২০০৪ সাল। ক্ষমতায় সাবেক চারদলীয় জোট সরকার। সরকারি একটি ব্যাংকের রাজধানীর রমনা করপোরেট শাখায় বড় অঙ্কের একটি জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। এতে ব্যাংকের এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয় সরকারের প্রভাবশালীদের সহায়তায়। ব্যাংক ফোর্সলোন সৃষ্টি করে দায় শোধ করে। কিন্তু ফোর্সলোনের টাকা আর আদায় হচ্ছে না। পর্যায়ক্রমে সেগুলো খেলাপি হয়। এতে ওই শাখার খেলাপি ঋণ বেড়ে যায় অস্বাভাবিক গতিতে। শাখাটির দুর্নাম ছড়িয়ে পড়ে ব্যাংক পাড়ায়। শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক পালিয়ে যান বিদেশে। এক বছরের ব্যবধানে ওই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দুই হাজার কোটি টাকা বেড়ে যায়। এতে পুরো ব্যাংকটির দুর্নাম বেড়ে যায়। ব্যাংক প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি বেড়ে যায়। আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে ব্যাংকটি। ঘটনাটি কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও নাড়া দেয়। তাদের দুর্বলতা প্রকাশ্য হয়ে ওঠে। এ ঘটনা তখনও সরকারের কাঠামোকে নাড়া দেয়নি।
২০১২ সালে বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে একই ব্যাংকে ঘটে বহুল আলোচিত ওই সময়ে সবচেয়ে বড় জালিয়াতি হলমার্ক কেলেংকারি। এ ঘটনার উত্তাপে আক্রান্ত হয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি অর্থ মন্ত্রণালয়ও। তখনো সরকারের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে উত্তাপ পৌঁছেনি। এখন ২০২৪ সাল। দেশে নজিরবিহীনভাবে একই সরকারের টানা চতুর্থ মেয়াদ চলছে। সেই ২০০৪ সাল থেকে ইতোমধ্যে কেটে গেছে ২০ বছর।
সেই রমনা শাখার ঘটনাকে ছাড়িয়ে আরও বড় বড় জালিয়াতির ঘটনা ঘটেই চলেছে। আর ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। ‘লোক দেখানো’ নানা উদ্যোগের পরও সেই অর্থ আর ফেরত আসছে না। ২০১৭ সালে এসে একটি সরকারি ব্যাংকে দুটি অখ্যাত গ্রুপের নামে পাঁচ হাজার কোটি টাকা করে ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ফাঁস হয়। এ ঘটনায় ব্যাংক খাতের ভিত্তি নড়েচড়ে ওঠে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যায় ১০ হাজার কোটি টাকা। সরকারের উচ্চ পর্যায়েও টনক নড়ে। এরকম একটি দুটি করে জালিয়াতির কারণে এখন পর্যন্ত হাজারটি জালিয়াতির ঘটনা সামনে এসেছে। এসব ঋণ ধীরে ধীরে খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। যা বেড়ে এখন এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা হয়েছে। খেলাপি ঋণের ছোবলে ব্যাংক খাত এখন বহুবিদ রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-তারল্য সংকট, প্রভিশন ঘাটতি, মূলধন ঘাটতি এবং আয় কমে যাওয়া। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতের রুগ্ণতা এখন সর্বত্র আলোচনায়। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকির ব্যর্থতাও প্রকাশ্যে ফুটে ওঠে। জালিয়াতরা যে সরকারের কাছের লোক, জালিয়াতির নেপথ্য যে সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে সেটিও আলোচনায় আসে। ফলে খেলাপি ঋণের লাগামহীন বেড়ে যাওয়ার ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে দিন দিন অস্বস্তি বেড়েই চলেছে।
প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার আগে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছিলেন, ‘ঋণ খেলাপিদের ধরতে চাই। এবার ধরব।’ কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে খেলাপিদের ধরার পদক্ষেপের কোনো কথাই বলা হয়নি। এমনকি ঋণখেলাপি শব্দটিও বাজেট বক্তৃতার কোথাও উল্লেখ নেই। বরং বাজেটের দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসেই খেলাপি ঋণ ৩৬ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকায়। যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ। যদিও প্রকৃত তথ্য আরও অনেক বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। গত মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকায়। আলোচ্য ১৫ বছর তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক লাখ ৫৯ হাজার ৮১৪ টাকা। বৃদ্ধির হার ৭১১ শতাংশ বা ৮ গুণের বেশি।
এর আগে ১৯৯০ সালে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল চার হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৮ সাল ১৮ বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা। ওই সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৮৪ শতাংশ বা প্রায় ৫ গুণ।
