দেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেদ্র উৎপাদনে যাওয়ার সময় পেছালো। দেশের চাহিদা ও যোগানের মধ্যে যেখানে বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিচ্ছে সেখানে রূপপুর পারমাণবিক বিদুৎকেন্দ্র আমাদের আশার আলো দেখিয়েছিল। কিন্তু বৈশ্বিক কারণে তা আবার পিছিয়ে গেল। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রযুক্তিগত কাঁচামাল সহজলভ্য। যেখানে তেল, গ্যাস ও কয়লা আমদানি করতে বেগ পেতে হয় বলেই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দিকে বিশ্ব এখন ঝুঁকছে। এ প্রযুক্তি বৈশ্বিক জলবায়ু রোধে অত্যন্ত কার্যকর। যেখানে তেল, গ্যাস ও কয়লা পোড়ানো হলে বিপুল পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ ঘটে সে ক্ষেত্রে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশ বান্ধব। তাই আশা ও স্বপ্নের বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোয় আমরা এখন আশাহত হয়ে পড়েছি। যে খাতে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানীগুলো বছরে কয়েক বার দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা শুরু করে সেখানে এ প্রকল্প ছিল মানুষের জন্য একটা স্বপ্ন। দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে যেয়ে বাজেটের বড় ধরনের একটা অংশ বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ দেয়ার প্রয়োজন পড়ে। তারপরও বিদ্যুৎ খাত নাজুক দশা থেকে বের হতে পারছে না।
বৈশ্বিক যুদ্ধ-বিগ্রহ, ডলার সংকট, তেল, কয়লা এবং গ্যাস সংকটের কারণে এ খাত এখন বিপর্যস্ত অবস্থায় উপনীত হয়েছে। অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে যা-ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা হচ্ছে তাতেও সাধারণ মানুষের ভোগান্তি লাঘব হয়নি একটুও। বছরে চারবার বিদ্যুতের দর বৃদ্ধি করা হচ্ছে। তাতে করে উৎপাদনমুখী বিদ্যুৎনির্ভর খাতগুলোকে সংকটের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। তবে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির টাকার ব্যবহারে সঠিক এবং দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে না পারায় এ খাতে লুটপাটের চিত্র এখন মারাত্মক। পিডিবি বলছে, যেখানে ২০২০-২১ প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ এর উৎপাদন খরচ ছিল-৬ টাকা ১১ পয়সা; যা আস্তে আস্তে দর বৃদ্ধি পেয়ে ২০২১-২২ সালে এসে দাঁড়ায় ৮ টাকা ৮৪ পয়সা। ২০২২-২৩ সালে এসে দাঁড়ায় ১১ টাকা ৩৩ পয়সা। ২০২২-২৩ পিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন খরচ ছিল ৭ টাকা ৬৩ পয়সা এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন খরচ দেখা যায় ৬ টাকা ৮৫ পয়সা। বেসরকারী আইপিপিগুলোর গড় উৎপাদন খরচ ছিল ১৪ টাকা ৬২ পয়সা ও রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গড় উৎপাদন খরচ ১২ টাকা ৫৩ পয়সা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দেয়া হয় ৩৯ হাজার ৪ শত ৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাড়া বাবদ ক্যাপাসিটি চার্জ ব্যয় ধরা হয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির ৮১ শতাংশই চলে যাবে অপ্রয়োজনীয় ক্যাপাসিটির বিল পরিশোধে। তার আগের বছর ক্যাপাসিটির চার্জ পরিশোধ করা হয় ২৬ হাজার কোটি টাকার মতো।
