শরিফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, অতি পুরোনো শব্দযন্ত্রের কারণে এমন অবস্থা। তিনি ঠিকঠাক ঘোষণা দিচ্ছেন, কিন্তু মাইকে সেটি পরিষ্কার শোনা যায় না। এ নিয়ে কয়েক দফা রেলপথ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পুরোনো সাউন্ড সিস্টেম পরিবর্তন করা হয়নি।
দুর্গন্ধ ফ্রি : তখন বিকাল ৪টা। প্রথম শ্রেণির বিশ্রামাগারে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। অথচ বদ্ধঘরে দুর্গন্ধে টেকা দায়। বিশ্রামাগারের একমাত্র টয়লেট পরিষ্কার হয়নি বহুদিন। কমোড থেকে উপছে পড়ছে পানি। এর মধ্যে গাদাগাদি করে বসা শতাধিক যাত্রী। এর বেশির ভাগই নারী, শিশু এবং বৃদ্ধ। অবশ্য তাদের অনেকেরই নাক-মুখ চেপে বাধ্য হয়ে এ রকম টয়লেট ব্যবহার করতে হচ্ছে।
জাহিদ হোসেন নামের রেলের এক নিয়মিত যাত্রী যুগান্তরকে বলেন, টয়লেটের দুর্গন্ধে দীর্ঘ সময় বসে থাকা কঠিন। কিন্তু নিরাপত্তার অভাবে অগত্যা তাদের এর মধ্যেই বসে থাকতে হচ্ছে। তাছাড়া বিশ্রামাগারে নিম্নমানের সোফা বসার অনুপযোগী। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় রেল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দেওয়া হলেও বিশেষ কোনো লাভ হয়নি।
দেখা যায়, স্টেশনের পূর্বকোণে রেলের মর্গ থেকেও ভেসে আসছে বিকট দুর্গন্ধ। মর্গ বলতে টিনের ছাপরা ঘর। আধুনিক সুযোগ-সুবিধার অভাবে উন্মুক্ত জায়গায় রাখা হয় মরদেহ। রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থার কিছুই নেই। ফলে পচন ধরা মরদেহের দুর্গন্ধে আশপাশে টেকা দায়। এ খাতে নিজস্ব লোকবল না থাকায় দৈনিক মজুরিতে রেলের মর্গে ডোম হিসাবে কাজ করেন কয়েকজন কিশোর।
তখন বিকাল ৫টা। মর্গের পাশেই ইমরান, মনির ও জেম নামের তিন কিশোর পলিথিন বিছিয়ে দুপুরের খাবার নিয়ে বসেছে। পরিচয় জানতে চাইলে তারা নিজেদের রেলওয়ের মর্গ কর্মী হিসাবে পরিচয় দেয়। কিশোর ইমরান জানায়, রেলে কাটা পাড়লে অনেক সময় মরদেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তখন দেহাংশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। এছাড়া মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করতেও দেরি হয়। এ সময় পচন ধরলে আশপাশে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
যা বললেন রেলপথমন্ত্রী : কমলাপুর রেলস্টেশনের নানা অনিয়ম এবং জরাজীর্ণ দশা সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে রেলপথমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম শনিবার যুগান্তরকে বলেন, শুধু কমলাপুর নয়, দেশের সবগুলো স্টেশন পরিচ্ছন্ন থাকবে এমনটাই কাম্য। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি আশানুরূপ নয়। এর মধ্যে দেশের প্রধান রেলস্টেশন হিসাবে কমলাপুরের পরিস্থিতি আরও উন্নত হওয়া প্রয়োজন।
এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘শিগগিরই আমি নিজে কমলাপুর পরিদর্শন করব। সব জায়গা ঘুরে দেখব। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করা হবে। এছাড়া রেলওয়ের যেসব কর্মকর্তার ওপর কমলাপুর স্টেশনের সার্বিক দায়-দায়িত্ব রয়েছে তাদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে। দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে কারও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।