আগের ১৮ বছরের চেয়ে বর্তমান সরকারের ১৫ বছরে অর্থনীতির আকার বেড়েছে, ব্যাংকের সংখ্যার পাশাপাশি বেড়েছে শাখা। ব্যাংকিং সেবার আওতায় আসা মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। ফলে ব্যাংকে আমানত যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে ঋণ। এসব বৃদ্ধির সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যকর তদারকি বাড়েনি। সরকার থেকে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে বা নীতিসহায়তা দিয়ে ঋণখেলাপিদের পক্ষে ছাড় দেওয়া হয়েছে। এ কারণে বেড়েছে জালজালিয়াতি। এর মাধ্যমে নেওয়া ঋণের প্রায় পুরো অংশই একটি পর্যায়ে খেলাপি হচ্ছে। ফলে বেড়ে গেছে খেলাপি ঋণ।
ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ নিয়ে এরশাদ সরকারের আমল থেকেই দেশের অর্থনীতিবিদ ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা উদ্বেগ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিলেন। কিন্তু কোনো সরকারই এগুলো তেমন একটা আমলে নেয়নি। ২০১২ সালের পর ব্যাংক খাতের পরিস্থিতির অবনতি হলে ব্যাংক সংস্কার কমিটি গঠনের দাবি ওঠে। প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা করা হয়নি।
২০২৩ সালে বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব মোকাবিলায় সরকার আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ নিলে সংস্থাটি অনেক শর্ত আরোপ করে। এর মধ্যে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও খেলাপি ঋণ কমানোর বিষয়টিও রয়েছে। আইএমএফের সূত্র ধরে ব্যাংক খাতের অব্যবস্থাপনার চিত্রটি আবার সামনে চলে আসে। সরকারও বাধ্য হয়ে অঙ্গীকার করে ব্যাংক খাত সংস্কারের। কিন্তু এখন পর্যন্ত ব্যাংক খাত সংস্কারের বিষয়ে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর কোনো সুফল দৃশ্যমান নয়। এমনকি ভবিষ্যতে দৃশ্যমান হবে এমন কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার, ব্যাংক একীভূত করার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলোতে আরও বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সংস্থাটি ঘনঘন নীতির বদল করছে। এতে ব্যাংক খাতে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত খেলাপি পাঁচ লাখ কোটি টাকার বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে হিসাব দিচ্ছে তা হচ্ছে সংজ্ঞার ভেতরে থেকে ব্যাংক যেসব ঋণ খেলাপি করে তার হিসাব। এর বাইরে অবলোপন করা হয়েছে ৫৬ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি হওয়ার আগের ধাপ অর্থাৎ বিশেষ হিসাবে রয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা, যেগুলো খেলাপি হচ্ছে। প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। যেগুলো খেলাপি হচ্ছে। এছাড়া খেলাপি হওয়ার যোগ্য কিন্তু ব্যাংকগুলো খেলাপি করছে না। এছাড়া আদালতের নির্দেশনায় ৬০ হাজার বেশি ঋণকে খেলাপি হিসাবে দেখানো যাচ্ছে না। এসব মিলে পাঁচ লাখ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ।
ব্যাংকগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত নিয়ে ঋণ বিতরণ করেছে। ওইসব ঋণ থেকে যে আয় হয় তা থেকে আমানতের মুনাফা দেওয়া হয়। গ্রাহকের আমানতের যে পাঁচ লাখ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে, এর বিপরীতে কোনো আয় হচ্ছে না। উলটো খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনা করতে খরচ হচ্ছে। কিন্তু আমানতকারীদের মুনাফা দিতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলোকে কোনো আয় না করেই মুনাফা দিতে হচ্ছে অন্য খাতের আয় থেকে। এতে ব্যাংকের সার্বিক আয় কমে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনায় মামলা পরিচালনা ও জামানত দেখভাল এসব খাতেও ব্যাংকগুলোর মোটা অংকের টাকা খরচ হচ্ছে। এছাড়া খেলাপি ঋণের বিপরীতে ৮২ হাজার কোটি টাকা আটকে রয়েছে প্রভিশন খাতে। এভাবে খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকের আয় কম ও খরচ বেশি হচ্ছে। এছাড়া প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতির কারণে ব্যাংক দুর্বল হচ্ছে।