ওই অর্থবছরে ভর্তুকি দেওয়া হয় মোট ভর্তুকির ৬৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। তাহলে দেশের রাঘব-বোয়ালরা এভাবেই ক্যাপাসিটির চার্জ নামে ভর্তুকির টাকা গলাধকরণ করে টাকার পাহাড় বানিয়ে দেশে ও বিদেশে বিত্তবৈভব গড়ে তুলছে। এতে সবেচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়ছে কৃষিখাত। তাছাড়া দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজও টাকার অভাবে পিছিয়ে পড়ছে। তার কারণ ভর্তুকির বড় একটা অংশই বিদ্যুৎ খাতে চলে যাচ্ছে। তাছাড়া রপ্তানিমুখী তৈরী পোশাকও বিদ্যুৎ এর বাড়তি দরের প্রভাব মোকাবেলা করছে। বিদ্যুৎ খাত এখন মূলত বাজেটের ভর্তুকির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তাতে উভয় সংকট তৈরী হচ্ছে। বিদ্যুৎ সংস্থাগুলো ভর্তুকির টাকা লাগামহীনভাবে লুটপাট করে নিচ্ছে। সে টাকায় দুবাই-আমেরিকা এবং সুয়েজ ব্যাংকগুলো ফুলে ফেঁপে মোটাতাজা হচ্ছে। জানা গেছে, এ বছর ৩৫ হাজার কোটি টাকা বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দেয়ার চিন্তা ভাবনা চলছে। গত বছর সংশোধিত বাজেটে পরিশোধ করা হয়েছে ৩৯ হাজার ৬ শত ২ কোটি টাকা। মজার ব্যাপার হলো-ভর্তুকির টাকা আইনগত বৈধতা দিয়ে পাচারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দেশে তৈরী হচ্ছে অর্থনীতির করুণ অবস্থা। সংকটের মধ্যে পড়ছে দেশের রিজার্ভ। লুটপাটের দৃশ্যপটটা কেমন তা যদি ১৪ বছরের হিসাব ধরা হয় তাহলেই আসল চিত্র বেরিয়ে আসবে।
গত ১৪ বছরে ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা শুধুমাত্র ক্যাপাসিটির চার্জ বাবদ সরকার পরিশোধ করেছে। সরকার সময়মতো কয়লা, তেল, গ্যাস বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে সরবরাহ করতে পারেনি বলে বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখার কারণে জরিমানা হিসেবে এ টাকা পরিশোধ করতে বাধ্য হয়েছে। অনেক প্লান্টের টাকা সময়মতো দিতে না পেরে বন্ড দিয়ে পর্যন্ত বিদ্যুৎ এর টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। যেখানে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রে প্রকল্পে খরচ হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার দিচ্ছে ২২ হাজার ৫২ কোটি টাকা এবং আর রাশিয়ার ঋণ সহযোগিতা হিসেবে আসছে ৯১ হাজার ২৭ কোটি টাকা। যে টাকা এতোদিন সরকার ক্যাপাসিটির চার্জ হিসেবে পরিশোধ করেছে সে টাকায় একটি রূপপুর প্রকল্প তৈরী করা যায় কোন ধরনের ঋণ গ্রহণ না করে। তবে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আশংকার কথা হলো-এখানে বালিশকান্ডসহ নানামুখী অনিয়মের অবতারণা ঘটেছে। তা মোকাবেলা করে এ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ইতিমধ্যেই ৭০ ভাগ কাজ শেষ করা হয়েছে বলে জানা যায়। আর প্রকল্পের মেয়াদ আরো দু’বছর বাড়ানো হয়েছে। বর্তমান বিশে^র ৩০টি দেশের ৪ শত ৪৯ টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। সেগুলো থেকে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। ১৪ দেশে আরো ৬৫টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ ২৭টি দেশে আরো ১ শত ৭৩টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। এগুলোর মধ্যে ৩০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রই নবাগত দেশে। যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।
