জাতীয় বাজেট ঘোষণার পর দেশের পুঁজিবাজার যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ভয়াবহ দর পতনে বিনিয়োগকারীরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে গতকাল সর্বনিম্ন অবস্থান ৫ হাজার ৭০ পয়েন্টে নেমেছে ঢাকা স্টকের প্রধান মূল্যসূচক। দাম পড়তির মুখেও শেয়ার বিক্রির চাপ অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। কেউ আরও দর হারানোর আশঙ্কায় দ্রুত প্যানিক সেল করছেন। কারো কারো শেয়ার আবার মার্জিন ঋণের বাধ্যবাধকতায় ফোর্সড সেলের মুখেও পড়ছে। গতকাল একদিনে পুঁজিবাজারে ৫ হাজার ৯১১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা উধাও হয়ে গেছে। রয়্যাল ক্যাপিটালের পর্যবেক্ষণ অনুসারে বিক্রির প্রবল চাপে ছিল পুঁজিবাজার। বিনিয়োগকারীদের ৭৮ শতাংশই গতকাল শেয়ার বিক্রির জন্য মরিয়া ছিল, আর ক্রেতা ছিল মাত্র ২২ শতাংশ।
বর্তমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, এই পরিস্থিতি গত চার বছর ধরে চলছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় পাচ্ছি না। এখন নীতি সহায়তা দিয়ে বাজারে সাপোর্ট দেয়ার কথা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের। এই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা রুগ্ন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে বাজার বিনিয়োগকারী শূন্য হবে। তিনি বলেন, গত কয়েক বছর ধরে বাজারে মন্দা বিরাজ করায় অধিকাংশ বিনিয়োগকারী লোকসানের কবলে পড়ে চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে রয়েছে।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বাজারের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে। হাজার হাজার বিনিয়োগকারী টাকা তুলে বিও হিসাব বন্ধ করে চলে যাচ্ছে। তারল্য সঙ্কটে পুঁজিবাজারে তীব্র। অর্থনীতির জন্য, পুঁজিবাজারের জন্য স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। এক সময় আইসিবি দেখভাল করতো, ইন্টারবেন করতো, এখন সেটাও নেই। বর্তমান অর্থমন্ত্রীর অনেক বয়স। এসবের ব্যাপারে তিনি অবহিত বলে মনে হয় না।
আবু আহমেদ বলেন, ফ্লোর প্রাইজ আরোপসহ বিএসইসির কিছু সিদ্ধান্ত সময়ের সাথে ছিল না। এখনো কিছু কোম্পানি ফ্লোর প্রাইজে আছে। আবার নিচে ৩ শতাংশে দর বেঁধে দেয়াটাও বাজারের জন্য খারাপ। তিনি বলেন, অনেক সিকিউরিটিজ হাউজ নিয়ম না মেনে বিনিয়োগকারীদের বেশি পরিমাণে মার্জিন ঋণ দিচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এসব নিয়মের মধ্যে আনতে হবে।
তিনি বলেন, ভালো কোনো কোম্পানি আনতে পারেনি গত কয়েক বছরে। এভাবে দর পতন ও কোনো পদক্ষেপ সরকার না নিলে মানুষ তো পুঁজি হারাতে চাইবে না।
শেয়ার লেনদেনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ডিএসইএক্স আরো ৩৫.৮৭ পয়েন্ট কমে এখন ৫ হাজার ৭০ পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছে। আর ডিএসই শরিয়াহ সূচক ৯.৮৭ পয়েন্ট কমে এক হাজার ৯৩.৭৮ পয়েন্টে এবং ডিএসই-৩০ সূচক ৮.৭২ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে এক হাজার ৮০৩.