ঋণখেলাপিদের একের পর এক ছাড় : গত ১৫ বছরে ঋণখেলাপি ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের একের পর এক ছাড় দেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সালের পর প্রথমেই খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা শিথিল করে তিন মাস সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে ঋণখেলাপি হতে তিন মাস সময় লাগে। যা আন্তর্জাতিক রীতিনীতির পরিপন্থি। খেলাপি ঋণের প্রচলিত সংজ্ঞার বিষয়ে আইএমএফ আপত্তি করলে তা আংশিক সংশোধন করা হয়। বাকিটা পরে করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে ঋণ পুনর্গঠনের নামে দেওয়া হয় খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা। ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রেও দেওয়া হয় বিশেষ ছাড়। ২০১৯ সালে ২ শতাংশ কিস্তি দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়।
এরপর করোনা শুরু হলে সব ধরনের ঋণগ্রহীতার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করার সুবিধা দেয়। বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব মোকাবিলার জন্যও বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয়। এসব সুবিধায় ২০২২ সালে ৬৭ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। যা এখন আবার খেলাপি হচ্ছে। এ সময় কিছু ভালো ঋণগ্রহীতাও ঋণ পরিশোধে অনাগ্রহী হয়ে ওঠেন। বর্তমান গভর্নর নিয়োগ পান ২০২২ সালের জুলাই মাসে। এসেই তিনি ঋণখেলাপিদের আরও ছাড় দিয়ে নতুন একটি নীতিমালা জারি করেন। নতুন নীতিমালায় আড়াই থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়। আগে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে জমা দিতে হতো ১০ থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ। এর পাশাপাশি খেলাপি ঋণ পাঁচ থেকে আট বছরে পরিশোধের সুযোগ রাখা হয়। আগে এসব ঋণ শোধ করতে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো।
নতুন নীতিমালায় খেলাপি ঋণের সুবিধা প্রদান ও পুনঃতফশিলের ক্ষমতাও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের হাতে ছেড়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে ব্যাংকের পরিচালকরাই ঠিক করছেন কোন ঋণ পুনঃতফশিল সুবিধা পাবে। আগে ঋণ পুনঃতফশিলের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগত। এর ফলে খেলাপি ঋণ আড়াল করার সুযোগ আরও বেড়েছে।
ছাড় দেওয়া এখানেই শেষ নয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঋণ অবলোপন নীতিমালা শিথিল করা হয়। সর্বশেষ ব্যাংক কোম্পানি আইন পরিবর্তন করে আরও এক দফা ছাড় দেওয়া হয় গত এপ্রিলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে জানিয়ে দেয়, কোনো ব্যবসায়ী গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলেও গ্রুপভুক্ত অন্য প্রতিষ্ঠান ঋণ নিতে পারবে। এতে ঋণখেলাপি কোম্পানির নতুন ঋণ পাওয়ার দরজা খুলে যায়। আগে কোনো গ্রুপের একটি কোম্পানি খেলাপি হলে অন্য কোম্পানি ঋণ পেত না।
দেশের ব্যাংক খাত ও খেলাপি ঋণ নিয়ে আইএমএফের মূল্যায়ন : ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের আর্থিক খাত নিয়ে একটি দীর্ঘ মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার প্রবণতার শিকড় অত্যন্ত গভীরে। প্রভাবশালী, উপর মহলে ভালো যোগাযোগ আছে এবং ধনী এমন কিছু ব্যবসায়ী ঋণ ফেরত দেওয়ার কোনো তাগিদই অনুভব করেন না। এমনকি বাংলাদেশে আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নিচ্ছেন প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান এসব ঋণগ্রাহক। এখানে খেলাপি ঋণ আড়াল করে রাখা আছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি দুর্বল, ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের আচরণ বেপরোয়া। নিয়ম ভাঙলে শাস্তিও পান না তারা।’
এর পরের চার বছরে পরিস্থিতির যে কোনো বদল হয়নি, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে প্রায় প্রতিদিনই। ফলে খেলাপিও বেড়েছে। খেলাপি ঋণ কমানোসহ ব্যাংক খাতের সমস্যা কমাতে বাংলাদেশ একটি রোডম্যাপ বা পথনকশার ঘোষণা দিয়েছিল গত ফেব্রুয়ারিতে। সেই পথনকশায় বিগত বছরগুলোতে ব্যাংক খাতে যেসব সংস্কারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেই পথনকশার আলোকে কার্যক্রম এখন স্থবির। বাংলাদেশ ব্যাংকও নিশ্চুপ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নীতিনির্ধারক আর প্রভাবশালীদের যে গোপন আঁতাত, সেখান থেকে বের হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। ফলে খেলাপি ঋণের কূটিল বৃত্ত থেকে বের হওয়ার মতো আশাবাদী কোনো কারণও দেখা যাচ্ছে না।