২০২১ সালের অক্টোবরে রূপপুর প্রথম ইউনিটের ভৌত কাঠামোর চুল্লিপাত্র বসানো হয়। চুল্লিপাত্র হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল যন্ত্র। এই পাত্রে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়াম লোড করা হয়। আর গত বছরের অক্টোবরে বসানো হয় দ্বিতীয় ইউনিটের চুল্লিপাত্র। বিদ্যুৎ কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, আগামী ডিসেম্বরে প্রথম চুল্লিপাত্রে জ্বালানি প্রবেশ শুরু হবে। চলবে বেশ কিছুদিন ধরে। তিন মাস পরে এ কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হতে পারে। একই মাসে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকবে। সব পরীক্ষা শেষ করে রূপপুর প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন আগামী বছরের ডিসেম্বরে শুরু হতে পারে। তবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কয়েক স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তা বলয়ে গড়ে তোলা হয়েছে। এর নির্মাণ ভৌত অবকাঠামো ভূমিকম্প সহনীয় অঞ্চল হিসেবে রূপপুরকে বেছে নেয়া হয়েছে। দেশের সবচেয়ে কম ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা হিসেবে রূপপুরকে চিহ্নিতকরণ করা হয়েছে। ভূমিকম্প, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলোচ্ছ্বাসসহ সব কিছুর মোকাবেলা করার ইতিহাস পর্যালোচনা করার পর রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যেখানে ভারতের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভূমিকম্প সহনীয় মাত্রা হলো-(পিজিএ=০.১৭১জি) আর বাংলাদেশের পারমাণবিক ভূমিকম্পের সহনীয় মাত্রা হলো (পিজিএ=০.৩৩৩জি)। যা ভারতের চেয়ে প্রায় দ্বিগুন। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা হিসেবে প্রাকৃতিক ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, টর্নেডো এবং মানবসৃষ্ট বিমান দুর্ঘটনা এমনকি অগ্নিকান্ডে ক্ষতি সাধন ঘটতে না পারে তার চিন্তাভাবনা করেই এর নকশা প্রণয়ণ করা হয়েছে।
২০১৬ সালে জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল প্রকল্পের মেয়াদ। এটি বাড়িয়ে এখন ২০২৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। তবে চুক্তি অনুসারে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লেও খরচ বাড়াতে পারবে না ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। এ প্রকল্প শেষ হয়ার আগে একই এলাকায় আরেকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। আর এখানেই আশংকা করা হচ্ছে। দেশের মধ্যে যারা ইতিমধ্যে ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তুলেছেন তারা চাইবে না রূপপুর দ্রুত কাজে আসুক। কারণ ভর্তুকির ক্যাপাসিটির টাকা শুধু যে বিদ্যুৎ কোম্পানীগুলো একাই পেয়ে থাকে তা নয়। দেশের রাঘববোয়াল, রাজনৈতিক নেতা, আমলা এবং প্রকৌশলীরা পর্যন্ত পেয়ে থাকেন। এই অনিয়মের ভযংকর ধারা যাতে রূপপুরে না পড়ে তার জন্য সতর্ক থাকতে হবে। জনগণ এমনিতেই পিষ্ট হতে হতে তাদের পায়ের তলায় মাটি নেই।
রূপপুর তাদের আশার আলো দেখিয়েছিল। বিদ্যুৎ এর দাম বাড়ার কারণে মূল্যেস্ফীতি এখন দুই অঙ্কের ঘরে। জটিল থেকে জটিতর হচ্ছে খাদ্যশস্যের দাম। সেখানে রূপপুর বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে স্বল্পমূল্যে। তেলভিত্তিক প্লান্ট যেখানে ১৫ টাকা দরে বিদ্যুৎ বিতরণকারী কোম্পানীগুলোর কাছ থেকে কিনছে আর পিডিবির দাম যদিও কিছুটা কম। কিন্তু সব কিছুর মূলে রয়েছে ভর্তুকির ব্যবস্থা এবং আইএমএফে’র অযাচিত হস্তক্ষেপে বিদ্যুৎ এর দর বাড়ানো হচ্ছে দফায় দফায়। রূপপুর উৎপাদনে যেতে পারলে বিদ্যুৎ এর দরে কিছুটা যে স্বস্তি ঘটতো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।