০৫ পয়েন্টে। লেনদেন হওয়া ৩৯৪ কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ৫১ টির, দর কমেছে ৩০৮ টির এবং দর অপরিবর্তিত রয়েছে ৩৫টির। ডিএসইতে ১০ কোটি ৯৬ লাখ ৪৩ হাজার ৭০১টি শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড ও বন্ড হাতবদল হয়েছে ৪৩১ কোটি ৬৪ লাখ ৫৪ হাজার ৯৫৫ টাকায়। আগের কার্যদিবস থেকে ১১২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা বেশি। এর আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৩১৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকার। দরপতনে বিক্রির চাপে তারল্য চলে গেছে ৩ হাজার ১৫৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
এ দিকে, ডিএসইর ব্লক মার্কেটে লেনদেনে অংশ নেয়া ৪৬টি কোম্পানির ৪৩ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৭টি শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড হাতবদল হয়েছে মোট ৩১ কোটি ৮১ লাখ ১৭ হাজার টাকায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হতে দেখা গেছে ছয় কোম্পানির শেয়ার। কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে- মেঘনা পেট্রোলিয়াম, স্কয়ার ফার্মা, আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ, বিকন ফার্মা, সেন্ট্রাল ইন্সুরেন্স এবং সি পার্ল হোটেল। এই ছয় কোম্পানির মোট শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২২ কোটি ২৬ লাখ টাকারও বেশি। তবে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের। কোম্পানিটির ৬ লাখ ৪০ হাজার শেয়ার হাতবদল হয়েছে ১২ কোটি ৭১ লাখ ৪ হাজার টাকায়। এ ছাড়া স্কয়ার ফার্মার শেয়ার লেনদেনে হয়েছে ৩ কোটি ৬ লাখ ৮০ হাজার টাকার।
অন্য দিকে, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই আরো ১০৭.৭৪ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৫৭০.৩৭ পয়েন্টে। এ ছাড়া সিএসসিএক্স আরো ৬৫.০২ পয়েন্ট কমে ৮ হাজার ৭৬২.৮৭ পয়েন্টে এবং সিএসই-৩০ সূচক ৬৫.৬২ পয়েন্ট কমে ১১ হাজার ২২৮.৫৭ পয়েন্টে অবস্থান করছে।
সিএসইতে ২১১ টি কোম্পানি লেনদেনে অংশ নিয়েছে। এসব কোম্পানির মধ্যে ২৫টির দর বেড়েছে, কমেছে ১৬৩ টির এবং ২৩ টির দর অপরিবর্তিত রয়েছে। সিএসইতে দুই কোটি ৫৯ লাখ ৬ হাজার ১৯৬টি শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড বেচাকেনা হয়েছে ১০৭ কোটি ৯৭ লাখ ৩৮ হাজার ৮৭৭ টাকা বাজারমূল্যে। অব্যাহত পতনে বিক্রির স্রোতে বাজার মূলধন আরো পৌনে তিন হাজার কোটি টাকা কমেছে।
বাজারের প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্লেষক রয়্যাল ক্যাপিটালের পর্যবেক্ষণ হলো, সূচকের পতন অব্যাহত রয়েছে। শেয়ারবাজারের প্রধান সূচক (ডিএসইএক্স), বাজেট পরবর্তী ক্যাপিটাল গেইন ও করপোরেট ট্যাক্স ইস্যু, সেই সাথে ট্রেজারি সিকিউরিটিজের ক্রমাগত সুদের হার বৃদ্ধির ফলে প্রধান সূচক টানা ৩ দিন হ্রাস পেয়েছে। দিনশেষে প্রধান সূচক ৩৫ পয়েন্ট কমেছে। তবে লেনদেনের পরিমাণ গত কার্যদিবসের তুলনায় ৩৫.৫ শতাংশ বা ১১৩ কোটি টাকা বেড়েছে। ঢাকার শেয়ারবাজারে সূচক নিম্নমুখী ছিল। মূলধন গত দিনের তুলনায় ০.৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। তবে ভলিউম ১০ শতাংশ এবং টার্নওভার ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। ১৯টি সেক্টরের মধ্যে মাত্র একটি সেক্টরের বাজার মূলধন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ১৮টি সেক্টরের বাজার মূলধন হ্রাস পেয়েছে। পাঁচটি খাতের শেয়ারের কোনো ক্রেতা ছিল না।