কারণ ঋণ খেলাপিদের ধরার বিষয়ে বিভিন্ন সময় সরকারের একাধিক মন্ত্রী প্রকাশ্যে কথা বলেছেন। এ সরকারের দুই মেয়াদের অর্থমন্ত্রী ছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। ব্যাংকিং খাতের জাল-জালিয়াতির বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি। কিন্তু নিতে পারেননি। ব্যাংক খাত সংস্কারে কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তিনি সেটা করতে পারেননি।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল এ সরকারের তৃতীয় মেয়াদে অর্থমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে বলেছিলেন, ‘খেলাপি আর বাড়বে না।’ কিন্তু তার তিন মাস পরেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে। তার পুরো মেয়াদেই ঋণ খেলাপিদের নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
শক্ত সিদ্ধান্ত না নিলে অরাজকতা থামবে না: ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বাজেটে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ধরার কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ আশা করেছিলাম অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলবেন, ‘ঋণখেলাপিদের আর কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। তাদের এবার শক্ত হাতে ধরা হবে। ঋণ ফেরত না দিলে তাদের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ব্যাংক খাতে এখন প্রধান সমস্যা সুশাসনের অভাব। এ কারণে জালজালিয়তিসহ নানা অনিয়ম হচ্ছে। অনিয়মের মাধ্যমে যেসব ঋণ দেওয়া হচ্ছে, এর সবই খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। খেলাপি ঋণ এখন কোনো কোনো ব্যবসায়ীর কাছে ব্যবসার ‘রোল মডেল’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন ব্যাংকের জন্য কঠিন সময়। এ সময়ে শক্ত সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে ব্যাংক খাতের অরাজকতা থামবে না।
স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে অর্থ আদায় করতে হবে: ড. মইনুল ইসলাম
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ও অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, খেলাপি ঋণের যে হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশ করেছে, এটা প্রকৃত তথ্য নয়। খেলাপি ঋণ এর চেয়েও বেশি। অর্থঋণ আদালত, হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্টের মামলাগুলোয় আটকে থাকা খেলাপি ঋণকে জাস্টিফাইড ঋণে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। ৬৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এগুলো পাঁচ বছরের পুরোনো মন্দঋণ, সেটা কিন্তু খেলাপি ঋণে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। এ দুটিকে যোগ করলে খেলাপি ঋণ ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
এ অর্থনীতিবিদ ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, সরকার যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর না হয় এবং একটা স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা না করে, তাহলে এ সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে না। বরং সমস্যা আরও প্রকট হবে।
প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও বেশি: ড. আহসান এইচ মনসুর
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের যে হিসাব প্রকাশ করা হয়, প্রকৃত খেলাপি ঋণ এর চেয়ে আরও বেশি।
মূলত আইএমএফ-এর শর্ত পরিপালন করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবলোপনসহ ঋণের নানা ক্যাটাগরি করে বাদ দিতে হচ্ছে। কিন্তু এগুলোও খেলাপি। দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র ধীরে ধীরে উঠে আসছে।
আইএমএফ-এর শর্ত সঠিকভাবে পরিপালন করলে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যাবে। কারণ, দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা এখনো আন্তর্জাতিক মানের নয়। আইএমএফ এই সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানের করতে বলেছে। তখন ঋণখেলাপিরা বাড়তি সময় পাবে না, যা এখন পাচ্ছে। তখন খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে।
ব্যাংক খাত নিয়ে গুরুত্বসহকারে ভাবার পরামর্শ দিয়ে আহসান মনসুর বলেন, ব্যাংক খাত থেকে টাকা পাওয়া যাচ্ছে না।
সরকার টাকা পাচ্ছে না, ব্যবসায়ীরাও পাচ্ছেন না। কেন পাচ্ছে না? এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী কারা? আহসান মনসুর বলেন, ব্যাংক একীভূতকরণের চেষ্টা দেখা গেলেও রাজনৈতিক অর্থনীতির চাপে তা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।