চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার রেলপথ। অনুমোদনের দীর্ঘ ১৩ বছর পর প্রকল্পটি উদ্বোধন করা হয় গত বছর নভেম্বরে। অনুমোদনের সময় প্রকল্পের ব্যয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা ধরা হলেও ২০১৬ সালে প্রকল্প সংশোধন করা হয়। তখন ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। তবে প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, ব্যয় ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ধরা হলেও সাড়ে ১১ হাজার কোটিতেই কাজ শেষ হচ্ছে। এরমধ্যে নির্মাণ কাজেই কম খরচ হচ্ছে ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, ব্যয় কমার মধ্যে অন্যতম একটি কারণ সঠিকভাবে প্রাক্কলন (সম্ভাব্য ব্যয়ের হিসাব) নির্ধারণ করতে না পারা। এ ছাড়া ব্যয় নির্ধারণের সময় প্রকল্পের অর্থায়ন কোন প্রতিষ্ঠান করবে সেটিও জানা ছিল না। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) অর্থায়ন করার ফলে লিমিটেড দরপত্রের বদলে উন্মুক্ত দরপত্র গ্রহণ করা গেছে। এতে খরচ অনেক কমেছে। এ ছাড়া কনস্ট্রাকশন খরচের সঙ্গে কনসালটেন্সি, কাস্টম ডিউটিসহ আনুষঙ্গিক ব্যয়ও কমছে।
প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় যতটুকু সম্ভব সঠিকভাবে ব্যয়ের হিসাব করে কাজ করা হয়েছে। এতে খরচের বড় একটা অংশ কমে গিয়েছে। চলতি সপ্তাহেই সংশোধিত এই প্রকল্প প্রস্তাবটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর কথা রয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, প্রকল্পে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার মধ্যে নির্মাণ বাবদ খরচ কম হচ্ছে ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ভূমি অধিগ্রহণে খরচ কমছে ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা, কাস্টম ডিউটি বাবদ ৬০০ কোটি টাকা, থোক বরাদ্দ ৫০০ কোটি টাকা, ক্ষতিপূরণ বাবদ ৩০৫ কোটি টাকা ও পরামর্শক বাবদ ২৩৫ কোটি টাকাও প্রয়োজন পড়ছে না। এ ছাড়া আনুষঙ্গিক আরও ৫০০ কোটি টাকা খরচ কমছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল প্রকল্পে। এরমধ্যে রামু-ঘুনধুম পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৭২ কিলোমিটার রেলপথের কাজ বাদ যাওয়ায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা খরচ কমছে প্রকল্প থেকে।
প্রকল্প পরিচালক মো. সুবক্তগীন মানবজমিনকে বলেন, রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম অংশের কাজ এখন ধরা হবে না। এতে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কমছে। আর চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রকল্পে ৪ হাজার কোটি টাকা খরচ কমানো হয়েছে। পুরো প্রকল্পে যা ব্যয় ধরা হয়েছিল তার প্রায় ৩৪ শতাংশ টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। রেলমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে সংশোধিত প্রস্তাবটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
এই অর্থ কীভাবে সাশ্রয় করা হয়েছে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, খরচ কম-বেশি না। যা প্রয়োজন পড়েছে তাই খরচ করেছি। প্রকল্পে টেন্ডার উন্মুক্ত দরে হয়েছিল। সেখানে ঠিকাদারদের প্রতিযোগিতা ছিল অনেক। এতে ব্যয় কমে গেছে। যখন ব্যয় ধরা হয়েছিল তখন হয়তো নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে একটু বেশি ধরা হয়েছিল।
সঠিকভাবে ব্যয় নির্ধারণ বা প্রাক্কলন করলে এত টাকা খরচ কমতো না উল্লেখ করে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক মানবজমিনকে বলেন, কিছু প্রকল্প পরিচালকরা খরচ কমানোর জন্য চেষ্টা করে। তবে কিছু পিডি প্রাক্কলনের সময় অনুমানভিত্তিক অতিরিক্ত ব্যয় নির্ধারণ করে। সেই হিসাবে অর্থ খরচ হয় না। এজন্য আমাদের ফিজিবিলিটি স্টাডি (বাস্তবায়নযোগ্যতা যাচাই) করতে হবে। সরকার যদিও এবার বড় প্রজেক্ট নেয়নি তবে আমার মনে হচ্ছে এখন প্রকল্প মূল্যায়ন করার সময় আসছে। আমাদের প্রকল্পগুলোর খরচ এত সুইং করে কেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটা বাড়ার দিকে প্রবণতা থাকে। আমাদের রেল, মেট্রোরেল, সড়ক কিংবা বিআরটি বলি; পুরো পৃথিবীর মধ্যে আমাদের ইউনিট খরচ বেশি হচ্ছে। কারণ প্রকল্পের শুরুতে একটা কথা বলে, পরে প্রকল্পের সময় বেড়ে যায়, নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়। তখন খরচও বেড়ে যায়। তাই সরকারের ফিজিবিলিটি স্টাডি করা উচিত।
সরকারের অন্যতম ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুনধুম রেলপথ নির্মাণ। পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সঙ্গে ঢাকার সরাসরি রেল যোগাযোগ করতে ২০১০ সালে এই প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। ২০১১ সালে প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে প্রায় ৭ বছর স্থবির থাকার পর প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০১৮ সাল থেকে। আর অনুমোদনের ১৩ বছর পর প্রধানমন্ত্রী প্রকল্প উদ্বোধন করেন। এর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে নেটওয়ার্কের ৪৮তম জেলা হিসেবে যুক্ত হয় কক্সবাজার।
প্রকল্পের জন্য কক্সবাজার জেলায় ১ হাজার ৩৬৫ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে নয়টি রেলওয়ে স্টেশন, চারটি বড় ও ৪৭টি ছোট সেতু, ১৪৯টি বক্স কালভার্ট ও ৫২টি রাউন্ড কালভার্ট। বর্তমানে কক্সবাজার এক্সপ্রেস ও পর্যটক এক্সপ্রেস নামে দু’টো ট্রেন চলছে এই রেললাইনে। আগামী ১২ই জুন থেকে একটি বিশেষ ট্রেন চালুর কথা রয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক কক্সবাজার ভ্রমণ করায় এই রুটে ট্রেনের ব্যাপক চাহিদাও রয়েছে।